৪ মার্চ ২০২০

মাঝে মাঝে পুরনোকে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। নতুন করে দেখতে ইচ্ছে করে সেই পুরনো অনুভুতিগুলো ফেরত আসে কিনা সেটা দেখতে। ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসের কথা মনে পড়ে। কি যে হল আমার! ধারাবাহিক জনপ্রিয় নাটক ৬৯ এর ১০০ পর্ব আমি আমার সিঙ্গাপুরের ল্যাবরেটরীতে বসে একসাথে দেখেছিলাম। একদিন একরাত সম্পূর্ণ অতিক্রম করে পরেরদিন সকাল পর্যন্ত একটানা দেখেছিলাম। কি অদ্ভুত উন্মাদনা কাজ করেছিল। একটা উইকেন্ডে এসে এই কাজ করেছিলাম। তখন আমার বাসা আমাদের ভার্সিটির কাছেই ছিল। এক তামিল পরিবারের সাথে উনাদের একরুমে ভাড়া থাকতাম। উনাদের পদবী ছিল ‘পনমুদি’। বাড়ীওয়ালিকে আন্টি ডাকতাম। মনখোলা অমায়িক মহিলা ছিলেন। তামিল সিনেমা দেখতেন সারাদিন আর যখন গান বাজতো, তখন আন্টি নিজেও সেই গান মাঝে মাঝে গাইতে থাকতেন। বিয়ের পরে আমার স্ত্রী যখন প্রথম সিঙ্গাপুর বেড়াতে গেল, তখন ওকেও নিয়ে গিয়েছিলাম আন্টির সাথে দেখা করাতে।

 

টানা একদিন একরাত নাটক দেখে, আমি দেখি আমার আর শরীর চলছে না। কেমন যেন অবশ অবশ লাগছে। এখন বাসায় গিয়ে না ঘুমালে আর উপায় নেই। তখনও আমাদের কোর্স ওয়ার্ক চলছিল। গবেষণা কিছুই করি না তেমন। টলতে টলতে বাসায় আসলাম। প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে। বাসার নিচে পাশেই একটা ফুড কোর্ট ছিল। ওখানে এক মালেশিয়ান দোকান থেকে ভাত আর গরুর মাংশের মিষ্টি একটা ভুনা নিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। এরপর বাসায় গিয়ে ধপাস করে বিছানায় পড়েই ঘুম! কতক্ষণ যে ঘুমালাম বেহুশের মত! পড়ন্ত বিকেলে গিয়ে ঘুম ভাংলো। সারা গা দেখি কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছিল। সারা শরীর মনে অবসাদ! কি করবো না করবো কিছুই ভেবে পাই না। আমার তৎকালীন রুমমেট ডঃ হেদায়েত ভাই ছিলেন কোলকাতার মানুষ। রুমে ঘুমালে নিতান্তই রাতে দেখা হত উনার সাথে। উনি অন্য ডিপার্টমেন্ট এর ছাত্র ছিলেন। দারুণ কর্মঠ মিষ্টিভাষী একজন ভাল মানুষ ছিলেন হেদায়েত ভাই। সিগাপুরের পরে আর উনার সাথে দেখা হয়নি। উনার পুরো নাম ছিল মীর মোহাম্মদ হেদায়েতুল্লাহ। দেখি আবার যোগাযোগ করতে হবে হেদায়েত ভাইর সাথে। উনার সাথে আমি মালেশিয়ার জোহার বাহরু তেও গিয়েছি। সেটা ২০০৮ এর মে মাসের কথা।

 

ঐ সময়েই কি করবো না করবো চিন্তা করতে করতে লাগেজ খুলে বের করলাম সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস ‘গর্ভধারিনী’। পড়েও ফেললাম। আমার সবসময় অভ্যাস হল, খাটে যদি বই পড়ি, শুয়ে শুয়ে বই পড়া আর ঘুম এসে গেলে বইকে বালিশের পাশে রেখে শুয়ে পড়ি। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাতিয়ে হাতিয়ে দেখি বইটা ঠিকমত আছে তো! তেমনই পাশে রেখেছিলাম। গর্ভধারিনী পড়ছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মত কাহিনী। ওমা কোত্থেকে দেখলাম সিঙ্গাপুরের ত্রাস একটা বের হয়ে এসে আমার বইয়ের পাতার উপরে দৌড়া দৌড়ি করছে। সিঙ্গাপুরের ত্রাস হল ‘ছারপোকা’! যেই নামটা শুনলে আমি এখনও আতকে উঠি। ছারপোকা আমাকে যে কি জ্বালান জ্বালিয়েছে কিছুদিন আন্টির বাসায় সেটা বলার মত না।

 

২০১০ এর মার্চের দিকে আন্টিরা সরকারের থেকে নতুন বাসা পায় অদূরেই। আমিও উঠে যাই উনাদের সাথে উনাদের নতুন বাসায়। তখন ছারপোকা থেকে মুক্তি পাই। যাই হোক, একটা ঢাউস সাইজের ছারপোকা এসে তুরতুর করে দৌড়ে আমার ধরার আগেই মলাটের ভেতরে একেবারে বাধাইয়ের ভেতরে ঢুকে গেল। এই যে ঝাকাঝাকি করলাম আর বের হল না। কিন্তু আমি যে ওটাকে দেখে ফেলেছি! আমার জানের দুশমন! ওটাকে না মেরে ফেললে তো আমার দিন রাত কিছুই কাটবে না! আমি ঐ বইয়ের যেদিকে পোকাটা ঢুকেছিল, সেদিকে বইটা বিয়ে গায়ের শক্তি দিয়ে দুমদুম করে দেয়ালের দিকে পিটাতে থাকলাম। গোটা কয়েক বাড়ি দিলাম। এরপর ঝাকি দিতেই সেই সন্ত্রাসীর লাশ বের হয়ে আসলো। এরপর আমার শান্তি। টানা দুই তিনদিন পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম উপন্যাসটা। যদিও কিছুই মনে নেই। আবার পড়তে হবে।

 

গর্ভধারিনী শেষ হলে শুরু করেছিলাম সমরেশ মজুমদারেরই বিখ্যাত উপন্যাস-ত্রয়ী “উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ” এর সমন্বিত উপন্যাস সঙ্কলন “ত্রিরত্ন”। এক মলাটের ভেতরেই তিনটি বই। মোটাসোটা উপন্যাস আমার পাঠিতব্য বইয়ের ভেতর সবসময় প্রিয়র তালিকায় শীর্ষে থাকে। শুয়ে বসে, নানা ভাবে পড়তে লাগলাম বইটি। একসময় শেষ ও করে ফেললাম। সিঙ্গাপুর থেকে একদম চলে আসার সময় ওজনের কারণে বইটি আনতে পারিনি। এজন্য দেশে এসে ত্রিরত্নের আরেকটি কপি নীলক্ষেত থেকে কিনে নিয়েছিলাম।

 

এই উপন্যাস সঙ্কলনের জন্য আমার মন এখনও দুর্বল। তাইতো ১১ বছর পর আবার শুরু করলাম। তবে এখানে নতুন একটু উপলক্ষ্য যোগ হয়েছে। সমরেশ মজুমদার সম্প্রতি বইটির চতুর্থ খন্ড “মৌষলকাল” লিখেছেন। এখন শুধু চতুর্থ খন্ড পড়লে যদি আগের মত মজা না পাই? তাই আবার শুরু করতে চাচ্ছি সমগ্র উপাখ্যান একসাথে। ১৫০০ পৃষ্ঠার এক সুদীর্ঘ বই। বই পড়তে পড়তে হারিয়ে যাই এক অন্য জগতে। যে জগতে কেউ অন্তত আমার দোষ খুজতে আসবে না বা আমার সাথে অযাচিত কারণে সম্পর্কের ইতি টানতে আসবে না। বাস্তব জগতের চাইতে তাই আমার এই উপন্যাসের জগতটাই ভাল।

View shawon1982's Full Portfolio