একজন পিতার সংগ্রাম [Bangla Story]

বন্ধু বশিরের পরামর্শে কুদ্দুস স্বাধীন ব্যাংক থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছোট্ট একটি পানের দোকান দেয়। শুরুতে ব্যবসা বেশ ভালোই চলে কিন্তু কয়েকমাস পর তার দোকানের পাশে আরেকটি পান দোকান হওয়াতে ব্যবসা মন্দা চলতে থাকে।

 

যেহেতু ব্যবসা আর আগের মতন নেই, সেহেতু কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে কুদ্দুসকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। একদিকে তার স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে পরিবার চালাতে হয়। অন্যদিকে প্রতিমাসে ঋণের বোঝা তার কাছে পাহাড়ের মত মনে হয়।

 

এমনও দিন গেছে যখন পুরো পরিবার রীতিমত অনাহারে দিন কাটিয়েছে। প্রতিদিন কুদ্দুস আল্লাহ্‌র কাছে মন থেকে প্রার্থনা করে যাতে তার পরিবারে সুখ শান্তি ফিরে আসে। কিন্তু দিন যত গড়ায়, কুদ্দুসের সমস্যা ততই বেড়ে চলে। এদিকে দুই মাস সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি বলে ব্যাংক থেকে তার কাছে নোটিশ এসেছে। নোটিশের ভাষা ছিল ঝাল মরিচের মতই কড়া। কুদ্দুস যদি পরবর্তী মাস থেকে নিয়মিত ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তবে ব্যাংক তার পানের দোকানের মালামাল এবং তার বাসায় যা কিছু আছে সব নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করবে।

 

এমনিতে সমস্যা সর্বদা কুদ্দুসের আশেপাশে ছায়ার মত ঘুরে, নোটিশ পাবার পর তার জীবনে যেন ঘোর অমানিশার আবির্ভাব হয়। সে ঠিক কি করবে তা ভেবে পায় না। কারো কাছ থেকে যে কিছু টাকা ধার নেবে তারও উপায় নেই। কে দেবে তাকে ধার? যার কাছে চাইবে তার নিজেরই আর্থিক সমস্যা অনেক। তাছাড়া কিছু মানুষ আছে যাদের টাকা আছে ঠিকই কিন্তু এমন ভাব করে যেন তারাও অভাবে আছে! ইতোমধ্যে কয়েকজনের কাছে টাকা ধার চেয়ে তার এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে।

 

পরবর্তী মাসেও নির্দিষ্ট তারিখে কুদ্দুস টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। যথারীতি ব্যাংক থেকে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আসেন; তার সঙ্গে দুজন পুলিশও আছেন। কর্মকর্তাটি কুদ্দুসকে বলেন,

 

- তোমাকে নোটিশ দেয়া হয়েছিল এই মর্মে যে যদি তুমি সময়মত টাকা পরিশোধ করতে না পারো তবে তোমার যাবতীয় মালামাল ক্রোক করা হবে। যেহেতু তুমি তা করতে ব্যর্থ হয়েছ সেহেতু চুক্তিনামা অনুসারে আমরা তোমার নেয়া ঋণের অর্থের সমপরিমাণ মালপত্র বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করবো।

- স্যার, একটু দয়া করেন স্যার! আমারে আর কয়ডা দিন সময় দেন স্যার!

- অনেক সময় দেয়া হয়েছে। এসব কান্নাকাটি করে কোনও লাভ নেই! আর একদিনও সময় দেয়া সম্ভব নয়।

- স্যার, আমি গরীব মানুষ! আমার পরিবার আছে। আফনেরা আমার সামাইন্য যা কিছু আছে তা বেইচ্চা দিলে আমারে পরিবার লইয়া পথে নামতে হইব, ভিক্ষা করতে হইব স্যার!

- এসব আমাকে বলে লাভ নেই! ঋণ নেবার সময় বোঝা উচিত ছিল। তখন তোমাকে ঋণের শর্তগুলো খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল তাই না?

- হ স্যার, আফনে ঠিকই কইছেন। কিন্তু আমার ব্যবসা খারাপ চলতাছে দেইখা বিপদে পড়ছি স্যার, আমারে একটু দয়া করেন স্যার!

 

        কর্মকর্তাকে উপর থেকে যেরকম নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তিনি ঠিক সেইভাবেই কাজ করেছেন। দয়া নামক অনুভূতি থেকে তিনি নিজেকে যোজন যোজন দূরে রাখতে সফল হয়েছেন। তিনি জানেন যে যদি তিনি দয়া দেখাতে যান তবে তার চাকরিটাই হয়তো চলে যাবে। জগতে কিছু মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বার্থের খাঁচায় বন্দী থাকে। আসলে তারা কখনও সেই খাঁচা ভেঙে বের হয়ে আসতে চায় কিনা সন্দেহ কারণ তারা খুব ভালো করেই জানে যে এতে তাদের লাভের অংশ অনেকটা না হলেও কিছুটা নিশ্চয়ই কমবে! তারা সেই কিছুটা লভ্যাংশও হাতছাড়া করতে নারাজ! এতে যদি মানবতা গুমরে মরে তাতেও তাদের কিছুই আসে যায় না!    

 

        কুদ্দুস এখন সম্পূর্ণ নিঃস্ব, অসহায়। সে নিজের জন্য ভাবে না, তার খুব কষ্ট হয় তার ক্রন্দনরত সন্তানদের চাহনি দেখলে। সে বাবা হিসেবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে; সন্তানদের মুখে কুদুস একটুও হাসি ফোটাতে পারেনি। তাদেরকে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারেনি, স্বপ্ন বাস্তবায়নতো দূরের কথা!

 

        কর্মকর্তা বিক্রয়যোগ্য মালপত্র নিয়ে যাবার পর কুদ্দুস, তার দুঃখী স্ত্রী এবং সন্তানেরা কাঠের মতন দাঁড়িয়ে থেকে তাদের প্রিয় জিনিসগুলো নিয়ে যেতে দেখে আর কাঁদে। 

View kingofwords's Full Portfolio
tags: