9 February 2014

 

 

ভীষণ রকমের মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আমি একজন বেকার। এটাই এখন আমার সবচাইতে বড় পরিচয়। আমার অনেক বড় একটা ডিগ্রি আছে! কিন্তু আমি বেকার। এমন দেশে বাস করি যে দেশে ভাল রেজাল্ট করা একটা অভিশাপ। সেই অভিশাপ আমাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাকে শুনতে হচ্ছে আমি একজন বেকার বেকার বেকার! এটাই এখন আমার বড় পরিচয়। একজন বেকার মানুষের কোন আত্মসন্মান থাকতে পারে না। বেকারের আবার আত্মসন্মান কি? বেকার কে যে যা খুশি বলবে। যে যেমন খুশি আচরন করবে। ইচ্ছা হল ডাকবে, ইচ্ছা হল ভুলে যাবে। প্রতিনিয়ত আমাকে এইসবই দেখতে হচ্ছে। একজন বেকার মানুষকে যেভাবে খুশি উপদেশ দাও। যা খুশি বল। উপদেশ দিতে ত আর টাকা পয়সা লাগবে না। কাজেই চিন্তা কি? একজন বেকারকে তো অন্যরা মনে হয় মানুষের কাতারেই ফেলে না। তার কোন ভাল লাগা মন্দ লাগা থাকতে পারবে না। কারণ সে একজন বেকার। জীবন ভিষণ সংকীর্ণ লাগছে। প্রতিনিয়ত আমাকে মনে হচ্ছে অসহায়ত্ব গ্রাস করে নিচ্ছে। নিজের লেখা নিজের কাছে খুব উচ্চমার্গীয় সাহিত্য মনে হলেও কিছু করার নাই। এই সাহিত্য মাঝে মাঝে অভিশাপ হয়। নিজের লেখাপড়া নিজের কাছেও দুর্গতির কারণ হয়। নিজের দৈন্যতার কাছে নিজেই বারবার পরাজিত হয়ে যাই!

 

কাল ঘুমাতে যাওয়ার আগে থেকেই নাইমা খুব ভার ভার। বুঝলাম মন খারাপ হয়েছে কোন কারনে। অনেক চেষ্টার পরে জানতে পারলাম মন খারাপের কারন। ঐ সেই আমার বেকারত্ব। আমাদের প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসতে আর প্রায় মাস তিনেক আছে। অথচ আমার কর্ম সংস্থানের কোন উপায় নাই। যার কাছেই যাই সেই গালভরা কতগুলো উপদেশ দেয়। চাঁদমুখ করে হাসি মুখে সেইসব কথা শুনে আমার অনেক ভদ্রতা করতে হয়। না করে উপায় কি? আমি যে বেকার! নাইমা চোখের পানি ফেলে বলল, যদি আমি কোন কাজের যোগাড় করতে না পারি তাহলে, ও বাচ্চা নিয়ে চলে যাবে ওর মত করে। আর না হলে আমাকে কোন ব্যবস্থা করতে হবে। আমি আর কি করতে পারি? এত এত চেষ্টা অথচ কিছুই কোন কাজে আসছে না। স কিছু হাতে এসেও যেন চলে যাচ্ছে। কেউ যেন আমাকে চিনেও না। কচুপাতার পানির মত সব কিছু ঝরে পড়ে যাচ্ছে।  

 

সকালে ৮ টার সময় ক্লাস ছিল। রাস্তায় গিয়ে কোন বাস পাই না। চেষ্টা করেও উঠা গেলো না। এক্ষেত্রে আমার মত বেকার আর কি করতে পারে? টাকা খরচ করতেও ভয় লাগে। বেকারের আর কিছু না থাকুক এক জোড়া পা তো আছে। সেই পা দুইটাই আমার সম্বল। হেটে হেটে চলে গেলাম ১১ নাম্বার এর কোচিং এ। দুইটা ক্লাস এর জায়গায় একটা ক্লাস। একটা ক্লাস এর জন্য আমাকে হেটে যেতে হল আবার ফেরার সময়ও হেটে আসতে হল। রিক্সা নেওয়ার মত বিলাসিতা করার সযোগ কই আমার? নাইমার ওষুধ কেনার সময় ও আমাকে আগে পিছে কতগুলা কথা চিন্তা করে নিয়ে হয়। আস্তে আস্তে কিছুটা ক্লান্তি আমাকে পেয়ে বসছে। নিজেকে বার বার শক্ত রাখতে চেষ্টা করি। আল্লহ পাকের কাছে সাহায্য চাই যেন উনি আমাকে ভেঙ্গে পড়তে না দেন। উনি যেন আমার মনে কিছুটা সাহস দেন। অনেক বার আমাকে হতাশা গ্রাস করে নিয়ে চেয়েছে। জোর করে করে নিজেকে নিজের জায়গায় ধরে রাখতে চেষ্টা করি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? ঘরে নতুন মানুষ আসছে। তার সামানে তুলে দেবার মত কতগুলো স্বপ্ন আছে কিন্তু বাস্তবায়নের কোন রুপরেখা পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত আশায় আশায় বুক বাধি। হয়ত কোন গতি হয় হয়।

 

দুপুরে নাইমা বললো, আমার উপরে খারাপ কোন কিছুর আসর পড়ে নাই তো? উড়ায়ে দেওয়া গেলো না কথাটা। হয়ত আছে আমি জানি না। আমি ত কারো সুখের ঘরে আগুন দিতে চাই না, তাহলে মানুষ কেন আমার ক্ষতি করতে চায়? আল্লহ পাকের বিচার আছে। খারাপের পরিণতি ভাল হয় না। দুপুরে নাইমা চাইনিজ ভেজিটেবল করলো। সেটা দিয়ে ভাত খেয়ে রওনা দিলাম আবার কোচিং এর উদ্দেশ্যে। এবার দুইটা ক্লাস পাওয়া গেল। ক্লাস শেষ করার পরে আসল আমার বহু আকাংখিত সেই ক্ষণ! আমাকে ২২ টা ক্লাস নেবার টাকা গুনে গুনে বেতন দেওয়া হল। ৪৪০০/=। প্রতি ক্লাস ২০০ টাকা করে! আগে দেওয়া হত ১৬০/=টাকা করে! এই হল আমার বেকার জীবনের কামাই। এখানে আমার মর্জি চলবে কেন? ভুলে গেলে চলবে কেন যে আমি বেকার?  আমাকে যা টাকা দিবে সেটা আমাকে চাঁদ মুখ করে নিতে হবে! এ যে তাদের দয়ার দান। আমার বেকারত্বের প্রতি দয়া। হেটে হেটে চলে আসলাম। মাঝ রাস্তায় একটা দোতলা বাস পেয়ে উঠে পড়লাম। কারণ আমার পা আর চলছিল না। আর কত হাঁটা যায়। এদিকে আমার কাশিটাও এখনও ভাল হত না। বেশী হাটতে পারি না। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেয়। রাস্তায় অনেক বেশী ধুলা। শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়। বাস থেকে নেমে হেটে হেটে আসছি বাসার দিকে, রাস্তায় মুহিত আর ওর বন্ধু শোয়েব এর সাথে দেখা। এই দুই বন্ধু মানিক জোড়ের মত একসাথে থাকে সবসময়। একই সাথে পড়ে। মুহিত সালাম দিয়ে আমার হাত ধরল। ওর এই হাত ধরাটাকেইয়া মার অনেক বিরাট কিছু মনে হল। মনে হল, কেউ একজন তো বেকারের হাত ধরল! ওরা orange-tee খেতে গিয়েছিল ১০ নাম্বার কোথাও। আমি এই চায়ের নাম শুনি নাই দেখে আমাকে বলল যে একদিন খাওয়াবে! বাসায় চলে আসলাম। মাগরিবের সময় হয়ে গেলো। নাইমা দেখি ফ্রায়েড রাইস ও রান্না করে ফেলেছে। আমার শ্বশুরের জন্য কিছুটা খাবার নিয়ে রওনা দিলাম বাইশটেকী। এটা নাইমার প্রথম রান্না ফ্রায়েড রাইস সার ভেজিটেবল। খেতে খুব ভাল হয়েছে। আমরা অবশ্য রাতে খেলাম!

 

বাইশটেকী গিয়ে ফুয়াদ, তাকিয়া আর আয়শাকে physics পড়ালাম। এটা ২য় দিন। আবার মঙ্গলবার পড়াব বলে কথা দিয়ে আসলাম। বাসায় এসে খাবার খেলাম। আর কিছু করতে ভাল লাগছে না। কারো কোন উপদেশ, ভাল কথা কিছুই আমার ভালো লাগছে না। নাইমাকে নিয়ে যখন রিক্সা থেকে নামলাম তখন আবার মুহিত আর শোয়েব এর সাথে দেখা। দোকানে কিছু ওষুধ ফেরত দিতে যাচ্ছিলো।

 

আর কিছু বলার নাই। জীবনে কতগুলো ব্যর্থতা, হতাশা আর অভিশাপ জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। জানি না, আমার এই হতাশার মাশুল গোনা শেষ হবে কবে!

View shawon1982's Full Portfolio