জাবেদা বেগমের এক দুই সন্তান। বড় ছেলে কাশেম এবং মেয়ে জরিনাকে নিয়েই তার পরিবার। জাবেদা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করে। তার মাসিক আয় খুব বেশী না হলেও কাশেম এবং জরিনার আর্থিক সহায়তার ফলে কোনোরকমে সংসারের ভাঙা গাড়ি গরুর গাড়ির মতন হেলে দুলে চলে।
কাশেম বাসার কাছেই একটি ওয়েল্ডিং-এর দোকানে কাজ করে। অন্যদিকে জরিনা সেলাইয়ের কাজ জানাতে বাসায় বসেই আশেপাশের কিছু কাপড়ের কাজের অর্ডার পায় এবং সেগুলো সময়মত করে দেয়। তাছাড়া সে ছোট ছোট পুতি দিয়ে নান্দনিক সব শো পিছ বানাতে পারে। সেগুলো বিক্রি করেও কিছু আয় হয়।
যাইহোক, একদিন কাশেমের বস তাকে চট্টগ্রামে তার আরেকটি দোকানে গিয়ে পাঁচ মাসের জন্য ওয়েল্ডিং-এর কাজ করতে বলে। আসলে চট্টগ্রামে একটি ছেলে এতোদিন ভালোই কাজ করছিল কিন্তু একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে কোথায় যে চলে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। এমতাবস্থায় চট্টগ্রাম থেকে জরুরী ভিত্তিতে খবর পাঠানো হয়েছে যে সিলেট থেকে যেন অতি সত্বর কাউকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। অন্যথায় কাজে চরম ব্যাঘাত ঘটবে।
বসের প্রস্তাব শুনে কাশেম শুরুতে একটু ইতস্তত করলে তার বস তাকে আশ্বস্ত করে বলে,
- যা কাশেম, যা। চট্টগ্রামে গেলে তুই অনেক আরামেই থাকতে পারবি।
- আসলে বস, আমার মা আর বোনকে ছেড়ে কখনো দূরে কোথাও যাইনি তো তাই একটু কেমন যেন লাগছে! তাছাড়া চট্টগ্রাম কত বড় শহর! কিছুই তো চিনি না!
- চিনিস না বলেইতো তোর যাওয়া উচিত। নতুন জায়গায় যাবি, নতুন মানুষের সাথে মিশবি। তোর অভিজ্ঞতাও বাড়বে তাই না?
- তা আপনি ঠিকই বলেছেন বস।
- তাহলে তুই যাচ্ছিস।
- আমি যেতে চাই বস, তবে যদি কিছু মনে না করেন তবে আমার মায়ের কি মত সেটা একটু বোঝার পরেই আপনাকে চূড়ান্ত কথা দিতে চাই।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তবে আজকের মধ্যেই জানাতে হবে কিন্তু।
- জি অবশ্যই। আমি বাসায় গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলে আপনাকে ফোনে জানিয়ে দেবো।
- বেশ।
কাশেম কাজ শেষে বাসায় পৌঁছেই চট্টগ্রামে কাজ করতে যাবার কথা বলে,
- মা, একটা কথা বলবো।
- বল।
- চট্টগ্রামে ওয়েল্ডিং-এর কাজের জন্য যেতে হবে।
- চট্টগ্রামে? কেন? এখানেইতো ওয়েল্ডিং-এর কাজ করছিস তাই না?
- হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো মা। তবে কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রামে ওয়েল্ডিং-এর কাজ করেই ফিরে আসবো।
- কিছুদিন মানে কতোদিন?
- এই ধরো পাঁচ মাসের জন্য।
- পাঁচ মাস! দুই দিন বা সাত দিন হলে এক কথা ছিল, পাঁচ মাস! তাও আবার সেই চট্টগ্রামে!
- মা, আমি কি বাচ্চা নাকি বলোতো? এতো ভয় পাও কেন? তোমার কি মনে হয় যে আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারবো না?
- তা না, তবে তুই কখনও এতোদিনের জন্য ঘরের বাইরে যাসনিতো তাই একটু কেমন যেন লাগছে। তাছাড়া কি খাবি, কোথায় থাকবি এসব নিয়েও আমার অনেকটা দুশ্চিন্তা থাকবে এটাও ঠিক।
- তুমি একদমই ভেবো না মা। তুমিতো ভালো করেই জানো যে আমার বস কতোটা উদার মনের মানুষ। তুমি দেখো আমি ওখানে বেশ আরামেই কাজ করতে পারবো।
- ঠিক আছে। তোর যখন সেখানে যাবার এতোটা সাধ তাহলে আমি আর না করবো না। কবে যাবি?
- বস বলেছেন যে কালই রওনা দিতে।
- কালকেই?
- হ্যাঁ।
- কয়েকটা দিন পরে গেলে হয় না?
- না মা।
- ঠিক আছে। তাহলেতো তোর হাতে সময় খুব কম। যা তাড়াতাড়ি তোর কাপড়চোপড় গুছিয়ে নে।
- জরিনা কোথায় মা?
- আছে আশেপাশে কোথাও। চলে আসবে।
- আচ্ছা মা আমি তাহলে বসকে ফোনে জানিয়ে দেই যে আমি চট্টগ্রাম যাবো।
- ঠিক আছে যা।
বসকে জানিয়ে দিয়ে কাশেম নিজের ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে জরিনাও বাসায় প্রবেশ করে। কাশেম তাকে খবরটা দিতেই প্রথমে হেসে উঠে কারণ তার মনে হয় যে নিশ্চয়ই কাশেম তার সাথে কোনও ঠাট্টা বা দুষ্টুমি করছে। কিন্তু মায়ের মুখে শোনার পর তার বিশ্বাস হয়। জরিনার মনটা হাঁড়ির মতন কালো হয়ে যায়।
পরদিন সকালে বিদায়ের কালে কাশেম তার মাকে জড়িয়ে ধরে। জাবেদার নয়নজুড়ে কান্নার ঢল নামে। মনে হচ্ছে যেন তার আদরের সন্তান চিরতরে তার বুক থেকে চলে যাচ্ছে! কাশেম চলে যায়; মায়ের কান্না আর থামে না।