একা, একাকী কিংবা একাকীত্ব নিয়ে যদি কিছু বলি বা লিখি তাহলে অনেকের কাছেই দারুণ একটা তামাশার খোরাক হয়ে যাবে। টিটকারি মেরে অনেকেই বলবে, ভারী আমার সাহিত্যিক হয়ে গেছে, সাহিত্য বেয়ে বেয়ে পড়ছে, সাহিত্য দেখে মরে গেলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি! এগুলো হতে পারে কিছু ভদ্রগোছের কথা যেগুলো আমার দিতে ছুঁড়ে দেয়া হতে পারে। কিংবা এর চেয়েও আরো কঠিন ভাষাতেও সমালোচনা হতে পারে। অসুবিধা নেই, আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত আছি এর চেয়েও কঠোর কোন কথা শুনতে। তবুও আমি গলা উচিয়ে বলতে চাই, মানুষ যতই জনবলের বাহাদুরি করুক না কেন, মানুষ একা। প্রত্যেকেই একা। দিনের শুরুতেও একা, রাতের নৈঃশব্দ্যেও একা। কেউ খুব সহজে বুঝে যায়, কারো বুঝতে দেরী হয়। আমি আগেও বলেছি আমার চৈতন্য, বোধগম্যতা নিতান্তই জড় পদার্থের কাছাকাছি। কোন কিছুই আমি আগেভাগে বুঝতে পারি না। ইংলিশ এ Dumb বলে যেটা বোঝান হয় সেটার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমি।
কে আছে সাথে বলে আপনি মনে করেন? আপনি যদি একজনকেও বলতে পারেন আপনার সাথে আছে, তাহলে আমি বলবো আপনি ভাগ্যবান! আপনার দর্শন আমার কাম্য। আমি আমার এ জীবনে কোন সম্পর্ক দেখিনি যেটাকে আমি আমার জীবনের সঙ্গে স্থায়ী বলে ধরে নিতে পারি। একটা সম্পর্ক দেখান আমাকে যেটার মধ্যে কোন স্বার্থ থাকে না। কোনটা বলবেন, মা? বাবা? ভাই? বোন? স্ত্রী? পুত্র? কন্যা? আত্মীয়? বন্ধু? কোনটা নিঃস্বার্থ দেখেন আপনি? যদি আপনি কোনটা দেখে থাকেন, আমি আবারো বলছি আপনি সত্যিই ভাগ্যবান। আপনি আমার নমস্য। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সেই অবারিত দান দিয়েছেন দেখানে আপনি ‘একা’ নন। আপনার জীবনে কোন একাকীত্ব নেই! আপনাকে দেখতে পেলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম।
প্রতিটি সম্পর্কের পেছনে কোন না কোন আদান প্রদানের একটা সূক্ষ্ম মারপ্যাচের সম্পর্ক আছে। বুঝতে পারেন নি? ঠিক আছে, তাহলে আপনার হাত খালি করুন, অর্থশূন্য হয়ে যান। বিপদে পড়ে ডাকুন কাউকে... বুঝে যাবেন। অর্থ আর স্বার্থ এ দুটোই হল সম্পর্কের মানদন্ড। আপনার এ দুটো আছে, আরো চান পাবেন। আপনার নেই, চাইবেন? নিশ্চই পাবেন। এক বুক ভরা বঞ্চনা! যতখানি বঞ্চনা আপনি সহ্য করতে পারবেন, ক্ষেত্র বিশেষে তার চেয়েও বেশী পেয়ে যেতে পারেন। এই একটি মাত্র জিনিস যে কোন মানুষ আপনাকে দু’হাত উজাড় করে, আকাশ বাতাস ভরিয়ে আপনার আত্মার ধারণ ক্ষমতার বাইতে দিতে পারে, সেটি হল বঞ্চনা। বিনা মূল্যে পাবেন।
জীবনের কষ্টের আঁধার তখনই শুরু হয় যখন বিশ্বাসে আঘাত আসে। আপনি আপনার আশেপাশের সম্পর্কগুলোকে নিজের মত করে যদি ভেবেছেন তো আপনার দুর্ভাগ্য অনিবার্য। কারো জন্য নিজের মন উজাড় করে দিয়েছেন তো বলতে হবে আপনার মত দুর্ভাগা আর কেউ নেই। হাজার ভাগ দিয়ে যখন মাত্র এক ভাগের জন্য আপনার মন একটু লালায়িত হবে, কিংবা মনের ভেতর থেকে যখন শত যোজন অতল থেকে বুদবুদ ওঠার মত করে একটু হাহাকার মেশা দীর্ঘশ্বাস বের হবে, তখন যখন আপনি চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হবেন, তখন বুঝবেন আপনার কল্পনার সম্পর্কগুলো আসলে কত অলীক ছিল। তাসের ঘর ভাংতে কতটা সময় লাগে জানি না, মনের কল্পনায় দেখতে পারি, আসপাশের সম্পর্কগুলো মনে হয় এর চেয়েও দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। জীবনের চলার পথে কেউ কেউ আপনার পাশে থাকতে পারে, সেটা সাময়িক কিছু সময়ের জন্য। সময় শেষে পঠিক যে যার গন্তব্যে চলে যাবে। গন্তব্যই যখন আলাদা তখন কে কাকে দেখবে? আপনি কার জন্য নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন? যে কখনও আপনার ছিলই না?
জীবনে চলার পথে ‘বন্ধু’ খুব অপরিহার্য। কিন্তু বন্ধু কে? কতক্ষণ সে আপনার বন্ধু? আপনি কি আবার আমার মত ভুল পথে পা বাড়াচ্ছেন? বাংলাদেশীদের গড় আয়ুর অর্ধেকের বেশী অতিক্রান্ত করে আমি চলে এসেছি আরো আগেই। এখন পর্যন্ত আমি বন্ধত্বের সংজ্ঞা খুঁজে পাইনি। বন্ধুত্বের জন্য কোন বয়স সীমা আছে বলে আমি মনে করি না। আমি অবলীলায় যে কোন বয়সের মানুষের সাথে মিশতে পারি। কিন্তু যাকে বন্ধু বলে মনে করছি, সে কি আমাকে বন্ধু ভাবছে? যদি সেটা না ভেবে থাকে, তবে আমি বলবো, ‘এক মানুষ জীবনে’ এর চেয়ে বড় অপমানের আর কিছু হতে পারে না। শরীরের ক্ষত শুকায় যায়, বা বেশীর বেশী মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু বন্ধু মনে করে আঘাত পাওয়ার যে কষ্ট সেটা মৃত্যুতে পোষায় কিনা আমি জানি না। কারণ আমি জানি, মৃত্যুতে শরীর মরে, আত্মা তো মরে না। আত্মার উপরে যে আঘাত লাগে সেটা কি তাহলে মৃত্যুতে শেষ হয়? সবকিছু সহ্য হয়, আত্মার উপরে লাগা চোট তো শুকায় না রে ভাই! ওগুলো তো ভুলতে পারি না। কেউ সান্ত্বনা দিলেও তো সেই উত্তাপ থামে না। শামুকের মত গুটাতে থাকি। নিজের নিস্তব্ধতায় তখন নিজেকে বিলীন করে দিতে ভাল লাগে।
আমার মনের ভেতর কতগুলো বন্ধ দুয়ার আছে। কল্পনার চোখে আমি সেই বন্ধ দুয়ার গুলো দেখতে পারি। যখন আমার কোন কষ্ট হয়, আমি যখন বুঝতে পারি আমার খারাপ লাগছে, তখন আমি আমার সেই বন্ধ দরজা একটা একটা করে খুলতে থাকি। দেখার চেষ্টা করি এর বাইরে কি আছে। কতখানি আমি অগ্রসর হতে পারবো। কখনো আঁধার থাকে, কখনও আলো থাকে। পিছে তাকিয়ে দেখি কেউ হাতছানি দেয় কিনা। কেউ দেয় না। আমি কোন একটা দরজা দিয়ে প্রবেশ করি। আমার পেছনে বন্ধ হয়ে যায় দরজাটা কিছুটা নিঃশব্দেই। আমি এপাশ ওপাশ খুঁজতে থাকি, কেউ কি আছে? কেউ কি আসবে। কেউ আসে না। শুধু দূরের কোন এক অজানা থেকে আমাকে আলিঙ্গন করে আমার অদৃষ্ট নিয়তি। আমাকে তার শীতল স্পর্শে মোহিত করে কিন্তু শত অনুনয়েও দেখা দেয় না। শুধু মনে করিয়ে দেয়, আমি একা।
Comment
চমৎকার লিখেছেন!
ধন্যবাদ
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই আপনাকে। দোয়া করবেন।
Dr. Zayed Bin Zakir Shawon