ছেলেদের বিয়ের বয়স ও লেখাপড়া
= = = = = = = = =
আমি নিজে এখন একজন বাবা তো, তাই বাবাদের উদ্দেশ্যেই বলছি। নিজেদের জীবনের অপূর্ণতাগুলোকে নিজের সন্তানের উপরে স্টিল রোলার চালিয়ে আদায় করে নেয়ার মানসিকতা মনে হয় পরিহার করার সময় এসে গেছে। আমাদের বাবাদের আমলের সময়কাল এবং মানসিকতা আর এখনকার ছেলেদের মানসিকতার মধ্যে মনে হয় বিস্তর ফারাক আছে। আমাদের বাবাদের আমলের অনেকেই (সবাই নয়), সামাজিক কোন চাপের কারণেই হোক বা অন্য কোন সংস্কারের চাপেই হোক, অনেকেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এরপর বিয়ে শাদী করেছেন। আর এই বিয়ে শাদী করতে গিয়ে অনেকের বয়সের কোটা ৩৫ অতিক্রমও করে গেছে, খেয়ালই করেননি। আর খেয়াল করলেও নিছক কতগুলো সামাজিক চাপের কারণে অনেক দেরী করে ফেলেছেন।
যে সমস্ত সামাজিক চাপের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তার একটা হল, ছেলে বিয়ে করলে পর হয়ে যায়। ছেলে মাত্রই যেন ‘জরু কা গুলাম’ বা ‘স্ত্রৈন’। বিয়ে করলেই যেন একটা ছেলের কাছে বাপ-মা তাঐ-মাঐ টাইপ কিছু হয়ে যায়। ছেলে পর হয়ে যাবে এই চিন্তা করেই অনেক বাপ-মা চোখের সামনে ছেলের বুড়িয়ে যাওয়া দেখেন অথচ ছেলের বিয়ের নামও মুখে আনেন না! আহ! কি স্বার্থপরতা তাই না? নিজেরা সংসার করছেন অথচ ছেলেটার একটা সংসার হোক সেটা চাইছেন না। বরং চাইছেন ছেলেটা কলুর বলদের মত সমস্ত শারীরিক মানসিক চাহিদা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে শুধু আপনাদের বানানো কুশপুত্তলিকা হয়ে থাক। পিতা-মাতাদের বলছি এই মানসিকতা পরিহার করুন। অনেক বাবা মাই বলে থাকেন, ছোট বোনের বিয়ে না দিয়ে ভাইকে কিভাবে বিয়ে দেই? এই নিয়ম কোথায় কোন ধর্মে পেয়েছেন আপনারা? আগে বড়ো ভাইয়ের বিয়ে করতে হবে, এরপরে ছোট বোনের বিয়ে হবে, একাধিক বোন থাকলে একে একে সবার বিয়ে হবে আর ছেলেটা বসে বসে কি করবে? বোনের শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে আপ্যায়ন করবে! কি নির্মম আর কি পাশবিক মনে হয় না আপনাদের কাছে? আমি আগেই বলেছি, সবাই এক নয়, তবে এখানে যেমন লিখছি, এমন বাবা-মায়ের অভাব নেই আমাদের আশেপাশেই।
ধর্মের কথা তো অনেকেই বলেন। ইসলাম ধর্মে যে ছেলেমেয়ের বিয়ে যৌবনের শুরুতেই দেয়ার কথা আছে, এই শাস্ত্র আপনারা ভুলে যান কেন? স্বয়ং মহানবী কি মাত্র ২৫ বছর বয়সে বেকার/অতি নগন্য বেতনভোগী হয়ে বিয়ে করেন নাই? হয়ত বলবেন উনার স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) ধনী ছিলেন! আপনারা কি কোরানের আয়াত পড়েন নাই, যে বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহ জীবনে স্বচ্ছলতা আনবেন বলে ওয়াদা করেছেন? কোথায় গেল আপনাদের ধর্ম বিশ্বাস? ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে এত আপত্তি? আর যখন তারা যৌবনের তাড়নায় কোন কান্ড ঘটিয়ে বসে তখন তো আপনাদের করা একটা ‘ছি’ ‘ছি’ ও মাটিতে পড়ে না। এখন ছি ছি করেন কেন? দোষটা কার ছিল?
অনেক পিতা সংসারের ঘানি টানতে টানতে নিজেরা বিয়ে করেছিলেন অনেক বেশী বয়সে গিয়ে। অনেকেই চল্লিশের কোঠা ধরিয়ে দিয়েছেন। বাবা হয়েছেন ৪২ বা ৪৫ এ গিয়ে। ছেলে যখন সবে ভার্সিটিতে উঠেছে তখন সেই বাবার বয়স ৬৫ এর কোঠা ধরে গিয়েছে ইতিমধ্যে। ব্যস শুরু হয়ে গেল নতুন মাত্রা কথা শোনানোর! আর কতদিন তোমাদের টানতে হবে? সংসার টানত্র টানতে আমি হয়রান পেরেশান হয়ে গেলাম। এবার তো সংসারের হাল ধর। টাকা উপার্জনের কথা চিন্তা কর। ভার্সিটিতে পড়ুয়া একটা ছেলে ভার্সিটি উঠে সারতে পারে না তার উপরে এভাবে বাক্যবান শুরু হয়ে যায়। মাত্র যেই ছেলের বয়স ২০-২২ বছর, সে যদি এখনই সংসারের হাল ধরার জন্য উঠে পড়ে লাগে, তাহলে ভার্সিটি পড়ায়ে কি লাভ? অনেকেরই ধারণা ভার্সিটিতে পড়ে মানে লাফাঙ্গা টাইপ। অদের কাজই হল সারাদিন খালি টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরেদের মত। জ্বী না ভাই! আমরাও ভার্সিটি পাস করে এসেছি। ভার্সিটি পাস করতে হলে কি পরিমান শারিরীক মানসিক স্ট্রেস যেতে পারে একটা ছেলে মেয়ের জীবনে খুব ভাল করেই জানা আছে।
ভার্সিটি পড়ুয়া একটা ছেলে, ২০-২২ বছর বয়সে, বেশীর ভাগেরই সামান্য চা-নাস্তা খাবার টাকা যোগাড় করার জন্যই টিউশনিতে যেতে হয়। টিউশনি করবে, ঘরে আপনাদের খোটা শুনবে, আর আপনারা আশা করেন রাতারাতি লেখাপড়া করে এরা বিদ্বান দিগগজ হয়ে যাবে? এটা হয় নাকি? বাবা-মা হয়ে সন্তানের মন মানসিকতায় সহায়ক ভূমিকা রাখার পরিবর্তে তাদের জীবন জাহান্নাম করে দেয়া হচ্ছে অনেক স্বচ্ছল পরিবারেও।
ভার্সিটি পড়ুয়া একটা ছেলের বয়স যদি ২৫ হয়, তখন যদি তার বিয়ের কথা বলা হয়, বাহ তাহলে তো কথাই নেই। খাওয়াবে কি? বেকার ছেলে বৌকে খাওয়াবে কি? কেন আঙ্কেল! আপনারা কি ভাত খান না? ছেলেকে কি ভাত রান্না করে খাওয়ান না আন্টি? তাহলে আপনার যদি এই ছেলের পাশে ২০ বছর বয়সী একটা নিজের পেটের মেয়ে থাকতো তাকে খাওয়াতেন না? নবীজীর কথাই আবার বলছি। বেকার ভাতিজাকে চাচা আবু-তালেব হাসিমুখে খাদিজার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের খুতবা নিজেই পড়েছিলেন আবু তালেব আর খুতবার মধ্যে এও বলেছিলেন, ‘দেন মোহরের দায় দায়িত্ব আমার উপরে ন্যস্ত থাকবে’।
কাফির বলে আবু-তালেবকে গালি দেয়া মানুষগুলা কোথায়? মন মানসিকতা কি আবু তালেবের থেকে উন্নত করতে পেরেছেন? মোহাম্মদ (সাঃ) ভাতিজা ছিল। নিজে অত্যন্ত গরীব হওয়া সত্ত্বেও ভাতিজার বিয়ের দেন মোহরের দায় ভার নিজের উপরে নিয়েছিলেন। আর আমাদের পিতা-মাতারা? স্বয়ং নিজের সন্তানকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? একবার নিজেদের যৌবনের দিনগুলোর কথা ভেবে দেখুন না। শরীরের যখন যৌবনের ডাক আসে, বর্তমান এই রঙ্গিন পৃথিবীতে একটা ২০-২৫ বছরের ছেলে মেয়ে কতক্ষন নিজেদের কে আটকে রাখবে? ভাবুন। একটু ভেবে দেখুন। আমাদের বাচ্চাদেরকে দয়া করে অবক্ষয় থেকে বাচান।
পরিশেষে মনে একটু কষ্ট নিয়েই বলি। আমি এস.এস.সি পাস করেছি সেই ১৯৯৯ সালে। আমার বয়স এখন ৩৮ চলছে। সেই হিসাবে আমাদের ব্যাচের সবার বয়সই এই ৩৮ অঙ্কটার আশেপাশেই আছে। এখনও যখন শুনি আমাদের ব্যাচের কোন বন্ধু এখনও বিয়ে করে নাই, চাকরী বাকরী করে যাচ্ছে... জানি না তাদের ভেতরের সব কথা, কিন্তু মনে চোট লাগে। বন্ধু, তোদের জন্য অনেক খারাপ লাগে। তোদের নিয়ে অনেক রসিকতা করি, এই লেখায় আমি করজোড়ে তোদের সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাদের মাফ করে দিস। হয়তো অনেক রসিকতায় তোদের মনে আঘাত করে ফেলি। নিজগুনে মাফ করে দিস তোরা। আর নিজেদের জীবন নিয়ে একটু ভেবে দেখ। অনেক তো করলি!