‘ময়ুরের পাখনা’ বা পালকের অংশ বিশেষ নিয়ে, সেই ক্লাস ফাইভে যখন পড়ি তখন, অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে, একটা কুসংস্কার খুব জোরে সোরে শুনেছিলাম। আমার কয়েকজন ক্লাসমেট এর কাছে শুনেছিলাম। একজন আমাকে বইয়ের ভেতর থেকে একটা extra ময়ুরের পাখনা বের করে দিল। বললো, এইটা তুই নিয়ে যা, বাসায় গিয়ে কোরান শরীফের ভিতর রাখিস। এর ভেতর থেকে বাচ্চা হবে। আমি নিতান্তই টাশকি খেলাম! কি! একটা ময়ুরের পাখার আবার বাচ্চাও হয় নাকি? কয়েকজন সমস্বরে বললো হয়। উত্তেজনায় আমি অস্থির হয়ে গেলাম। বন্ধুর দেয়া ময়ুরের পাখনার টুকরাটা বইয়ের ভেতরে রেখে দিলাম। কাইউম নামের একজনের ততক্ষণাৎ একটা প্রমাণ দিল। সে তার বই থেকে একটা পাখনা বের করলো। মূলত সেটা ভাঙ্গা ছিল। ছোট ভাঙ্গা অংশটাকে দেখিয়ে আমাকে বললো, এই দেখ বাচ্চা বের হচ্ছে। আমি কোথাও পালকের বাচ্চা খুঁজে পেলাম না। বললাম, কই বাচ্চা? ও আবার ভাঙ্গা ছোটো অংশটা যেটা মূল অংশের সাথে ঝুলেছিল, আমাকে আবার দেখিয়ে বললো, এই যে দেখ, এটাই বাচ্চা। বাচ্চা বের হয়ে আসছে। একদম Normal Delivery চলছে। আহা! আমার মনের বিরুদ্ধেও মেনে নিলাম, তাহলে সত্যিই ময়ুরের পাখনা থেকে বাচ্চা হয়।
বাসায় এসে আম্মুকে জানালাম ঘটনা। উনিও বললেন, হ্যা হয় তো। আমরাও ছোটবেলায় ময়ুরের পাখনা কোরান শরীফের ভেতরে রাখতাম। আমার বিশ্বাস আরো দ্রবীভুত হয়ে গেল। আব্বু বিশ্বাস করলো না। আমি বারংবার বলাতে কিছুই বললো না। পরেরদিন আমাদের বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং চলছে স্কুলে। তখন আশরাফ আমাকে তার বইয়ের ভেতর থেকে একটা ছেঁড়া ময়ুরের পালক দেখালো। সেখানে যমজ বাচ্চা ডেলিভারী চলছে। মূল পালক থেকে এর লম্বা লম্বা অংশগুলো টেনে ছিড়লে, ছেঁড়া অংশে যে সাদা কাগজের মত অংশ থাকে সেখানে দেখলাম ছোট ছোট দুইটা পালক। অর্থাৎ বড় পালকের দুইটা যমজ বাচ্চা হচ্ছে। আশরাফ খুব ভাবের সাথে পালকটা আবার নিজের বইয়ের ভেতরে রেখে দিল। আমার মনে মনে খুব হিংসা হতে লাগলো। ইশ! আমার যদি এমন একটা যমজ বাচ্চাওয়ালা পালক থাকতো।
এর কিছুদিন পরে আমার চিড়িয়াখানায় ঘোরার সুযোগ হয়েছিল। ওখান থেকে যখন বের হয়ে আসবো, তখন দেখি এক লোক বড় এক বান্ডেল ময়ুরের পালক বিক্রি করছে। পাঁচ টাকা করে দাম। আমি গোটা দুয়েক কিনে নিলাম। বাসায় এসে সন্ধ্যার পরে আমি পালক ছিঁড়তে শুরু করলাম। দেখলাম বাহ, নিচের থেকে ছিঁড়লে সাদা অংশটা বের হয়ে আসছে। কয়েকটা ছেড়ার পরে মনে হল, একটা বাদ দিয়ে আরেকটা উপরের থেকে ছিঁড়ি তো। ছিঁড়েই পেয়ে গেলাম ম্যাজিক। উপরেরটা নিচেরটা সহ ছিঁড়ে আসছে। তৎক্ষণাৎ আমার কাছে পালকের বাচ্চার রহস্য আর আশরাফের পালকের যমজ বাচ্চার রহস্য একদম পরিস্কার হয়ে গেল। এভাবেই তাহলে ময়ুরের পালক বাচ্চা পয়দা করছে! পরেরদিন কোচিং এ গিয়ে আমি আশরাফকে দেখালাম এই দেখ, আমার কাছেও বাচ্চা দেয়া পালক আছে। ও হাতে নিয়ে দেখলো। এখানে আমি একটা মা পালকের সাথে বেশ কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে হাজির হলাম রাতারাতি। আশরাফ দেখে ভিলেন মার্কা একটা হাসি দিয়ে বললো, উপরের থেকে ছিঁড়সিস তাই না? আমি বললাম হ্যা, এই তো বাচ্চা পেয়ে গেলাম। তুই এভাবে পাস নি? ও তখন স্বীকার করলো ওর যমজ বাচ্চাও এভাবেই এসেছে। পুরাটাই একটা ভুয়া জোচ্চোরি কুসংস্কার যা বাচ্চাদের কে শেখানো হত যে ‘ময়ুরের পাখনা থেকে বাচ্চা হয়’। অনেক বড় মানুষও মনে মনে এই ভয়ঙ্কর কুসংস্কার লালন করে চলেছে বছরের পর বছর।
এখন এই করোনার যুগে, মানুষের আতঙ্ক আর ধর্মান্ধতাকে কাজে লাগিয়ে, এক শ্রেণীর নোংরা চরিত্রের মানুষ এক ভয়ঙ্কর খেলায় লিপ্ত। কিছুদিন আগে আমি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পল্লীগীতির একটা বই দেখছিলাম। তখন দুইজন পাশে দাঁড়ানোর লোকের কথাবার্তা শুনলাম। মিরপুর ৬ নাম্বারে নাকি কোরাণ শরীফের ভেতর থেকে ‘চুল’ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই দেখেছে। কোরান খুললেই চুল পাচ্ছে। অন্যজন শুনে উড়িয়ে দিল। আমি বললাম, ভাই তেলাওয়াত করার সময় হয়ত মাথা থেকে বা দাঁড়ি থেকে একটা পশম পড়েছে, এরপর সেই জায়গা খুলে চুলটা পাওয়া গেছে। এতে এত অবাক হবার কি আছে? ওইদিনের ঘটনা ওই পর্যন্তই। ঘটনা আমি ভুলেই গেছিলাম। গতকাল আমার স্ত্রীর কথায় আবার উঠে আসল।
এই করোনার আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে, পীর সাহেব ‘থানকুনি’ পাতা স্বপ্নে দেখলেন! সেটি খেলে করোনা সেরে যাবে, মরে যাবে ভাইরাস আরো কত কিছু! আরেকজন এলেন স্বপ্নে পাওয়া সাক্ষাৎকার থিওরি নিয়ে। ভাইরাস একজন ইতালী প্রবাসী বাঙ্গালিকে করোনার কারণ আর সেটার প্রতিকার হিসেবে একটা গাণিতিক সমীকরন(!) দিয়েছে। মাওলানা(!) সাহেব সেই সমীকরণ সমাধান করেছেন কিন্তু উনি বলবেন বা! বেশ বেশ! মানুষকে ছাগল বানানোর কি অপূর্ব কৌশল! ধর্মীয় গুরুরা মানুষের ধর্মের আবেগ আর ধর্মান্ধতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের সুনাম আর কাটতি বাড়াচ্ছেন। যত ওয়াজ, তত টাকা! কে কার চেয়ে কত বেশী পপুলার হতে পারেন। কি নোংরা মানসিকতা আর কি নোংরা রাজনীতি মানুষের এই কষ্টের সময়ে। তাও কিছু সো কল্ড ধর্মীয় গুরু(!) দ্বারা। ভারতে তো চলছে, গরুর পেশাপ খাওয়ার ব্যাপার স্যাপার! বেশী করে গরুর পেশাপ খেলে করোণা আক্রমন করতেই পারবে না! কি সুন্দর ভ্যাক্সিন!
আমার স্ত্রী আমাকে জানালো, কিছুদিন আগে আমার শাশুড়িকে কয়েকজন পাড়ার মহিলা এসে বলেছেন, কোরানের ভেতর নবীজীর চুল (নাউযুবিল্লাহ) পাওয়া যাচ্ছে। এটা ভিজিয়ে খেলে করোনা সেরে যাবে। কোন যুগে বাস করছি আমরা? নবীজীর শরীরের পশম বা চুল, বাংলাদেশের মিরপুরের কোরানে কোরানে পাওয়া যাচ্ছে? ভন্ডামির একটা সীমা আছে। আর অশিক্ষিত কুশিক্ষিত মানুষ হয়ত হুমড়ি খেয়ে পড়েছে কোন না কোন পীরের কাছে যদি সেখানে একটা পবিত্র চুল পাওয়া যায়!
মানুষের মধ্যে শিক্ষা কবে আসবে? কবে বোধদয় হবে মানুষের? এই আধুনিক শতাব্দীতে এসেও মানুষ ধর্মীয় গোড়ামি আর কুসংস্কার থেকে বের হতে পারছে না? তাহলে কিসে ডিজিটাল আর কিসে আধুনিক হচ্ছি আমরা? ধর্মীয় গুরুরা যারা সাধারণ মানুষের অগাধ বিশ্বাস কে কাজে লাগিয়ে তাদের ইমান-আকিদা সব কিছু ধ্বংসের পেছনে লেগে গেছেন, আমার প্রশ্ন হল কেন? কি লাভ তাদের মানুষকে এভাবে নোংরামির আর ভ্রান্ত বিশ্বাসের পথে এগিয়ে নিয়ে? ধর্মীয় গুরুরা কোথায় মানুষকে আলোর পথ দেখাবেন, সেখানে তারা আছেন নিজেদের আখের গোছাতে আর মানুষের বিশ্বাস কে পুঁজি করে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে? ইমান আকিদা সব নষ্ট করে দিয়ে? করোনা নয়, বরং এগুলাই সমাজের সবচেয়ে বড় ভাইরাস। এদেরকেই সমাজ থেকে, সংস্কার থেকে চিরতরে দূরীভূত করা হোক। মানুষ মুক্তি পাক সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা থেকে।