প্রিয় সালাহ উদ্দিন স্যার,
কি ভাবছেন স্যার? এই যুগেও কেই চিঠি লিখে? স্যার আপনি তো জানেনই, আমি বরাবরই একটু আগের যুগের মানুষ। অনেকে তো তাই বলে। নিশ্চই অনেক ভাল আছেন স্যার? আপনার মত একজন মানুষ, যে সারাক্ষণ অন্যদের আনন্দে মাতিয়ে রাখে, সে তো ভাল থাকবেই। কিন্তু স্যার, আপনি কি জানেন, আজকে আমরা কেউ ভাল নেই, যারা আমরা আপনাকে চিনতাম। আজকে সারাদিন ধরে শুধু আপনার সব কথাই মনে পড়ছে। আপনাকে সত্যিই অনেক দেখতে ইচ্ছা করছে স্যার!
আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম আবার আপনাকে ‘টক দই’ বানিয়ে খাওয়াবো। স্যার আমাকে একটা সুযোগ অন্তত দিতেন। সবাইকে মিষ্টি দই খাওয়ালেও আপনার জন্য আমি আলাদা করেই টক-দই বানিয়ে আনতাম। একটু সময় যদি আমাকে দিতেন স্যার! আপনার কি মনে আছে, ২০১৭ এর শেষের দিকে, টিচার্স কমন রুম #১০৬ এর সবার জন্য মিষ্টি দই আনলাম। আপনি খেলেন, উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করলেন আমার মত একজন অদক্ষ আনাড়ী রাঁধুনিকে! আপনার কথায় জানতে পারলাম টক-দই আপনার বেশী পছন্দ। পরে আপনার জন্য টক দই বানিয়ে এনে আপনার টেবিলে রেখে দিলাম। আপনি ক্লাস নিয়ে এসে দই দেখে খেলেন। দই দেখে খুশী হলেন কত, পুরো কমন রুমের সবাইকে বললেন, ‘আমি আমার জীবনে এত ভাল দই খাই নি’। স্যার, আমার মত একজন অপটু লোককে আপনি যেভাবে প্রসংশা করেছিলেন সামান্য একটু দই এর জন্য, এই অধম সে কথা কোনদিনও ভুলবে না। চাকরী পরিবর্তন করে যখন চলে আসবো, তখন বলেছিলেন, ‘এখন দই কে খাওয়াবে?’ স্যার, আমি বলেছিলাম, ইনশাল্লাহ আপনার জন্য আমি বানিয়ে আনবো। আমি কথা রাখতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। সারাজীবন মনে কষ্টটা থেকে যাবে যে আমি আপনাকে আর একবার দই খাওয়াতে পারলাম না। জীবনে যতবার দই সামনে আসবে, আমি কথা দিলাম স্যার ততবার আপনার কথা আমার মনে পড়বেই। আপনার মত একজন মন খোলা মানুষকে কি ভোলা যায় স্যার?
স্যার, প্রথম আপনাকে দেখেছিলাম উত্তরা ব্রাঞ্চের এক মিটিং এ। এর কিছুদিন পরে শুনলাম আপনি আসছেন আমাদের মিরপুরের শাখায়। ভাবছিলাম কেমন হবে নতুন এই শিক্ষক? মনে কত রকম প্রশ্ন ছিল। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই আপনি সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন যাদের কাছে আমার মত আপনি প্রথমবার পরিচিত হলেন। আমি আপনার বেশ অনেকটা ছোটই হব। কিন্তু যখনই আপনার সাথে দেখা হত স্যার, ততবারই আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, জায়েদ স্যার কেমন আছেন? আপনার সেই ভরাট গলার সম্ভাষণ আমি আজ সারাদিন ধরে শুনতে পেয়েছি। সুপারভাইজরের অফিস থেকে যেই ডেভিড ভাই আসতেন কোন নোটিস নিয়ে, তখন আপনি দুষ্টামি করে প্রচন্ড জোরে যে বলে বসতেন, ‘এই ডেভিড’! এটা শুনে আমি প্রথমদিন ভীষণ চমকে উঠেছিলাম। পরে দেখি ডেভিড ভাই তার স্বভাবসুলভ মুচকি মুচকি হাসছেন! কারণ উনি তো আপনাকে আগে থেকেই চিনতেন! আর ইসমাত খান আপাকে যে আপনি সমসময় ‘ইস্পাত আপা’ বলতেন সেটা তো মনে পড়লেই হাসি আসে। কি অবলীলায় আপনি কমন রুমের ভেতরেই বলতেন ইস্পাত আপা!
ঈদের আগে আগে যে কয়বার আপনাকে পেয়েছি, ততবার আপনি ‘বোনাস’ পাওয়া নিয়ে কি মজাটাই না করতেন! চাকরীর চুক্তি অনুযায়ী যেহেতু আপনি পার্ট-টাইম শিক্ষক ছিলেন, বোনাস পেতেন না। এ নিয়ে আপনার সেই মজার মজার কথাগুলা কি করে ভুলি স্যার? আপনার সাথে সবচেয়ে মধুর তর্ক-বিতর্ক হত শামীম স্যার এর সাথে। কি অবলীলায় আপনি কমন রুমে ঢুকেই চিৎকার করে বলে উঠতেন, ‘শাইম্যা’! আর শামীম স্যার আপনাকে ডাকতেন, সাল্লু বলে! কত বছরের পুরনো বন্ধুত্ব আপনাদের! আপনাদের সেই মিষ্টি মধুর তর্ক-বিতর্ক এখনও মনে ভেসে ওঠে। এক ঈদের আগে, আপনি রুমে ঢুকেই ঘোষণা করলেন, ‘শাইম্যা বোনাস পাইসে একষট্টি হাজার ছয়শ পনের টাকা পঁচিশ পয়সা’। আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম এজন্য যে, আপনি কল্পনা করে এমন একটা অঙ্ক বললেন যেটা থেকে পঁচিশ পয়সাও বাদ গেল না। এখানেই কি শেষ? শামীম স্যারকে খোচা দিতে পারলে আপনি ছাড়বেন কেন? বললেন, শাইম্যা যদি এই টাকা বোনাস পায় তাহলে ওর বেতন কত! শামীম স্যার নিজেই বলে উঠলেন, আমার বোনাস এখনও আসেই নাই আর সাল্লু আমার বেতন শুদ্ধা দেখে ফেলসে! কি সুন্দরই না ছিল সেইসব দিনগুলো! কোন কিছু আর ফিরে আসে না। সেইসব দিনও আর কোনদিন ফিরে আসবে না।
টিচার্স ট্রেনিং এর অংশ হিসাবে আমার একটা দায়িত্ব ছিল কোন এক সিনিওর কলিগের ক্লাস পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আমি আপনার ক্লাসে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যথা সময়ে আমি আর সুপারভাইজর তানভিরা আপা গেলাম আপনার ক্লাসে! সেদিনের সেই ক্লাসের পেছন থেকে শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখলাম আপনার পড়ানোর কৌশল। কত কিছু শিখলাম। দেখলাম ছাত্ররাও কতটা যত্ন নিয়ে আপনার প্রতিটা কথা শুনছে। আপনি কত সুন্দর করেই না পড়ানোর বিষয়টা উপস্থাপন করলেন। পেছনের পড়ার সাথে সংযোগ করে নতুন পড়ার বিষয়ের কি সুন্দর সমন্বয়। অথচ ক্লাস শেষ করে এসে, আমার সিনিওর হওয়া সত্ত্বেও আমাকে বললেন, ‘স্যার কি কি ভুল করসি একটু ধরায়ে দেন’! আপনার মত বড় মনের একজন শিক্ষকই পারে এমন কথা বলতে। অনেক কিছুই শিখেছি আপনার কাছ থেকে, আরো কত কিছু শেখার বাকী ছিল স্যার। জীবন সবাইকে সেই সুযোগ দেয় না। সুযোগটা আমিও আর পেলাম না স্যার। সারাজীবনের জন্য আমার আফসোস থেকে গেল।
ইতি,
আপনার স্নেহধন্য সহকর্মী
পুনশ্চঃ স্যার আপনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, জায়েদ স্যার’, আপনাকে আমি কল দিব। কথা বলবো আপনার সাথে’। আপনার কলের জন্য আমার সেই প্রতীক্ষা কখনও শেষ হবে না।