মাছ খেতে আমি বরাবরই পছন্দ করি। সেটা ছোট মাছ হোক আর বড় মাছ হোক। তবে বড় মাছ একটু বেশী পছন্দ। বিশেষ করে রুই আর কাতলা মাছ আমার বেশী পছন্দ। বড় মাছ বেশী পছন্দ হবার কারণ হল, এর কাটাগুলা বড় বড়ো থাকে, বেছে বের করা সহজ হয়ে যায় আর সবচেয়ে বেশী সুস্বাদু লাগে মাছের মাথাটা। বড় মাছের আস্ত মাথার খাবার মজাই আলাদা। আমার এই পছন্দের কথা আমার বাসা এবং শশুরবাড়ির সবাই জানে বিধায়, এই দুই জায়গায় বড় মাছ রান্না হলেই মাথা আমার জন্য বরাদ্দ করা থাকে। আমার শশুর সাহেব নিজেও মাছের মাথা খতে পছন্দ করেন কিন্তু উনার সাথে যদি আমি খেতে বসি তাহলে উনার কঠিন নির্দেশ থাকে, মাথা যেন উনাকে না বরং আমাকে দেয়া হয়।
মাছের মাথা আমি খাওয়া শিখেছিলাম আমার বাবার কাছ থেকে যখন সৌদি-আরবে থাকতাম তখন। উনি যখন মাছের মাথা খেতেন তখন আমাকে পাশে বসিয়ে এটা ওটা বলে বলে খাওয়াতেন। প্রথমে খেতে চাইতাম না। পরে উনি বলে বলে খাওয়াতেন। বড় মাছের মাথা থেকে চোখ খুলে আমার মুখে দিতেন। আমি খেয়ে দেখলাম ভালই তো লাগে! এরপর মাথার উপরের হাড় সরিয়ে আমার মুখে দিয়ে বলতেন, টান দাও! আমি টান দিয়ে মাছের মগজ খেয়ে নিতাম! এভাবেই আমার মাছের মাথার প্রতি ভাললাগা জন্মে ওঠে। মাছের চোখ যেহেতু খাওয়া যায়, তাই আমার মনে হল, মুরগীর চোখ(!) ও বুঝি মানুষ খায়! পরে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, মাছের চোখ আর মুরগীর চোখ এক জিনিস না! ওটা আমরা খাই না। সেই থেকে মাছের মাথা খাওয়ার এমন অভ্যাস হয়ে গেল যে, বাজার থেকে মাছ কাটিয়ে আনলেও আমার স্পষ্ট নির্দেশনা থাকে, মাছের মাথা সম্পূর্ণ আস্ত থাকতে হবে। মাছের ঠোঁটও কাঁটা যাবে না। পরে সেটাকে হয় ভুনা করে খাই, না হয় মাছের মাথার মুড়িঘন্ট করে খাই। আমাদের বাসায় আমার মা আর আমার শাশুড়ি দু’জনেই মুড়িঘন্ট করেন। কিন্তু দু’জনের রন্ধন শৈলী ভিন্ন আর স্বাদও ভিন্নতর। আমার মা মুড়িঘন্ট করেন মুগ-ডাল দিয়ে আর সাথে নারিকেলের দুধ মিশিয়ে। খেতে কিছুটা মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ লাগে। পোলাও বা ভাতের সাথে অনবদ্য। আর আমার শাশুড়ি মুড়িঘন্ট করেন মাশকলাইর ডাল দিয়ে। উনারা দুধ ব্যবহার করেন না, স্বাদ কিছুটা ঝাল ঝাল থাকে। দুইটা দুই ধরণের! দুই ধরণের মজা!
আমার মেয়েটাকে ওর ছোটবেলা থেকেই আমরা চেষ্টা করেছি যেন সব ধরণের খাবারের অভ্যাস গড়ে ওঠে। সেজন্য আমরা ওকে খুব ছোট থেকেই মাছ খাবার অভ্যাস গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। শুরু শুরুতে মাছকে ‘অন্য রকম চিকেন’ বলে বলে খাওয়াতে হত। এখন ‘ফিশ’ বললেও খায়। আপত্তি করে না বরং মেয়েটাও আমার মতই বড় মাছ খেতে পছন্দ করে। কিছুদিন যাবত আমি দেখছি আমার মেয়েটার মধ্যেও মাছের মাথা খাওয়ার ঝোঁক এসেছে। আমি যখনই মাছের মাথা নিয়ে বসি, মেয়েটা ছুটে চলে এসে আমাকে বলে, ‘বাবা! ব্রেন খাবো!’ এই বলেই পাখির ছানার মত মুখ ‘হা’ করে আমার সামনে দাঁড়ায় আর আঙ্গুল দিয়ে ওর ‘হা’ করা মুখের দিকে ইঙ্গিত করে! আমি শুরু করি মাছের গলার দিকের মাছ দিয়ে। এরপর মাছের চামড়া এগুলো একটু একটু করে দিতে থাকি আমার আমার পাখির ছানাটা খুব মজা নিয়ে খেতে থাকে। এরপর বলে, বাবা ব্রেন দাও! আমি তখন মাছের মাথার খুলি খুলে মাছের মগজ বের করে করে ওর মুখে তুলে দেই। ও খুব মজা নিয়ে নিয়ে খেতে থাকে। এভাবে আমার পাতে নেয়া মাছের মুড়োটা পুরোটাই আমার মেয়েকে খাইয়ে দেই। আমার আর খাওয়া হয় না কোন অংশ। আমি মাছের টুকরো দিয়ে খাওয়া সেরে নেই। কিন্তু মজার কথা কি জানেন? আমি নিজে মাছের মাথা খেয়ে যত খানিক তৃপ্তি পেতাম, তার চাইতে অনেক বেশী তৃপ্তি লাগে আমার মেয়ের আনন্দ সহকারে মাছের ‘ব্রেন’ খাওয়া দেখে। মেয়েটার অনেক অভ্যাসই আমার মত হয়েছে। ওর মাছের মাথা খাওয়া দেখি আর আমি চলে যাই আমার স্মৃতিময় সেই ১৯৮৮ সালে যখন আমিও আমার বাবার হাতে এইভাবেই মাছের মাথা খেতাম।