ক্ষমা করে দিস বন্ধু!
-
- - - - - -- -
ধাক্কা খেলাম অনেক বড় ধরণের। এমন একটা পরিস্থিতি আমার সামনে আসবে এটা, চরম বাস্তবতা হলেও, এমন কিছু দেখার জন্য আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। তাই বিকালের পর থেকেই মনটা অনেকটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মনকে ঘোরাতে চাইছি এদিক ওদিক, কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার সেই কথাটাই চলে আসছে সামনে।
ফেসবুক এর কল্যানে অনেক পুরানো দিনের কথা, মানে আজকের এই দিনে বিগত বছরগুলোতে কি পোস্ট দিয়েছিলাম সেগুলো তুলে আনে। ভালই লাগে। সেগুলো দেখতে গেলে অনেক সময়ই আমরা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। মনের অবচেতনে যে কথাগুলো চাপা পড়ে ছিল, সেগুলো স্মৃতির মণিকোঠা থেকে আচম্বিতে উঠে আসে। কিছু ভাললাগা যেমন কাজ করে, আমার কিছু মন্দলাগাও কাজ করে অনেক সময়। এমনই একটা দুঃখ ভারাক্রান্ত হবার মতোই ঘটনা ঘটেছে আজকে। আমার ফেসবুক ফিড এ এসেছে মেমোরির কথা। স্ক্রল করে যাচ্ছি যচ্ছি, একটা একটা বছর আগে চলে যেতে যেতে শেষে গিয়ে ২০০৯ এর ১৫ই অক্টোবরের তলানিতে গিয়ে ঠেকলাম। সবচেয়ে পুরনো স্মৃতি ফেসবুকের ঝুলিতে এটাই ছিল। ওইদিন আমি লিখেছিলাম “...... GoodBye…..”। কেন যে লিখেছিলাম সেটা মনে নেই, সেই কবের কথা! ১১ বছর গয়ে গেলো। কৌতুহল ভরে ক্লিক করে চলে গেলাম পরানো পোস্টটায়। অনেকের কমেন্ট দেখলাম তখনকার দিলে এখনকার মত মেনশন করা যেত না এবং যার যার কমেন্টে আলাদা আলাদা করে রিপ্লাই দেয়া যেতো না। কমেন্টের মধ্যে দেখলাম আমার বন্ধু রায়হান আহমেদ (রনি)’র কমেন্ট! ওর নামটা দেখার সাথে সাথে এক ঝটকায় চলে গেলাম স্মৃতিময় সেই সিঙ্গাপুরের প্রবাস দিনগুলোতে।
রায়হানের সাথে কিভাবে পরিচয় আগে সেই কথা বলি। যখন ল্যাবে সময় কাটানোর মত কিছু ছিল না। রিসার্চের চাপও তেমন ছিল না শুরুর দিকে।ইন্টারনেটে বন্ধুদের সাথে ইয়াহু মেসেঞ্জারে প্রচুর চ্যাটিং করতাম। তখন ইয়াহু গ্রুপ্স বলে গ্রুপ মেইলিং এর সুযোগ ছিল। সিঙ্গাপুরে যাবার আগেই বাংলাদেশ থেকে এক বন্ধু আমাকে ইয়াহু গ্রুপ “ধুমায় আড্ডা” এর কথা বলে। ওখানে নাকি সবাই অনেক মজা করে আর প্রচুর আড্ডাবাজি করা হয় ইমেইলের মাধ্যমে। এখন যেটা করা হয় চ্যাটিং এ মেসেঞ্জার গ্রুপ গুলোতে। সেই ধুমায় আড্ডার সূত্রে অনেকের সাথে আমার পরিচয় এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক এখনো এখনও আছে। মাত্র দুই এক জনকে এই পর্যান্ত সরাসরি দেখেছি। বাকীরা এখনও অনলাইনেই সীমাবদ্ধ আছেন। দেখার সুযোগ হয়নি। রায়হানকেও আমার দেখার সুযোগ হয়নি।
অনেক বন্দুবৎসল এবং সদালাপী রায়হানের সাথে মেইলের বাইরেও ইয়াহু মেসেঞ্জারে ব্যক্তিগত ভাবে কথা হত এবং আমরা খুব সহজেই ‘তুই তোকারি’ বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাই। আমি আগে বিয়ে করি। এরপর রায়হান বিয়ে করে। ও বাবা হয় ২০১২ তে, একটা মেয়ে হয় ওর। ওর মেয়ের ছবিও আমাকে মেসেঞ্জারে দিয়েছিল। মেয়ের জন্য দোয়া চেয়েছিল। তখন ছিল আমার ডক্টরেট থিসিস জমা দেবার একদম শেষভাগে। অনেক ব্যস্ততার মধ্যে দিন যাচ্ছিলো। এরপর ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে তো চলেই আসি। দেশে এসে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সময় যেতে থাকে। সেই আগের মত আর ইয়াহুতে চ্যাটিং করা হয়ে উঠতো না। কারণ ততদিনে ফেসবুক সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। আস্তে আস্তে রায়হানের সাথে যোগাযোগ অনেকটাই অগোচরে বন্ধ হয়ে যায় এবং স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। সম্পূর্ণ আমার ব্যর্থতা! রায়হান মাঝে মাঝে হয়তো পোস্ট দিতো কিন্তু তখন এত নিয়মিত দেখা হয়নি বা আমার চোখে পোড়েনি পোস্টগুলো।
গতকাল সেই গুড-বাই পোস্টে রায়হানের কমেন্ট দেখে সাথে সাথে ওর নামের উপরে ক্লিক করে মেসেঞ্জারে চলে গেলাম। গিয়েই সাথে সাথে মেসেজ দিলাম, “দোস্ত কেমন আছিস? আমাকে চিনতে পারছিস”? দেখে মনে হল ওর প্রোফাইলে ঘুরে আসি। কতদিন দেখিনা ওকে। কত ঠাট্টা করতাম ওর সাথে। যতদূর মনে পড়ে আমার ব্যাচমেটও ছিল। নারায়নগঞ্জে ছিল বাড়ী। প্রোফাইলে ঢুকে প্রথমেই ওর প্রোফাইলের ছবি গুলা দেখলাম। সেই পুরানো পুরানো ছবি। কোন নতুন ছবি নেই। কিন্তু টাইমলাইনে গিয়ে আমি এমন ধাক্কা খেলাম যে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। আচমকা আমার মনে হলো আমাকে কেউ যেন ধরে ফেলে দিলো। টাইমলাইনে পোস্টের পর পোস্ট মানুষের! সবাই ওর পারলৌকিক শান্তির প্রার্থনা করছে।
বুঝতে বাকী রইলো না, আমার সাদাসিধা সরম মনের বন্ধুটা আর নেই। কবে হলো কিভাবে হলো কিচ্ছু জানি না। ভারাক্রান্ত মনে স্ক্রল করে করে নিচে যেতে থাকি। যেতে যেতে একসময়, রায়হানের শেষ স্ট্যাটাসে গিয়ে ঠেকি। যেখানে রায়হান লিখেছিল- “আমার শরীরটা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুরা দোয়া রেখো আমার জন্য। হার্টের সমস্যা লাগছেই...”। এটা সে লিখেছিল ২৭শে অক্টোবর ২০১৪ তে। এর মাত্র আট দিন পরে অর্থাৎ ৭ই নভেম্বর ২০১৪ রায়হান আমাদের ছেড়ে চলে যায়। রেখে যায় দুই বছরের একটা মেয়েকে। এতদিনে মেয়েটা নিশ্চই ৮ বছরের একটা উচ্ছ্বল বালি আমি এতই অধম এক বন্ধু, আমি খবরটা পেলাম ৬ বছর চলে যাবার পরে। কালকে এই খবরটা পড়ার পর থেকেই আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। কিছুতেই ভুলতে পারছিনা, আমার সিঙ্গাপুরের একাকী নিঃসঙ্গ সময়গুলোতে ল্যাবের অবসরে রায়হানের সাথে কত সুন্দর সময় কাটিয়েছি কথা বলে এখন আর ওকে চাইলেও দেখতে পাবো না। কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র! তখন আবার রায়হানের সাথে দেখা হবে। তখন কি আমাকে চিনতে পারবে আমার বন্ধু, নাকি যোগাযোগ ছিল না বলে মুখ ভার করে বসে থাকবে?