৪ মে ২০২০

**শৈশব ও কৈশোর যেভাবে গিয়েছে-১

 

একজন মধ্যবয়সী পুরুষের কিছু অতীত স্মৃতিচারণ পড়তে যদি আপনি বিরক্ত বোধ না করেন, তাহলে ইচ্ছে হলে আমার এই লেখাগুলো পড়ে দেখতে পারেন। এই এখন থেকে চেষ্টা করবো ধারাবাহিক ভাবে আমার বিগত শৈশব আর কৈশোরের কিছু কিছু কথা। এগুলোর মধ্যে যে কোন ধারাবাহিকতা থাকবেই, সেটা বলতে পারছি না। আমি সময়ের ধারাবাহিকতার বলছি। আমার প্রথম গল্পটা শুরু করবো আমার কলেজের একটা ঘটনা দিয়ে। জীবনে অন্ধভাবে কাউকে অনুসরণ করলে কখনও কখনও তার খেসারত দিতে হয় বৈকি। তেমনই একটা ঘটনা হয়েছিল আমার সাথে। একটা আবেগতাড়িত ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে আমাকে তার কেমন মূল্য দিতে হয়েছিল সেই উপাখ্যান।

 

স্কুল জীবন থেকেই বিশেষ করে ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকেই মনের ভেতর কিভাবে যেন এক অদম্য আকর্ষণ গড়ে উঠতে থাকে নটর ডেম কলেজের প্রতি। ঠিক কার কাছ থেকে এই কলেজের কথা শুনেছিলাম মনে পড়ে না। আমাদের সেই সময়ে, গবর্মেন্ট ল্যাব স্কুলের ছেলেদের বেশীরভাগেরই প্রবণতা ছিল ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া। আমরাই মনে হয় প্রথম ব্যাচ যাদের মধ্যে নটর ডেম কলেজে কলেজে ভর্তির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের অনেকেই নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছিল। আমি যথারীতি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে, মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, রেজিস্ট্রেশনের ফর্ম হাতে পেলাম। যতদূর মনে পড়ে গোলাপী রঙের একটা ফর্ম ছিল যেটাতে আমার যাবতীয় তথ্যের সন্নিবেশ ছিল। ফর্ম নিয়ে বাসায় আসলাম। আমার বাবা এইসব ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহী না বরং ভালই উৎসাহী ছিলেন। আর আমারো স্বপ্ন ছিল নটর ডেম কলেজে পড়বো। চান্স পেয়েছি। এখন রেজিস্ট্রেশনের পালা। আমি যে আমার স্বপ্নের একেবারে দোরগোড়ায় চলে এসেছি! তাই আমার বাবাকেই দিলাম ফর্মটা তুমিই পূরণ করে দাও। আমি পাশে বসে ছিলাম।

 

ফর্মের যেখানে বর্তমান ঠিকানা ছিল, সেখানে গিয়ে উনি আটকে গেলেন। আমার বাসা ছিল মিরপুর দশের সেনপাড়া তে। আর কলেজটা সেই মতিঝিলে! বেশ অনেক দূরের পথ। অবশ্য আমি পাবলিক বাসে যেতাম। দশ নাম্বার গোলচক্কর থেকে ডিরেক্ট (নামে আর কি) বাসে উঠতাম আর সেটাতে করে একদম শাপলা চত্বরে নেমে কলেজ পর্যন্ত সামান্য পথ হেঁটেই যেতাম। আমাদের সময় বাস ভাড়া ছিল ৭ টাকা! সেটাই মনে পড়ছে। যখন বর্তমান ঠিকানা লিখতে হবে, আমার বাবার মাথায় বিচিত্র এবং অদ্ভুত একটা চিন্তা ভর করলো। তৎকালীন একটা ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের সর্বেসর্বা হয়ে উনার মাথায় এই ধারণা কি করে হয়েছিল সেটা আমার আজও বোধগম্য না। উনার সেই ধারণার ফলে আমাকে কি খেসারত দিতে হয়েছিল সেটা বলাই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য।

 

উনি ধারণা করলেন, যদি বর্তমান ঠিকানায় মিরপুরের ঠিকানা দেয়া হয়, তাহলে এত দূরের পথ মনে করে যদি কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার ভর্তি বাতিল করে দেয়!!! যদি আমাকে আর সেই কলেজে পড়ার সুযোগ না দেয়? তাহলে কি হবে? (ব্যাপারটা অনেকটা এমন ছিল, দূরের থেকে এসে যেন কেউ নটর ডেম কলেজে পরতে পারবে না এমন কোন একটা নিয়ম উনারা করে রেখেছিল। নটর ডেম কলেজে শুধু পড়বে মতিঝিল আর আরাম বাগের ছেলেরাই)। উনি কথাটা বারংবার বলতে বলতে মাথার মধ্যে এমনভাবে ঢুকিয়ে দিল যে আমি আগুপিছু কিছু না চিন্তা করেই ভীত হয়ে গেলাম। হায় হায় এখন কি হবে? এই কলেজ হাতছাড়া হয়ে যাবে? এটা যে আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না! এখন? আমাকে সেই সময়ে এতটাই রেজাল্ট আর বই কেন্দ্রিক করে রাখা হয়েছিল যে আসলেই বাস্তবতার সাথে আমার কোন সম্পর্কই ছিল না। বড়রা যা বলবেন, বিশেষ করে আমার বাবা(!) সেটাই আমার কাছে একেবারে বেদবাক্যের মত ছিল। আর পুরা ফ্যামিলিকে উনি এমনভাবেই ডোমিনেট করে রাখতেন যে উনার উপরে আসলে কেউ কোন কথা বলতেই পারতো না। উনার সাথে কেউ কোন আর্গুমেন্ট করা মানেই হল এই ডায়লগ শোনা, ‘তোমরা কি আমার চেয়ে বেশী বুঝো? দুনিয়াদারির তোমরা কি দেখছ? আমরা মানুষ চরায়ে খাওয়া মানুষ। যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। আমি কিছু না বুঝে বলছি না’! এসব কথা পিতার মুখ থেকে বারংবার যেমন শুনতে ইচ্ছা করতো না, এমনি এই জাতীয় কথা বলার পরে বস্তুত আমাদের বলার কিছু থাকতো না।

 

তা কি করা যায়? মিরপুরের ঠিকানা তো দেয়া যাচ্ছে না। যদি(!) আমাকে ভর্তি না করে! সম্পূর্ণ এই ধারণা যা উনার একক ছিল, এর বশবর্তী হয়ে উনি অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমার বড় ফুফুর  বাসার ঠিকানা দিয়ে দিবেন বলে মনস্থ করলেন। বড় ফুপুর বাসা ছিল শান্তিবাগে। কলেজ থেকে কাছেই। বাসে যাওয়া যেত। উনি বড় ফুফুর বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলেন বর্তমান ঠিকানায়। আমি ফর্ম জমা দিয়ে দিলাম। এরপরে ক্লাস শুরু হল। যখন আমার হাতে ক্লাসের রুটিন ধরায়ে দিল তখন আমার মাথায় বজ্রপাত হল। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শেষ হতো বেলা ১২ টার দিকে আর আমার ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল এর টাইম দেয়া হল বেলা ৩.৩০ টা। একেক গ্রুপের ফাইলের রঙ আলাদা ছিল, ক্লাসে তাদের বসার জায়গায় নির্দিষ্ট ছিল। আমি যেই গ্রুপে পড়লাম, আমাদের ফিজিক্স ফাইলের রঙ গোলাপি। আমাদের সময় হল দিনের শেষ ব্যাচ টা। ৩.৩০ থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল। আমি কোন কূল কিনারা করতে পারলাম না। কিভাবে সম্ভব? আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু রেজাও আমার সেকশনেই পড়তো। ওর বাসা রায়ের বাজার মনেশ্বর রোড এ। ও ওর ঠিকানা ঠিকমতই দিয়েছিল। ফলে দূরের ছাত্র হওয়ার ওর প্র্যাকটিকালের সময় পড়েছিল ১২.৩০ টা থেকে। অর্থাৎ ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথেই বলতে গেলে। ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথেই রেজা ওর গ্রপের সাথে গিয়ে লাইনে দাঁড়াত। আমার তাকায়ে দেখা ছাড়া আর উপায় কি? আমি ত আমার বাবার সর্বংসহা ভাল ছেলে! যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যই হল ভাল রেজাল্ট। যেন শৈশব কৈশোরে ভাল রেজাল্ট ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

 

বাসায় এসে যখন বললাম, তখন আমার বাবা ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, আল্লাহ! এমন কেন করলো! তোমাকে তো সাড়ে তিন ঘন্টা এখন বসে থাকতে হবে। কি আর করবা একটু সবর কর। ভাল কিছু পেতে হলে একটু কষ্ট তো করতে হয়ই। আমার মা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কাছে কিছু টাকা রেখো, ক্যান্টিন থেকে কিছু কিনে টিনে খেয়ে নিও। ব্যস হয়ে গেল আমার সময় ক্ষেপনের উত্তম এক সমাধান! আমি সর্বংসহা। আমাকে যা দেয়া হয়ে সেটা অম্লান মুখে মেনেই নেই। ভাল ছেলে হতে হবে যে। ভাল ছেলে তো তারাই, যাদের কে বাপ-মা যা বলবে, তাই অক্ষরে অক্ষরে তারা মেনে নিবে। কোথাও তাদের কোন মতামত থাকতেই পারে না। আমার আভ্যন্তরীন ট্রেনিং সেভাবেই ছিল, আমি ভাল ছেলে! আদর্শ ছেলে! আমার বাবা আবার আমাকে পরামর্শ দিলেন, অফিসে কথা বলে দেখতে পার। উনারা তাহলে চেঞ্জ করে দিতে পারে। আমি আশায় বুক বাঁধলাম! হয়ত হবে।

 

একদিন বুকে অনেক অনেক সাহস সঞ্চয় করে গেলাম ডীরেক্টর অভ স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স এর অফিসে প্রফেসর টেরেন্স পিনেরো’র রুমে। নটর ডেমে কলেজের যারা উনাকে চেনে, তারা এক বাক্যে উনাকে নটর ডেমে কলেজের বাঘ বলেই জানে। উনার উপস্থিতি টের পেলে, ছাত্রদের মধ্যে পিন পতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করতো। এমনই একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন আমাদের টেরেন্স পিনেরো স্যার। অনেক সাহস সঞ্চয় করে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার হৃতপিন্ডটা তখন আক্ষরিক অর্থেই মনে হয় আমার গলার কাছে উঠে এসেছিল। আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, ইয়েস? উনার সাথে ইংলিশে কথা বার্তা চলতো। উনি নিজে ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। আমি বললাম, স্যার আমার ফিজিক্স ল্যাবের গ্রুপ চেঞ্জ করা কি পসিবল হবে? আমার টাইমিং এর সমস্যা হচ্ছে। উনি এক কথায় সুন্দর করে জানিয়ে দিলেন, এটা সম্ভব নয় কারণ তোমাদের গ্রুপগুলো ঠিক করা হয়েছে তোমাদের বাসার লোকেশন দেখে। আমি স্যারকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল আমার ল্যাব কেন ৩.৩০ থেকে দেয়া হয়েছে। বাসায় এসে জানালাম, আমার বর্তমান ঠিকানা শান্তিবাগ দেয়ার জন্যই আমার জীবনে এই অশান্তি নেমে এসেছে। আমার পিতা এর একটা সমাধান খুঁজে বের করে আমার জীবন ধন্য করে দিলেন! বললেন, কলেজ ছুটির পরে ঐদিন তুমি তোমার ফুফুর বাসায় চলে যাবা। ওখান থেকে খেয়ে দেয়ে রেস্ট নিয়ে, এরপর আবার কলেজে চলে আসবা! আমি সমাধান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! কারণ আমি যে একটা ভাল এবং আদর্শ ছেলে! আমাকে যা বলা হবে সেটা মেনে নেয়াই তো আমার কাজ। তাতে আমার সময় কোন ব্যাপার না! সারাদিন কলেজে থাকলেই বা কি? পাঁচটার পরে প্র্যাকটিক্যাল করে বিবেক বেলার বাসের ভিড় সামলে বাসায় আসতে আসতে সন্ধ্যা ৭ টা বেজে যেত!

 

পিতার দেয়া সমাধানানুসারে আমি যেতে লাগলাম ফুফু বাসায়। ফুফুর আদর আপ্যায়ন এখনও মনে পড়ে। আমার জন্য খাবার রেডী করে রাখতেন। আমি গোসল করে খেয়ে এরপর আবার কলেজে চলে আসতাম। মাঝে মাঝে যেতে যেদিন মন চাইতো না, সেদিন কলেজেই ঘুরে বেড়াতাম। ক্যান্টিন থেকে সিঙ্গাড়া বা অন্য কোন খাবার খেয়ে কলেজের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে শুয়ে থাকতাম। এভাবেই গেল আমার ফার্স্ট ইয়ার। সেকেন্ড ইয়ারের কাহিনি আলাদা! তখন যেহেতু বিকালে ক্লাস হত তাই ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল হত সকাল বেলা এবং সকালের প্রথম ব্যাচটাই থাকতো আমাদের! বুঝতে পারছেন তো আমার অবস্থা? সকালে সবার আগে প্র্যাকটিক্যাল করে, ক্লাস শুরুর আগে যে বিশাল লম্বা সময় থাকতো, তাতে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আমার আর করার কিছু থাকতোনা! এভাবেই কেটেছে আমার নটর ডেম কলেজের সময়টা। কারণ আমার বাসা শান্তিবাগ(!) যে! কাগজে কলমে! আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কি জানেন এই ঘটনা থেকে? কারো উপরে অন্ধ বিশ্বাস করা উচিত না। কেউ আমার জন্য কিছু করে দিবে, জীবনের কখনও সেই ভরসায় থাকা উচিত না। যদিও তেমন ভুল আমি বারবার এ করেছি। সেই গল্প ভিন্ন। সামনে আসবে তার কিছু কিছু আমার যখন যেটা মনে পড়ে।  

 

 

View shawon1982's Full Portfolio