এতো মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু পনেরো বছরের ইয়ামিন সেই বৃষ্টিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাত আটটার দিকে একা ছাতা এবং ধারালো কোঁচ হাতে ঘরের বাইরে বের হয়। বলাই বাহুল্য যে তার মা স্নিগ্ধা রহমানকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানোর পরই সে এমন ভয়ানক আবহাওয়ার মাঝে ঘরের বাইরে বের হয়!
স্নিগ্ধা রহমান বোঝেন যে এরকম বাজে আবহাওয়ায় একা ছেলেকে বের হতে দেয়াটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু তিনি এও জানেন যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়কে হয়তো আটকানো যেতে পারে, তবে এই জেদি ছেলেকে আটকানো কোনওভাবেই সম্ভব নয়!
যাইহোক, স্নিগ্ধা এই ভেবে ইয়ামিনকে বাইরে যাবার অনুমতি দেন এই ভেবে যে সে বেশীক্ষণ বাইরে থাকে না। তাছাড়া মাঝে মাঝে বেশ কিছু মাছও ধরে নিয়ে আসে। একদিন ছেলে বেশ কয়েকটি বড় বড় চিংড়ি এবং শোল মাছ ধরে আনার পর মাকে দেখানোর সময় এতোটাই উচ্ছ্বসিত ছিল যে এর চেয়ে আনন্দের কিছু যেন আর হয় না! ইয়ামিনের মুখে খুশীর ছটা দেখে মায়ের মনটাও ভালো হয়ে যায়।
ইয়ামিনের বাবা শাফকাত আহমেদ প্রায়ই বাজার থেকে বড় বড় রুই কাতলা ইত্যাদি মাছ নিয়ে আসেন। কিন্তু এসবের প্রতি ইয়ামিনের কোনও লোভ নেই বললেই চলে। সে রাতের বেলা পুকুর পাড়ে, ক্ষেতের ধারে, জলাশয়, ডোবা ইত্যাদি থেকে কোঁচের মাধ্যমে যে মাছ ধরে, সেই মাছ খুব আয়েশ করে খায়! স্নিগ্ধাও ছেলের আনা মাছগুলো তার পছন্দমতই রান্না করে দেন। একদিন ইয়ামিন বেশ কিছু ছোট ছোট চিংড়ি মাছ ধরে এনে মাকে ডাকতে ডাকতে বলে,
- মা! ও মা! কোথায় তুমি?
- আসছি!
- তাড়াতাড়ি এসো!
- আসছি তো বাবা! তোকে নিয়ে আর পারা গেলো না! অস্থির বানিয়ে ফেলিস! কি হয়েছে বল?
- এই যে দেখো চিংড়ি মাছ!
- দেখলাম!
- মাছগুলো কেমন লাফাচ্ছে দেখেছো মা!
- হুম! এখনও মরেনি দেখছি!
- মা! কাল কিন্তু এই মাছগুলো পেঁয়াজ মরিচের সাথে ভাজাভাজা করে রান্না করবে, ঠিক আছে?
- আচ্ছা ঠিক আছে। খুশীতো?
- খুশী!
- এখন আমি যাই? রান্নাঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে।
- ঠিক আছে।
যাইহোক, বৃষ্টির তীব্রতা প্রতি মিনিটে যেন বেড়েই চলেছে। ইয়ামিন অনেক কষ্টে ছাতা দিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেও প্রবল বাতাসের কারণে ব্যর্থ হচ্ছে। তার মনে হয় এই বুঝি ছাতাটি ঘুড়ির মতন আকাশে উড়ে যাবে! সে হ্যামলেটের মত দ্বিধায় পড়ে যায়। সামনে যাবে নাকি বাসায় ফিরে যাবে- এই দ্বন্দ্বের ঘোরে তার মন চরকির মতন ঘুরতে থাকে।
ডোবাটির এতো কাছে এসেও ফিরে যাবার চিন্তা ইয়ামিনের মনকে পীড়া দিতে থাকে। সে সকল ভয়কে জয় করে সামনের দিকেই অগ্রসর হয়। আরেকটু পথ পেরুলেই একটি ছোট্ট ডোবা আছে। সেই ডোবায় বেশ কিছু মাছ আছে তা ইয়ামিন আগেই জানতো।
ঐ রাতে ইয়ামিন আর ঘরে ফিরে যায়নি। প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন ধরণের খেলায় লিপ্ত হয়; কে জানে, ইয়ামিনকে নিয়েও প্রকৃতি হয়তো কোনও ভয়ংকর খেলাই খেলছে! তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতামাতা ঝড় তুফানের রাতে যতটুকু খোঁজ নেয়া যায় তা করেছেন। তবে অনিদ্রায় একটি ভয়াল রাত কাটানোর পর দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই শাফকাত এবং স্নিগ্ধা উন্মাদের মতন ঘরের বাইরে বের হয়ে যান তাদের প্রাণ ভোমরা ইয়ামিনকে খুঁজতে। কিন্তু হায়, ইয়ামিনের খোঁজ কোথাও মেলে না!