আয়ান বাসে উঠে কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে চোখ বন্ধ করে তার সিটে বসে আছে। এদিকে ধীরে ধীরে খালি বাস দেখতে দেখতে ভরে যাচ্ছে। প্রকৃতি যেমন শুন্যতা পছন্দ করে না, ঠিক তেমনি!
আয়ানকে দেখে মনে হতে পারে যেন সে গান শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে পঙ্খিরাজ পাখীর মত উড়ে বেড়াচ্ছে। আসলে ঠিক তা নয়। সে তার খুব প্রিয় গানগুলো শুনছে। তাছাড়া বাসের সিটে বসে অর্থহীনভাবে এদিক ওদিক তাকানোটা তার কাছে বিরক্তিকর লাগে।
ইতোমধ্যে গাড়ির চালক এসে উপস্থিত। যদিও আয়ানের কানে হেডফোনম তবুও গাড়ির ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দ সে টের পাচ্ছে। ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনেই আয়ানের রাগান্বিত সিংহের কথা মনে পড়ে যায়।
যাইহোক, তখন পর্যন্ত আয়ানের পাশের সিটটা খালি। যদিও তার দুচোখ বন্ধ, তারপরও কেউ এসে বসলে সে নিশ্চয়ই টের পেত। বাসের কন্ডাক্টর বলে উঠে “ওস্তাদ সামনে বাড়ান”; চালক গাড়িটি এগিয়ে নিতে না নিতেই চলন্ত অবস্থায়ই একটি মেয়ে তড়িঘড়ি এসে লাফিয়ে বাসে উঠে পড়ে!
আয়ান তখনও চোখ বন্ধ করেই আছে। মেয়েটির সাথে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ ছাড়া আর কোনও প্রকার বড় ব্যাগ নেই। সে যে বেশ খানিকটা পথ দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছে এটা নিশ্চিত। আয়ানের পাশের সিটে বসেই সে কুকুরের মত হাঁপাচ্ছে!
কয়েক মিনিট পর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ততক্ষণে আয়ান আসলেই ঘুমের দেশে হেঁটে বেড়াচ্ছে! এমনকি সে একটি অসাধারণ একটি স্বপ্নও দেখা শুরু করেছে। স্বপ্নে দেখছে যে সে দূরে কোথাও যাচ্ছে, তার পাশের সিটিটিতে একটি অপুর্ব সুন্দরী মেয়ে বসে আছে; মেয়েটির সৌন্দর্যের কাছে ভিঞ্চির মোনালিসা, গ্রীক দেবী আফ্রোদিতি কিংবা প্রিন্সেস ডায়ানার সৌন্দর্য যেন নস্যি!
আয়ান মেয়েটির সৌন্দর্যে এতোটাই মুগ্ধ যে সে তার চোখ ফেরাতে পারে না। মেয়েটি যেন কিছু না বলেই হাজারো কথা বলে যাচ্ছে তার হরিণীর মত চোখ দিয়ে। তার সৌন্দর্যের মাদকতা আয়ানকে চুম্বকের মত টানতে থাকে। সে টাইটানিক সিনেমার জ্যাকের মত বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে যায় নামহীন পরীর মত সুন্দর মেয়েটির রক্তজবার মত ঠোঁটে চুম্বন করবে বলে। মেয়েটিও তার সেই অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও নড়ছে না। যেন সেও চায় আয়ান তাকে সহস্র চুম্বনে সিক্ত করুক, যেমন করে কুয়াশার চাদর ভালোবেসে এ পৃথিবীকে সিক্ত করে।
আয়ান মেয়েটির ঠোঁটের কাছে যেতেই তার স্বপ্নটি ভেঙে যায়। সে আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকায়। তখনও তার হেডফোনে গান বেজেই চলেছে; এখন যে গানটি বাজছে সেটি হচ্ছে- “আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গেয়ি!”
আয়ান হেডফোনটি খুলে রাখার সময় পাশে বসা তরুণীটির দিকে দৃষ্টি পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটিও তার দিকে তাকায়। আয়ানের পা হতে মাথা পর্যন্ত যেন হাজার ভোল্টের কারেন্ট বয়ে যায়! সে চোখ এতো বড় বড় করে তাকায় যে মেয়েটির কিছুটা অস্বস্তি হয়। আয়ান মনে মনে ভাবে এ যে সেই মেয়ে যাকে এতক্ষণ সে স্বপ্নে দেখেছে!
আয়ানের মনে হয় যে সে এখনও স্বপ্ন দেখছে না তো? হতেও তো পারে যে এটি স্বপ্নই! নিজের অজান্তেই সে মেয়েটির ঠোঁটে চুম্বন করতে এগিয়ে যায়। মেয়েটি তা দেখে আয়ানের বাম গালে একটা কষে চড় বসায়!
এতো জোরালো চড় খেয়ে আয়ানের আর বুঝতে বাকি নেই যে সে পৃথিবী নামক গ্রহেই আছে! বোকার মত বাম হাতে নিজের গাল ঘষতে ঘষতে লক্ষ্মী ছেলের মত সে সোজা হয়ে বসে। সে যে ‘সরি’ বলবে সেই সাহসটিও আর নেই। যেন মেয়েটি আয়ানের সমস্ত শক্তি নিংড়ে বের করে নিয়েছে, কাপড় ধোয়ার পরে যেমন পেঁচিয়ে সব পানি বের করা হয় ঠিক তেমনি।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর আয়ান মেয়েটির দিকে তাকায় এবং বলে,
- আমি আসলে খুব লজ্জিত এবং দুঃখিত।
- ঠিক আছে। কোনও সমস্যা নেই। আপনার বেয়াদবির পাওনা আমি মিটিয়ে দিয়েছি। তাই সমান সমান হয়ে গেছে। যদি আবার এমন করেন, তবে আবারও পাওনা মিটিয়ে দেব!
- আরে না, না, কি যে বলেন? আমি তেমন ছেলে নই। আমি কেন যে এমন বোকামি করতে গেলাম আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না।
- চড় খাবার পরে নিশ্চয়ই বোঝা উচিত আপনার!
- প্লিজ থাক না ওসব কথা! আচ্ছা আমি কি আপনার নামটা জানতে পারি?
- হুম! পারেন, নাম বলতে তো কোনও সমস্যা নেই। তবে নাম বললে আবার আমার ফোন নাম্বার চাইবেন না তো?
- না, না, বললাম তো, আপনি যেরকম ভাবছেন আমি তেমন ছেলে নই। আসলে আমি একজন শান্ত শিষ্ট ধরণে...
- লেজ বিশিষ্ট ধরণের ছেলে তাই না?
- হা, হা, হা! আপনি বেশ মজা করে কথা বলেন।
- হুম! আমার সেন্স অব হিউমার জনি লিভারের চেয়েও ভালো তো তাই!
- জনি লিভারকে ঠিক চিনলাম না! উনি কি আপনার আত্মীয় হন?
- হা, হা, হা! জনি লিভারকে চেনেন না? আপনি কি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছেন নাকি? নাকি আমার সাথে মশকরা করছেন হ্যাঁ?
- না, সত্যি বলছি, আমি উনাকে চিনি না!
- আপনি কি হিন্দি সিনেমা দেখেন না?
- দেখি, তবে সংখ্যায় খুবই কম। বিখ্যাত দুয়েকজন অভিনেতা অভিনেত্রী ছাড়া বাকিদের ঠিক সেইভাবে চিনি না।
- ও, তাই বুঝি?
- কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?
- ফোন নাম্বারের কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা বলতে পারেন!
- আপনার হাসিটা খুব সুন্দর!
- হ্যাঁ, আমি জানি। এই পর্যন্ত তেপ্পান্ন বার এই কথাটি আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়াছে! আপনি হইলেন চুয়ান্ন নাম্বার!
মেয়েটির সাধু ভাষায় বলা শেষ কথাগুলো শুনে আয়ানের মুখে হাসি না ফুটলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই সে হাসতে থাকে। সে এতো বিনয়ের সাথে ভদ্রলোকের মত তার প্রশংসা করা সত্ত্বেও মেয়েটি তাকে একটা ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত বলেনি!
এমন বিচিত্র ধরণের অসম্ভব সুন্দর মেয়ে আয়ান আগে কখনও দেখেনি। মেয়েটির কথায় এমন জাদু মাখানো আছে যে তার মনে হচ্ছে যেন এই বাস কখনও যেন না থামে। সব যাত্রী যেভাবে বসে আছে বসেই থাক। বাস চলতেই থাকুক সময়ের বুক চিড়ে, যুগযুগ ধরে!
এসব ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি আয়ানকে বলে, ‘আপনার ফোনটা দিনতো!’ আয়ানও বাধ্য ছেলের মত পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেয়। যেন ফোনটা মেয়েটিই তাকে রাখতে দিয়েছে, এখন ফেরত চাইছে!
মেয়েটি তার বাবাকে ফোন করে বলে,
- তুমি কোনও চিন্তা করো না, আমি রাগের মাথায় ঘর ছেড়ে বের হয়ে এসেছি ঠিকই, তবে আমি কোনও অন্যায় কিছু করব না।
- তুই এখন কোথায় আছিস আমাকে বল?
-আমার উপর আস্থা রেখো; আমি শীঘ্রই ঘরে ফিরব। তবে তোমরা যদি আবারও বিয়ের ব্যাপারে জোরাজুরি করো তবে আমি কিন্তু চিরদিনের মত ঘর ছেড়ে যাব, মনে থাকে যেন!
- তোর উপর কেউ কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে না মা। আমি কথা দিচ্ছি; আমার উপর বিশ্বাস রাখিস।
- ঠিক আছে, তোমার কথা বিশ্বাস করছি।
- রাগ ঝেড়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আয় লক্ষ্মী মা আমার! তোর চিন্তায় সকলেই অস্থির!
- আচ্ছা, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। রাখি। বাই!
মেয়েটির শেষের কথাগুলো শুনে আয়ান প্রকৃত বিষয়টি আঁচ করতে পারে। কথা শেষ হতেই মেয়েটি ফোনটি আয়ানকে ফিরিয়ে দেয়। তখনও সে একটিবারের মতও ‘থ্যাংক ইউ’ বলে না! যাইহোক, মেয়েটি চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে গিয়ে চালককে গাড়ি থামাতে বলে। চালক অপারগতা প্রকাশ করলে মেয়েটি এতো তীব্রভাবে ধমক দিয়ে গাড়ি থামাতে বলে যে আয়ানের কান বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়! আয়ানের মনে হয় যে কানের পাস ঘেঁষে যেন বন্দুকের গুলি ছুটে গেছে!
চালক তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামায়; মেয়েটি তরতর করে নেমে যায়। আয়ান হাবার মত মেয়েটির নেমে যাওয়া দেখে! মেয়েটি চলে যাবার পর তার মনে হয় যে তার নামই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি!
আয়ান বাড়িতে পৌঁছে ফোনের ডায়াল লিস্ট থেকে মেয়েটির বাবার নাম্বারে ফোন দিয়ে কৌশলে তার নাম্বার যোগাড় করে নেয়। রাত এগারোটার দিকে আয়ান মেয়েটিকে ফোন দেয়। সে নিশ্চিত ছিল যে এতো রাতে অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলে নিশ্চয়ই সে ধরবে না। কিন্তু সে ফোনটি ধরে; আয়ান তার পরিচয় দেয়; বাসের ঘটনা বলে। মেয়েটিও তখন স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে কথা বলে। একপর্যায়ে আয়ান তার নাম জানতে চাইলে মেয়েটি বলে- ‘কথা’।
এভাবে কথার সাথে কথা বলতে বলতে একসময় দুটি প্রাণ একই সুরে বাধা পড়ে। প্রেমের সাগরে ঢেউ হয়ে দুটি হৃদয় ভেসে চলে সময়ের হাত ধরে...