প্রিয়তমেষু ‘তোমরা’
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল দিন-কাল-ক্ষণের পরিক্রমায়। তবুও মনে হয় এইতো সেদিন। তখন আমিও ভার্সিটি পড়তাম, তোমাদের মতই বয়স ছিল তখন। আমাদের তখনকার বাসায় দখিনের বারান্দা ছিল একটা। কাঁচের আবরণ সরিয়ে দিয়ে পুরো বারান্দাটাই উন্মুক্ত হয়ে যেত আমাদের খাবার ঘরের সাথেই। আমার আবার একটা উদ্ভট ব্যাপার আছে, জানো! আমি না চুপচাপ থাকতেও যেমন পারি না, তেমন চুপচাপ পড়তেও পারি না। যতটুকুই পড়তাম, আমার আসেপাশে শব্দ না হলে আমার কোন পড়াই মনে হয় মাথায় ঢুকতো না। আমি সবসময় ডাইনিং টেবিলে বই খাতা গুছিয়ে পড়তাম। নিজের পড়ার টেবিলে শুধু বই খাতাই পড়ে থাকতো। বাসার সবাই আমার পাশে ঘরাঘুরি করছে, যে যার মত কথাবার্তা বলছে, তখন ওই অবস্থাতেই আমি ডাইনিং টেবিলে পড়তাম। আমি একা একা থাকতে পারি না। আমার ভাল লাগতো না যে। আমি সবার সাথে কথা বলতাম, পড়তাম। এমনটাই ছিল আমার অভ্যাস। অভ্যাসটা মনে হয় আজও বদলাতে পারিনি। আর তখনকার দিকে তো স্মার্টফোন ছিল না, ফেসবুকও ছিল না, কাজেই মোবাইল ফোন আর মেসেঞ্জারে যে কারো সাথে আড্ডা দিবো, সেটারও উপায় ছিল না। মাঝে মাঝে দুই একজন বন্ধুকে আসতে বলতাম, ওরা আসলে ওদের কে নিয়ে ডাইনিং টেবিলটাতেই পড়তাম, গল্প করতাম। খাবারের সময় হলে বইগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে, খেয়ে নিয়ে আবার পড়তে বসতাম। যথেষ্ট বিরক্ত করে ফেলছি কি? খুব বেশী জরুরী কথা হয়তো না। তবুও মন চাইলো তোমাদের জন্য কিছু লিখি। তাই লেখা।
একদিন সন্ধ্যার সময় আমার বন্ধু মাথা তুলে দক্ষিণ দিকে আকাশের দিকে ইশারা করে বললো, দেখ দেখ! ঐ তারাটা দেখ! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। প্রথমে ভাল ঠাহর করতে পারলাম না। এরপর বন্ধ আমাকে বারান্দায় নিয়ে হাত গ্রিলের বাইরে নিয়ে ইশারা করে একটা উজ্জ্বল তারার দিতে তাকিয়ে বললো, ওই তারাটা ভাল করে দেখ! আমি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম। সত্যিই তো! দারুণ লাগছিল। অন্যান্য তারাও পিটপিট করে জানি, কিন্তু এটা যেন একটু বেশীই! অদ্ভুত সুন্দর। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম রংধনুর সাতটা রঙ এর কয়েকটাই বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এবং রংগুলো খুব দ্রুত একটা থেকে আরেক্টায় বদল হচ্ছিলো। কি সুন্দর একটা রঙের খেলা। কত স্পষ্ট! মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে তারাটা দেখতে লাগলাম। ‘নাম জানিস?’- আমার বন্ধুর করা প্রশ্নে ব্যাঘাত ঘটলো আমার মনোযোগে। আমি তারা দেখতে দেখতেই বললাম, না জানি না। ও তখন বললো, এই তারার নাম ‘সপ্তবর্ণিলা’। আমি বললাম, সাতটা রঙ দেখায় এজন্য এই নাম? ও বললো, হুম!
সেই ২০০৩ এর কথা যেদিন আমি সপ্তবর্ণিলা তারা চিনেছিলাম। সিঙ্গাপুরের আকাশেও দেখার চেষ্টা করেছি বার কয়েক। দেখতে পেয়েছি কি পাইনি, মনে পড়ে না। সেই প্রিয় সপ্তবর্ণিলা তারা আমি ২০২০ এ এসে আবার দেখতে পেলাম। তবে এবার একটা তারা নয়, অনেকগুলো প্রিয় সপ্তবর্ণিলা একসাথে। ওদের দ্যুতিতে মাটিতে আলোর প্লাবন বয়ে যায়। ওদের যখন দেখি, তখন এক লহমায় আমার বয়স ১৮ বছর পেছনে চলে যায়। আমি সপ্তবর্ণিলা তারাগুলোকে যখন একসাথে দেখি, আমার মন ভরে যায়। আমার সাদাকালো মনটায় কেউ যেন সাতটা রঙ এনে রাঙ্গিয়ে দিয়ে যায়। তখন আমার মনে হয় আমি বেঁচে আছি। নতুন করে বেঁচে আছি, তোমাদের মধ্যে। তোমাদের মধ্যে আমি আমাকেই দেখি। মনে হয় আমার চোখের সামনেই স্রষ্টা আমার পুনর্জন্ম দেখিয়ে দিলেন! তোমাদের দেখি আর মনে হয়- নতুন করে, নতুন স্বপ্ন দিয়ে, আলো আঁধারের অসম অনুপাত দিয়ে দিয়ে ঘেরা পৃথিবীটাকে আবার নতুন করে রাঙ্গিয়ে দেই। নতুন করে মানুষকে বাঁচতে শেখাই।
নতুন দিনের স্বপ্নের সন্ধানী,
এই আমি!