রাত বারোটায় শরিফার সারা শরীর মৃগী রোগীর মত কেঁপে উঠলে স্বামী সাইফ ভয়ে দিশেহারা হয়ে যায়! এতো রাতে সে যে ঠিক কি করবে তা ভেবে পায় না। শরিফার শরীরের অস্বাভাবিক কাঁপুনি যেন সময়ের সাথে সাথে বেড়েই চলেছে।
সাইফ দ্রুত এক গ্লাস পানি এনে শরিফার মুখে দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। শরিফার অনবরত কাঁপুনির ফলে সে ঠিকমত পানি পান করাতে পারে না। যাইহোক, আর সময় ক্ষেপণ না করে সাইফ বাসার অদূরে থাকা ফার্মেসী থেকে কিছু ঔষধ আনতে যায়। সে মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকছে যেন ঐ ফার্মেসী খোলা থাকে!
সাইফ ফার্মেসীর প্রায় কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে এক পুলিশ অফিসার এসে তাকে বলে,
- এতো রাতে ঘরের বাইরে কি করছো?
- আপনি দয়াকরে ভদ্রভাবে কথা বলুন। আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন না করলে অনেক খুশী হবো।
- চুপ ব্যাটা! তুই আমাকে ব্যবহার শেখাবি নাকি?
- দেখুন, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন! পুলিশ অফিসার হয়েছেন বলে কি যা ইচ্ছা বলবেন নাকি?
- আর একটা কথা বললে কিন্তু ধরে থানায় নিয়ে যাবো!
- আমাকে এসব ভয় দেখাবেন না! আমি কি করেছি যে আমাকে আপনি থানায় নিয়ে যাবেন?
- একটু আগে এই এলাকায় ডাকাতি হয়েছে। আমারতো সন্দেহ হচ্ছে যে তুমিও ডাকাতদলের একজন কিনা!
- আমার বাসা কাছেই। আমি সামনের ঐ ফার্মেসীর দিকেই যাচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী হঠাৎ করেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে বলেই ঔষধ কিনতে আমাকে এতো রাতে বাইরে আসতে হয়েছে।
- ডাকাতি করে ভদ্র লোকের মতন গা ঢাকা দেবার চেষ্টা না? এসবই বুঝি! চালাকি করে কোনও লাভ নেই!
- প্লিজ! আমাকে যেতে দিন! ঘরে আমার স্ত্রী অসুখের তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে! এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর দেরী হলে আমার স্ত্রী মারাই যাবে। প্লিজ যেতে দিন।
- তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
পুলিশ সন্দেহের বশে সাইফকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। দুশ্চিন্তায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে জানে না ঘরে অসুস্থ স্ত্রী বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। সে জেলখানার ভেতর থেকে বজ্রের মতন চিৎকার দিয়ে বলছে,
- আমি নির্দোষ! দয়া করে আমাকে যেতে দিন! আমি ডাকাত নই! আমার স্ত্রী ঘরে একা, সে খুব অসুস্থ! দয়া করে আমাকে যেতে দিন!
- ঐ চুপ! একদম চুপ! ডাকাতি করো আর এখন বাঁচার জন্য অজুহাত দেখাও না? একজন পুলিশ কর্মকর্তা ক্রোধান্বিত হয়ে বলে।
- বিশ্বাস করেন স্যার! আমি কিছু করিনি! আমিতো ঔষধ কিনতে ফার্মেসীতে যাচ্ছিলাম!
- চুপ!
সাইফের পকেটে তার নিজের মোবাইল ফোন ছিল না। ইতোমধ্যে কাকুতিমিনতি করার পরেও একটিবার তাকে ফোন করতে দেয়া হয়নি। রাত দুটা বাজে। এই রাত যেন সাইফের জীবনে সবচেয়ে ভয়ানক রাত। এক একটি সেকেন্ড যেন এক একটি যুগ! সারারাত সাইফ ঐ জেলখানার এক কোণায় বসে কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছে।
সকালবেলা সাইফ একজন কনস্টেবলকে দুইশত টাকা দিয়ে বিনীত অনুরোধ করে যেন তার মোবাইল থেকে একটি কল করতে দেয়া হয়। কনস্টেবল তাকে অনুমতি দিলে সে তার এক চাচাতো ভাইকে ফোন করে বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় আসার জন্য। সেই চাচাতো ভাইয়ের নাম জাবির খান। সে বিমানের মত গতিতে থানায় এসে উপস্থিত হয়। সাইফের সাথে কথা বলে জাবির বুঝতে পারে যে শুধুমাত্র হেনস্থা করার জন্য এবং কিছু উপরি টাকা আদায়ের জন্যই সাইফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা সাইফকে গ্রেপ্তার করেছে জাবির তার কাছে গিয়ে বলে,
- স্যার, আমার ভাই সম্পূর্ণ নির্দোষ!
- নির্দোষ নাকি দোষী তা তদন্ত করার পরেই বের হবে। তার আগ পর্যন্ত তাকে এখানেই থাকতে হবে।
- স্যার, আমি বলছিলাম কি, মানে কিছু নিয়ে যদি ছেড়ে দিতেন!
- এইতো আসল লাইনে এসেছো! দশ হাজার টাকা লাগবে!
- দশ হাজার টাকা!
- হ্যাঁ, এর এক টাকাও কম হবে না!
- স্যার, আমাদের দশ হাজার টাকা দেবার সামর্থ নেই।
- তাহলে আমার কিছুই করার নেই।
- স্যার, কিছু মনে করবেন না, পাঁচ হাজার টাকায় বোঝাপড়া হয়ে যাক স্যার!
- এতো কম?
- প্লিজ স্যার!
- আচ্ছা, ঠিক আছে। টাকা সাথে আছে?
- সাথে নেই স্যার! তবে আপনি অনুমতি দিলে আমি যাবো আর নিয়ে আসবো স্যার!
- তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো। আমাকে আবার বের হতে হবে।
- অনেক ধন্যবাদ স্যার! আসসালামুআলাকুম স্যার!
- জলদি যাও!
জাবির টাকা নিয়ে আসে এবং সাইফও ছাড়া পেয়ে যায়। সাইফ পাগলের মতন তার বাসায় ছুটে গিয়ে দেখে বিছানায় তার স্ত্রী শরিফা শুয়ে আছে। প্রথমে তার মনে হয় যে স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই সে তাকে না ডেকে চুপ করে পাশেই শুয়ে থাকে। সাইফ পরম ভালোবাসায় শরিফার দিকে তাকায়। তখন সাইফের মনে হয় শরিফার নিঃশ্বাস ওঠানামা করছে না! সে শরিফার নাকের কাছে নিজের হাত রেখে বুঝতে চেষ্টা করে যে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক কি না কিন্তু তা স্বাভাবিক নয়!
আতংকে জাবিরের সমস্ত শরীর বরফের মতন শীতল হয়ে যায়। সে সাথে সাথে তার পরিচিত এক ডাক্তারকে ফোন করে বিশেষ অনুরোধ করে যাতে তিনি দ্রুত আসেন। ডাক্তার এসে শরিফার নাড়ি এবং শ্বাসপ্রশ্বাস চেক করে দেখেন যে শরিফা মৃত। জাবিরকে এটা জানাতেই সে আর সহ্য করতে না পেরে মূর্ছা যায়।
যেখানে আইনের শাসন নেই, সেখানে মানবতা কাঁদে না, বরং তার মৃত্যু হয়! এমন একটি সুন্দর ও গোছানো সংসার মাটির পুতুলের মতন মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। শরিফার এভাবে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার দায়ভার কি সেই লোভী পুলিশ কর্মকর্তা নেবে?