সিগারেট খাওয়া বা পান করা যেটাই বলা হোক না কেন, আমার এই জীবনে কোনদিন করা হয়ে ওঠেনি। অদূর ভবিষ্যতেও এই অভিজ্ঞতা নেয়ার কোন সম্ভাবনা অন্তত সজ্ঞানে আমি দেখি না। এই জিনিসটার প্রতি কোন মোহ আমার কোনদিন হয়নি, হবেও না। উপরন্তু, আমি এটাকে যথেষ্ট খারাপ ভাবেই দেখতাম সেই ছোটবেলা থেকে। সৌদি-আরবে যখন গিয়েছিলাম তখন আমার বয়স সড়ে পাঁচ বছর। তখন দেখেছিলাম আব্বু কদাচিৎ ধুমপান করেন। তাও সেটা অতি সামান্য এবং আমার যথেষ্ট নজর এড়িয়ে। কিন্তু আমি টের পেয়ে যেতাম এবং তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতাম। আমরা যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে আব্বু চিরতরে এই অভ্যাস পরিত্যাগ করলেন। আব্বুকে ধন্যবাদ।
অ্যালবাম ঘটতে গিয়ে একবার দেখেছিলাম আমি উপুড় হয়ে শুয়ে আছি, কপালের কোনায় থ্যাবড়ানো কাজলের টিপ (নজর টিকা) আর আমার গালে আমার এক মামাতো ভাই একটা সিগারেট গুজে দিয়েছে! কি ভয়ঙ্কর! অবশ্যি সেটা জ্বলন্ত ছিল না। শুধুমাত্র ছবির জন্য কিম্ভুত এক পোজ! সেই আশির দশকে এবং নব্বই দশকেও, সেলফি নামক ব্যাপারটা ছিল না কিন্তু তখন মানুষ কি সব অদ্ভুত অদ্ভুত পোজ দিয়ে ছবি তুলতো। মটর সাইকেলে বসে, ফোনের হ্যান্ড রিসিভার কানে দিয়ে, ঠোঁটে সিগারেট গুজে, গাছের ডাল ধরে, পায়ের উপরে পা তুলে দিয়ে, আরো কত কি! এগুলা দেখলে এখন যে কেউ হেসে ফেলবে। যুগের সাথে মানুষের রুচিবোধে পরিবর্তন তো আসবেই। তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা যে ভঙ্গিতে ঠোঁট মুখ বাঁকা চোখা করে সেলফি তুলে, টাইম মেশিনে করে এগুলা যদি আমার নানাদের আমলে নিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে এসব ছবি দেখলে উনারা যে কি মন্তব্য করতেন সেটা সহজেই অনুমেয়।
এখানে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও আমার নানার কথা একটু বলে রাখা যেতে পারে এখানে। উনি প্রচন্ড রাগী মানুষ ছিলেন এবং রেগে গেলে উনি রিক্সাওয়ালাদেরও ইংলিশে গালিগালাজ করতেন! আমার জন্মের পর যখন আমাকে খুলনা নিয়ে যাওয়া হল, তখন ওখানকার কিছু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বাচ্চা কোলে নিয়ে নাচানোর জন্য হাজির। আমার নানী অনেক অনুনয় বিনয় করেও তাদের পরাস্থ করতে পারছিলেন না। তারা আমাকে কোলে নিয়ে নাচবেই। আমার নানা তখন মাঠে কাজ করছিলেন। কিভাবে যেন খবর পেয়ে গিয়েছিলেন। আমি ছিলাম উনার চোখের মণি! সারা তছির মঞ্জিল (আমার নানা বাড়ির নাম) জুড়ে শুধু আমি একাই ছিলাম ছোট বাচ্চা! নানা মাঠের থেকেই তারস্বরে গালিগালাজ করতে করতে বাড়ির উপরে হাজির। নানার উপস্থিতি টের পেয়ে, টাকা নেয়া বা নাচ গান করা দূরে থাক, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো জান নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচে আরকি!
১৯৯৭ সালে নানুবাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার এক মামাতো বোনের বাসায় বেড়াতে গেলাম। ওদের বাড়ির পাশে পুকুর ঘাট আছে, বড় বড় কিছু আমগাছও আছে। আমার ওই আপা আমাদের জন্য রান্না বান্না করতে লাগলেন। প্রেসার কুকারে পুডিং বসিয়ে দিলেন। আমি ওয়াশরুমে গিয়ে একটা সিগারেট খুঁজে পেয়েছিলাম। বুঝলাম হয়ত দুলাভাই রেখে থাকবেন। আমি নিয়ে বের হয়ে আসলাম। এই জিনিস আমার হাতে পড়েছে, এটা এখন আমি ধ্বংস করে ফেলবোই ফেলবো। পুরা বিধ্বংসী মনোভাব নিয়ে আপাকে বললাম, একটা ম্যাচ দাওতো। এটাকে পুড়িয়ে ফেলি। ও ম্যাচ দিয়ে দিল। আমি সিগারেটা ধরিয়ে পুকুরঘাটে নিয়ে বসলাম। আমি শুধু এটাকে পুড়িয়ে ফেলবো। হাতে নিয়ে পুকুরঘাটে বসে আছি। একজন মহিলা পেছন থেকে যাবার পথে আমাকে এভাবে দেখে ফেললো এবং ঘটনা যা দাঁড়ালো সেটা হল উনি ধরে নিয়েছেন আমি সিগারেট খাচ্ছি বসে বসে। উনি গিয়ে আমার বোনকে বলে দিলেন। মামাতো বোন বুঝতে পেরেছিল। আমাকে খুব ভাল করেই জানতো, আমি কোন ভাবেই সিগারেট খাব না। উনি সেই মহিলাকে বুঝিয়ে বললেন আমার কথা যে, ও সিগারেট টা নষ্ট করে ফেলছে। ও এটা খাবে না। এই ঘটনাই হল একটা সিগারেটের সাথে আমার কাটানো সবচেয়ে লম্বা সময়। সেই মহিলা বিশ্বাস করেছিল কিনা কে জানে?