ভয়ংকর সাবলেট [Bangla Story]

             রাতুল এখন যে বাসায় থাকে সেই বাসার মালিক একটু বেশী খিটখিটে মেজাজের দিনে কিংবা রাতে কোনও কক্ষে সামান্য একটু আওয়াজ হলেই বজ্রাহতের মত ছুটে এসে তাকে দুকথা শুনিয়ে দেনবাড়িওয়ালা শুধু বাজে ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হন না, তার পাশাপাশি তিনি এ সংক্রান্ত নীতিমালা বিশাল কাগজে লিখে পোস্টারের মত নিচে দেয়ালে টানিয়ে দেন যাতে সবাই তা পড়ে সতর্ক হতে পারে  

 

            রাতুল রীতিমত অতিষ্ঠ হয়ে পরের মাসেই নতুন বাসায় উঠেভাড়া প্রায় আগের বাসাটির মতইতবে যেহেতু সে একা থাকে তাই মনে মনে তার ইচ্ছা ছিল যদি একটি এক রুমের বাসা পেত তবে তার জন্য সবচেয়ে ভালো হতোএক রুমের বাসা অনেক ছিল কিন্তু সেগুলো তার কর্মক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় সে ভাড়া নেবার কথা ভাবেনিকোনও কোনও বাসা কাছে হলেও পরিবেশের কথা চিন্তা করে সেগুলোতে ওঠার বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছে

 

        যাইহোক, আপাতত দুই রুম, এক ডাইনিং, একটি টয়লেট এবং পাকঘর সমৃদ্ধ বাসাটিতেই রাতুল উঠেছেসে একটি ব্যাংকে চাকরী করেসে যে বেতন পায় তাতে এর চেয়েও সুন্দর এবং বড় বাড়িতে থাকার যোগ্যতা তার আছে, কিন্তু একা এতো বড় বাড়ি ভাড়া নেয়াটা তার কাছে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে হয়

 

গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা বাবাদের জন্য মাসে মাসে নিয়ম করে টাকা পাঠাতে কখনও ভুল হয় না তারএকদিন রাতুল যেই ব্যাংকে কাজ করে সেখানে অন্য ব্যাংক থেকে বদলী হয়ে আসা এক সহকর্মীর সাথে পরিচিত হয়তার নাম শিহানরাতুলের মত সেও অবিবাহিতআপাতত এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছে কিন্তু একটি বাসা যোগাড় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে

 

কথাপ্রসঙ্গে শিহান জানতে পারে যে রাতুল ব্যাংকের নিকটেই একটি ভাড়া বাসায় একা থাকে সেই বাসায় দুটি বেডরুম আছে জানার পর শিহান সেখানে সাবলেট হিসেবে থাকার দৃঢ় আগ্রহ প্রকাশ করে,

 

- আমি কি সাবলেট হিসেবে থাকতে পারি?

- সত্যি কথা বলতে কি এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি

- ভাবোনি তাতে কি? এখন ভাবতেতো আর সমস্যা নেই তাই না!

- তা ঠিক, আচ্ছা দেখি কি করা যায়

- আমার মনে হয় এতে আমাদের দুজনেরই সুবিধা হবে

- কিভাবে?

- তোমার বাসা ভাড়াও কমে যাবে এবং একা থেকে থেকে একঘেয়ে হতে হবে না; দু চারটে কথা বলার জন্য আমাকে পাওয়া যাবে!

- আচ্ছা, দেখি কি করা যায়আসলে আমি একাতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো নাপ্রথমে বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলতে হবেযদি তিনি অনুমতি দেন তবে আমারও কোনও আপত্তি থাকবে না

- কোনও সমস্যা নেই।। তুমি তার সাথে কথা আগামীকাল আমায় জানিও

- ঠিক আছে।    

 

রাতুল এর আগে কখনও এভাবে ভেবে দেখেনিকাউকে সাবলেট হিসেবে থাকতে দেয়ার কথা কখনই তার মাথায় আসেনিকিন্তু শিহানের আচার ব্যবহারে সে ভীষণ মুগ্ধ; তাছাড়া শিহানের সাধুর মত চাল চলনে রাতুল চুম্বকের মত আকৃষ্ট হয় কেন জানি তার মনে হয় যে শিহানকে সাবলেট হিসেবে থাকতে দিলে কি আর ক্ষতি?

 

পরদিন ব্যাংকে দেখা হলে শিহান রাতুলের কাছে তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতে চায়উত্তরে রাতুল বলে যে সে সাবলেট হিসেবে থাকতে পারবে তবে বাড়িওয়ালা প্রদত্ত কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে চলতেই হবেছোট খাটো কিছু নিয়মাবলী প্রায় সব বাড়িতেই একই ধরণেরশিহানের তাতে কোনও সমস্যা নেই

 

সেইদিন সন্ধ্যাতেই শিহান তার মালামাল নিয়ে রাতুলের বাসায় উঠেযেহেতু সে একা তাই তার সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুব বেশী না থাকাতে খুব সহজ হয়েছেঐদিন রাতে একসাথে খাওয়া শেষে রাতুল এবং শিহান একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে রাত দুটো পর্যন্ত গল্প করেগল্পের বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট থাকে নাকখনও ছেলেবেলার কথা শুরু হয় তো কখনও হলিউডে কোন নায়িকা কার সাথে সেক্স করল, বলিউডে কার সংসার ভাঙল, কার গোপন সেক্স ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়কখনও কখনও ব্যাংকের সুন্দরী কর্মকর্তাকে নিয়েও রসময় আলোচনা জমে উঠে

 

পরদিন দুজনেই অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠেযেহেতু শুক্রবার, ছুটির দিন তাই ব্যাংকে যাবার কোনও তাড়া নেই দুপুরে জুমার নামাজ পড়ে দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় যে বাইরে কোনও এক চাইনিজ রেস্তরাঁয় লাঞ্চ করবে যেই ভাবনা সেই কাজ

 

লাঞ্চ শেষে মার্কেট থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কিছু হিট ফিল্মের সিডি কিনে নিয়ে আসেবাসায় গিয়ে দুই বন্ধু মিলে অনবরত সিগারেট টানে আর কম্পিউটারে সেই ফিল্ম দেখেরাতুলের ছোটবেলায় ফিল্ম দেখার প্রতি খুব বেশী নেশা ছিল; সময়ের সাথে সাথে সেই নেশা পাথরের মত ক্ষয় হয়েছেমানুষের দেহে যেমন পরিবর্তন সাধিত হয়, সেই সাথে সাথে মনেরও পরিবর্তন হয়; সেই পরিবর্তন সাধিত হয় বলেই জীবনের একেকটি ধাপে মানুষের চিন্তায় ও মননে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু উত্থান এবং পতন ঘটে যা আটকানোর সাধ্য সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো নেই

 

রাতে খাওয়া শেষে ঘুমানোর পর গভীর রাতে রাতুলের ঘুম ভেঙে যায়তার প্রচণ্ড তেষ্টা পায়তৃষ্ণায় তার গলা শুকিয়ে খড়ের মত হয়ে যায়বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আবার পানি না খেয়েও থাকতে পারছে না; বড্ড অস্বস্তি হচ্ছেঅগত্যা উঠে পানি খেয়ে এসে আবার শুতে যাবে এমন সময় কেউ বিড়বিড় করে কিছু বলছে এমন শব্দ তার কানে আসে

 

রাতুলের বুকটা বাঁশপাতার মত কেঁপে উঠেসে দোটানায় ভুগে; একবার ভাবে একটু এদিক ওদিক হেঁটে দেখবে যে এতো রাতে কে এমন বিড়বিড় করছে? কিন্তু সাহসে কুলায় নাএক পা এগোয় তো দুই পা পেছায়! শব্দটি একটু পরপর সূক্ষ্ম তারের কম্পনের মত রাতুলের কানে এসে ধরা দেয়

 

শেষপর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে রাতুল বাঘের মত সাবধানে নিঃশব্দে পা ফেলে প্রথমে ডাইনিং রুমে যায় কিন্তু সেখানে সেই শব্দের উৎস না পেয়ে পাকঘরে যায়, তারপর বাথরুমেও যায় কিন্তু কোনও কাজ হয় নাঅবশেষে কৌতুহলবশত শিহানের রুমের দিকে এগিয়ে যায়; সেই রুমের দরজাটি ভেতর থেকে বন্ধরাতুল নিজের কান হরিণের মত অতি সাবধানে দরজার কাছে নিয়ে যায়কয়েক সেকেন্ড পরেই সে স্পষ্টভাবে পূর্বে শুনতে পাওয়া সেই বিড়বিড় করা শব্দ শুনতে পায়

 

রাতুল নিশ্চিত হয় যে শিহানের রুম থেকেই এই অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছেরাতুলের কাছে মনে হয় শিহান যেন কি সব মন্ত্র পড়ছেএমনিতেই ভয়ে তার বুক ঢোলের মত আওয়াজ করছে, কিন্তু যখন মন্ত্রের কথা মনে পড়ে, তখন এক অজানা অশুভ শঙ্কায় তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়কিছুটা বমি বমি ভাবও হয়সারা শরীর ঘামতে থাকে

 

রাতুল মনে মনে ভাবে যে শিহান কোনও ধরণের ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো জাদুটাদু করে না তো? তাছাড়া শিহানের রুম থেকে এক ধরণের অচেনা একটি গন্ধ ভেসে আসতে থাকেরাতুল সেই গন্ধটিকে ঠিক কিসের সাথে যে তুলনা করবে তা ভেবে পায় না

 

যেমনটা সাবধানতা অবলম্বন করে রাতুল এসেছে, ঠিক তেমন করেই সে তার রুমে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়েসারারাত আর তার ঘুম হয় না; ঐ বিড়বিড় শব্দ আর বিদঘুটে গন্ধের চিন্তা তার মগজে লাটিমের মত ঘুরপাক খেতে খেতে কখন যেন ভোরের আলো ফুটে যায়

 

আলো মানে অন্ধকারের মৃত্যু; আলো মানে সত্যের জয়, মিথ্যার পরাজয়; আলো মানে পবিত্রতা, অন্ধকার মানে শয়তানের প্ররোচনাভোরের স্নিগ্ধ আলো রাতুলের মন থেকে রাতের সকল ভয় এবং দুশ্চিন্তা যেন ধীরে ধীরে রাবারের মত মুছে দিয়েছে

 

রাতুলের মনে এখন ভয় নেই ঠিকই কিন্তু শিহানের প্রতি এখন তার মনে এক ধরণের সন্দেহ জন্ম নিয়েছেতার মনের সন্দেহটা একেবারে অমূলক নয় কেননা গতরাতে সে যা শুনেছে এবং অনুভব করেছে তাতে করে এটা নিশ্চিত যে শিহান গোপনে কিছু একটা করছে; নিশ্চয়ই সে তা প্রতি রাতেই করে

 

যদিও শিহান আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত রাতুলের কোনোরকম ক্ষতি হয়নি তবুও কেন জানি শিহানের সাথে সে আর পূর্বের মত প্রাণখুলে আলাপ করতে পারে নাদু জনের মাঝখানে যেন একটি অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে আছে

 

রাতুল যে একেবারেই শিহানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে তা নয়; সে ভালো করেই জানে যে শিহানকে একেবারে অবজ্ঞা করলে তার মনে সন্দেহের বীজ বপন করা হবেইতোমধ্যে শিহান রাতুলের কাছে দুয়েকবার তার ব্যবহারের পরিবর্তনের কথা জানতে চেয়েছে কিন্তু রাতুল বেশ সুকৌশলে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেরাতুল বলেছে যে বাড়িতে তার মা খুব অসুস্থ তাই আজকাল তার মন মেজাজ একটু খারাপ থাকেকারো সাথে তেমন একটা কথা বলতে ইচ্ছে হয় নাশিহানও রাতুলের এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করেছে

 

রাতুলকে সেই অজানা শঙ্কা ঘুণপোকার মত খাচ্ছেহুট করে শিহানকে বাসা ছেড়ে দেবার কথা বলাটাও সমীচীন নয় কারণ শিহান তখন এর পেছনের কারণ জানতে চাইবেরাতুল যদি শিহানের রহস্যময় ব্যাপারের সম্পর্কে বলেও নিশ্চিতভাবে শিহান তা অস্বীকার করবে

 

তাই রাতুল মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে যেভাবেই হোক শিহানকে হাতেনাতে ধরতে হবেতবেই তাকে শায়েস্তা করা যাবেযদি শিহান সত্যিই ব্ল্যাক ম্যাজিক করে থাকে তবে সেটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় কারণ এটি শয়তানের কাজরীতিমত ধর্মবিরোধীও বটে

 

ঐদিন রাতে রাতুল শিহানকে বলে যে তার শরীর খারাপ লাগছে তাই এখুনি ঘুমিয়ে পড়বেকিন্তু সে না ঘুমিয়ে জেগে থাকে; আসলে সে শিকারি কুমিরের মতন মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় থাকে; রাত তিনটার দিকে রাতুল ধীর পায়ে রাতুলের কক্ষের সামনে গিয়ে পূর্বের মত সেই দরজায় কান পাতেকিন্তু আজ সে গতরাতের মতন অদ্ভুত কোনও শব্দ শুনতে না পেলেও সেই বিদঘুটে গন্ধ ঠিকই তার নাকে আসে   

 

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও কোনও মন্ত্রের শব্দ না পেয়ে রাতুল ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়েপরদিন সকালে রাতুল শিহানের কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে তার রুমের দরজায় অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করতে থাকেকিন্তু ভেতর থেকে শিহানের কোনও সাড়াশব্দ পায় না

 

রাতুলের মুখ ভয়ে চুষে খাওয়া আমের বিচির মত শুকিয়ে যায়! আর কোনও উপায় না দেখে সে বাড়িওয়ালাকে ফোন করে আসতে বলেতিনি আসার পর নিজেও অনেকক্ষণ ধরে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেন, তবুও শিহান দরজা খুলে না 

 

 

অবশেষে বাড়িওয়ালা লোক ডাকিয়ে দরজাটি ভাঙার ব্যবস্থা করেন। দরজা ভাঙার পর শিহানের কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে যা দেখেন তা হলিউডের জনপ্রিয় কোনও হরর ফিল্মকেও হার মানাতে বাধ্যমেঝেতে ব্ল্যাক ম্যাজিক করার নানান সরঞ্জাম ছড়ানো ছিটানো এবং শিহানের মাথা তার ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রুমের এক কোণে ফুটবলের মতন পড়ে আছে! দেখে মনে হয় যেন কেউ ঘরের ভেতর গরু জবাই করে গেছে!   

View kingofwords's Full Portfolio
tags: