স্মৃতিকে ধরে রাখার একটা অদ্ভুত প্রবনতা আমার মধ্যে কাজ করে সেই অনেক আগে থেকেই। কেউ কিছু আমাকে দিলে সেটা যথাসাধ্য সংরক্ষণ করতে চেষ্টা করি। তবে সব কিছু যে পেরেছি সে দাবী করা আমার জন্য নিতান্তই অমূলক। অনেক কিছু হয়তো পারিনি। অগোচরে হারিয়ে গেছে। কিছু আছে। যেগুলো আছে চেষ্টা করছি সেগুলো যেন হারিয়ে না যায়। তবুও কিছু হয়ত হারায়, কিছু থেকে যায়। আমার অনেকগুলো বাতিক আছে। সেগুলো বাতিক বলাই ভাল। যেগুলো নতুন নতুন করে উদ্ভব হয় এবং অনেকটা শখের পর্যায়ে চলে যায় আর আমি সযতনে লালন করতে থাকি সেগুলো। পুরনো দিনের কিছু জমিয়ে রেখে সেগুলো যখন দেখি তখন সেই পুরনো দিনের স্মৃতি মনের ভেতর তাজা হয়ে ওঠে।
আমার এক মামাতো বোন এর কাছ থেকে একবার একটা আকিক পাথর পেয়েছিলাম। বেশ সুন্দর। হলুদ রঙ এর কিন্তু এক কোনায় মেঘের মত বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে সাদা রঙ এর। কারণ তখন থেকে আমার আকিক পাথরের আংটি পরার একটা প্রবনতা ছিল। আকিক (Agate Stone) পাথরের আংটি পরতে আমি এখনও অনেক পছন্দ করি। আমি কোন জ্যোতিষীর কথায় বিশ্বাস করি না। পাথর পরলে আমার কোন উন্নতি হয়ে যাবে সেটাও একদমই বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি আমার ভাগ্য নিয়ন্তা একমাত্র আমার স্রষ্টা। কোন পার্থিব বস্তু আমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ বা আমার ভাল মন্দের নিয়ন্তা হতে পারে না। আমি আকিক পাথর পছন্দ করি এর বহুবিধ রঙের জন্য। দেখতে সুন্দর লাগে এজন্য।
আমার সেই মামাতো বোন আমাকে পাথরটা দিয়ে বলেছিল, এটা দাদা হজ্জে গিয়ে এনেছিল। ওর দাদা মানে আমার নানা যিনি ১৯৮৩ সালের ২১শে জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেণ যখন আমার বয়স মাত্র সাড়ে ৭ মাসের মত! সেই পাথরটা হাতে নেয়ার পরে আমার মনে হল, এটা নানার স্মৃতি। পাথরটা খুব সযতনে রেখে দিলাম। পরে খুলনা থেকে ঢাকা এসে সেটা দিয়ে রূপার একটা আংটি বানিয়ে ডান হাতের অনামিকায় পরতাম। অনেকদিন আংটি আকারে পরেছি। পরে কি মনে হল, আংটি থেকে পাথরটা খুলে বের করে সেটা একটা লকেটে (Pendant) বসিয়ে তা দিয়ে রুপার একটা ‘বুকমার্ক’ বানিয়ে ফেললাম! আমার ভীষণ প্রিয় রুপার তৈরী বুকমার্ক। নানার আনা সেই পাথর এখন আমার বুকমার্কের সাথে শোভা পাচ্ছে। যখনই কোন বই পড়ি, সেটা আমার হাতেই থাকে। রুপার তৈরী এই বুকমার্কটা আমার ভীষণ প্রিয় এবং এটাকে ইচ্ছা করলে আমার জীবনের একটা সামান্য বিলাসিতা বলতে পারেন। যে পেন্ডান্ট এর উপরে আমি পাথরটা বসিয়েছি, সেটা আবার মহানবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর পাদুকা’র নকশার আকৃতিতে করা।
এইতো মাস দুয়েক আগে আমার অন্য এক মামাতো বোন উমরা করতে সপরিবারে সৌদি-আরবে গেল। মেসেঞ্জারে আমি ওর কাছে বায়না করলাম, আমার জন্য একটা পাথর নিয়ে এসো। আকিক পাথর! ও এনেও দিল। ভীষণ সুন্দর একটা পাথর। ভেতরে পাহাড়ের মত উচু নীচু রেখা। সেটা দিয়ে আংটি বানিয়ে রেখেছি। মাঝে মাঝে পরি। থাকুক আমার বোনের দেয়া এই পাথর স্মৃতি হয়ে। এই আধুনিক যুগে যেখানে ছবি, ভিডিওর ছড়াছড়ি, সেখানে আমি এর ওর কাছ থেকে পাথর চেয়ে নেই! ওরই ছোট বোন, অর্থাৎ আমার আরেক মামাতো বোন কোলকাতা গেল। তাকেও বলেছি আমাকে পাথর এনে দিও। দিয়েছে আমাকে খুব সুন্দর একটা টাইগার-স্টোন এনে। ভীষণ সুন্দর সেই পাথর। ঘুরালে কখনও হলুদ আবার কখনও কালো রঙের খেলা।
এই স্মৃতি জমিয়ে রাখা নিয়ে আমার একটা দুঃখের স্মৃতি আছে। মাত্র যেই মামাতো বোনের কথা শুনলেন, আমাকে কিছুদিন আগে টাইগার স্টোন এনে দিয়েছে? ওর বিয়ের সময়কার কথা ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে। আমার বৃত্তি পরীক্ষার ঠিক সাথে সাথে। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম পরীক্ষা দিতে। যেদিন আসি, সেদিনই ওর গায়ে হলুদ ছিল শ্যামলীতে আমার বড় খালার বাসায়। হলুদের তত্ত্বে যে সব জিনিস দেয় তার মধ্যে একটা মাটির প্রদীপ ছিল। সেদিন ঐ মাটির প্রদীপটা জ্বালানো হয়েছিল। হলুদের অনুষ্ঠান যখন শেষ হল, আমি কি মনে করে সেই মাটির প্রদীপটা আমার কাছে নিয়ে রাখলাম। সেই ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সেই মাটির প্রদীপ আমার সাথেই ছিল। আমাদের টিনের বাসা, সেখান থেকে ভাড়া বাসা, এরপর আবার ফ্ল্যাটে ওঠা- কোন পরিবর্তনেই সে মাটির প্রদীপ আমার থেকে আলাদা হয় নাই। আমি অনেককেই দেখিয়ে বলেছি, এটা আমার ঐ মামাতো বোনের বিয়ের স্মৃতি। ওর মেয়েকেও দেখিয়েছি। আমাদের বাসার শো-কেসে সাজানো থাকতো প্রদীপটা।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে কি করে যেন আমার মেয়ে পেয়ে যায় সেই প্রদীপটা। আমিও বাসায় ছিলাম না। কেউ খেয়াল করে নি। ও খেলতে খেলতে ভেঙ্গে ফেলে সেই প্রদীপটা। দুই টুকরা হয়ে যায়। আমি সেটা দেখে কতখানি কষ্ট পেয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। পরে দুইটা ভাঙ্গা টুকরাই রেখে দিলাম। এরপর দুই মাস পরে, আমার সেই দুলাভাই অকালে আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন। আমার এই ভগ্নিপতি ছিলেন আমাদের বিয়ের ঘটক কারণ আমার স্ত্রী উনারই আপন ভাগনি। আমি কোন সংস্কার বা চিহ্নে বিশ্বাসী নই। তবুও উনি যখন মারা গেলেন, কেন যেন আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, মাত্র দুই মাস আগেই উনারই বিয়ের স্মৃতির সাথে জড়িত মাটির প্রদীপটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। এই স্মৃতি জমিয়ে রাখা নিয়ে পরে হয়ত আরো কিছু লিখবো। আজ আর কোন কিছু লিখতে কেন জানি ভাল লাগছে না।