মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী! আমাদের জীবনের সবচাইতে বাস্তব সত্য হল মৃত্যু। ধনী, গরীব, ছোট, বড় সবাই যার কাছে একাকার হয়ে যায় সে হল মৃত্যু। এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে এক একটি ‘জীবন’ নামক অধ্যায়ের। কিছুদিন তার নিকট আত্মীয় স্বজন মনে রাখে হয়ত। এরপর আস্তে আস্তে সেই মানুষগুলোর স্মৃতিও কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যায়। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সব কিছু মনে রাখলেও মনে হয় মৃত্যুর ব্যাপারটা ভুলেই যাই। কারো অল্প বয়সে মৃত্যু হলে মনের ভেতর হাহাকার জেগে ওঠে, আহারে এত অল্প বয়সে চলে গেল হঠাৎ করে! অথচ এভাবে যে আমাকেও যে কোন সময় চলে যেতে হতে পারে, সে কথা মনে কি আসে? আমি যখন আমার নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করি, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, দুশ্চিন্তায়। তারপর কি হবে? আমার ঠিক মৃত্যুর পরেই কি হবে? আমার কতখানি কষ্ট হবে? এরপর কি? তারপর? তারপর?
২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে, নানুবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার নানু তখনও জীবিত ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, প্রবাস জীবনে পাড়ি জমাবার আগে উনার সাথে সাক্ষাৎ করে উনার দোয়া নিয়ে যাওয়া। যখন ঢাকা ফিরে আসছিলাম, তখন ফেরীতে অনেক ভিড় দেখলাম। যা হোক, ফেরীতে উঠার পরে বাসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে পাশেই দেখি একটা মটর সাইকেল কে কেন্দ্র করে তিনজন যুবক ছেলে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। পোষাক আশাক সুন্দর। মোটামুটি চোখে গেঁথে গেল দৃশ্যটা। ফেরী যখন ঘাটে ফিরলো, যেহেতু, মটর সাইকেল ছিল, তিনটা ছেলে সবার আগে বের হয়ে গেল। আমাদের বাস এর পালা যখন এলো তখন আস্তে আস্তে ঘাট পার হয়ে উপরে এসে বাস চলা শুরু করলো। জাস্ট কয়েক কিলোমিটার আসার পরেই দেখি রাস্তায় বিশাল জটলা! কি হয়েছে? মটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট করে, স্পট ডেড হয়ে গেছে তিনটা ছেলে। আমার নিঃশ্বাস বন্দ হয়ে আসছিল। মনের মধ্যে ধাক্কা দিলো, ওরা না তো? আমি জাস্ট জানালা দিয়ে কোন রকম মাথা বের করে তাকিয়েছি, সেই দৃশ্য ভোলার না, রক্তের সাথে মানুষের মাথার হলুদ মগজ রাস্তায় পিশে আছে আর মানুষের মাথার খুলির হাড্ডি উলটা করে কালো পিচের উপরে পরে আছে। সেই মটর সাইকেল, সেই তিনটা ছেলে! মাত্র চার পাঁচ মিনিট আগেও যাদের আমরা ফেরীতে দেখেছিলাম হেসে হেসে গল্প করছিল। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম! এ দৃশ্য দেখা যায় না! নাম না জানা সেই ছেলেগুলো, হারায়ে গেল চিরতরে! অনেক অনেক স্বপ্নের শেষ হয়ে গেল মূহুর্তের মধ্যে।
আজকে আমি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে লিখতে চাইছিলাম। জানাজা নামাজ নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু বাজে সংস্কার নিয়ে। কিন্তু কিভাবে যেন লেখার খাত ঘুরে গেল। চলে গেলাম ভিন্ন প্রসঙ্গে। নাজু আঙ্কেলের কথা মনে পড়ছে অনেক। সেই ২০০২ সালে নাজু আঙ্কেল বিদায় নিলেন, এই মটরসাইকেল অ্যাসিডেন্ট করেই। সদাহাস্যমুখী নাজু আঙ্কেল! বনানী রেলক্রসিং এর ধারে উনার মাথার হেলমেটের উপরে দিয়ে চলে গিয়েছিল বড়ো বাসের চাকা। আমার আব্বুর খুব প্রিয় একজন মানুষ ছিল নাজু আঙ্কেল। আব্বু বাসায় এসে, আমাকদের কে বললেন, নাজুর লাশ না দেখলেই আমার জন্য ভাল ছিল। মাথাটা এমন ভাবে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে, আমি কেন দেখলাম? না দেখলেই ভাল ছিল। বারবার উনি বলতেছিলেন এই কথা। এই নাজু আঙ্কেলের একটা উপকার আমার এই জীবনে ভোলা সম্ভব না।
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার দিন (২০০২ সালের জানুয়ারী মাসেই), আমি ভুলে ক্যালকুলেটর নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আব্বুর সাথে মটর সাইকেলে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে আব্বুকে বলতেই আব্বু বলল, তুমি টেনশন করো না। সময় মত ক্যালকুলেটর তোমার হাতে চলে যাবে। আব্বু একটা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে নাজু আঙ্কলকে ফোন দিয়ে বললেন, নাজু তুই এখনই ক্যালকুলেটর টা নিয়ে যায়, শাওনের টেবিলের উপরে আছে। নাজু আঙ্কেল আমার বাসায় গিয়ে ক্যালকুলেটর এনে ঠিক সময়ময় আমাকের হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে নাজু আঙ্কেল চলে গেলেন চিরতরে। আঙ্কেল খুব ভাল গান গাইতেন। ২০০২ সালের আব্বুদের বন্ধু সমিতির নৌবিহারে নাজু আঙ্কেল কয়েকটা গান গাইলেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে। একটা গান আমার কানে এখনও ভাসে-‘যমুনার জল আনতে যাচ্ছ, তুমি কাদের কূলের বৌ...’
প্রবাস জীবনে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের কথা। তখন Yahoo Messenger এর চ্যাটিং করতাম। বন্ধু শ্যামলের সাথে কথা হয়েছিল। শ্যামলের সাথে প্রথম কথা বলার পরেই আমি আমার দ্বিতীয় কথাটা অবধারিত ভাবে যেটা বলেছিলাম সেটা হল, ‘সবুজ ভাই কেমন আছেন, কথায় আছেন?’ সবুজ ভাই শুধু একটা নাম না, আমার প্রিয় একটা মানুষ, আমার প্রিয় ভাইয়া, আমার প্রিয় একজন শিক্ষক! শ্যামল উনারই ছোট ভাই, আমাদের বন্ধু এবং ব্যাচমেট ছিল। শ্যামল আমাকে যে উত্তরটা দিল সেটা শোনার জন্য আমি মোটেপ প্রস্তুত ছিলাম না। সবুজ ভাই আর নাই। মটরবাইক আক্সিডেন্ট করে মারা গেছেন সেই ২০০৭ এই। যখন শ্যামলের সাথে কথা হচ্ছিলো তারও প্রায় দুই বছর আগেই সবুজ ভাই চলে গেছেন। কিছুই জানতাম না আমি। সবুজ ভাইয়ের মাথা এমনভাবে থেতলে গিয়েছিল যে পরিবারের কেউ উনার মরদেহ দেখেনি। কাফনের উপর থেকেই দেখেছে সবার প্রিয় সবুজ কে। সবুজ ভাইয়ের কাছে অঙ্ক করেছিলাম একটা কোচিং সেন্টারে। উনার সেই পড়ানোর কথা, উনার কথা, আমাকে কেমন স্নেহ করতেন, একটা দিনের জন্যও আমি ভুলিনি। আমার প্রিয় সবুজ ভাইও হারিয়ে গেলেন চিরতরে। মিরপুর বাংলা স্কুল সংলগ্ন কবস্থানে শ্যামলকে নিয়ে একবারই গিয়েছিলাম সবুজ ভায়ের শেষ ঠিকানাটা দেখতে। ঐ একবারই। প্রিয় মানুষ মনের ভেতরই বেঁচে থাক সারাটা জীবন।