১৯ ডিসেম্বর ২০১৯

‘এপিটাফ’ কথাটা সর্বপ্রথম আমি জানতে পারি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। আমার এক মামাতো বোন আমাকে ডঃ হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘এপিটাফ’ উপন্যাসটা পড়তে বলেন। বইটা নাকি উনার খুব ভাল লেগেছিল। বইটা আমিও পড়েছি কিন্তু আমার মনে নেই কাহিনীটা। আবার পড়ে দেখতে হবে। ডঃ হুমায়ূন আহমেদের বই বার বার পড়াই যায়। অভিধান দেখে খুঁজে পেলাম Epitaph মানে হল স্মারক ‘সমাধি-ফলক’। মনের ভেতর তখন থেকেই কেমন যেন একটা অব্যক্ত অনুভুতি হতে থাকে। কবরের গায়ে খোদাই করে মৃত ব্যক্তির নাম জন্ম মৃত্যুর তারিখ দেয়া যে ফলক, তাকেই এপিটাফ বলে! আমি সাধারণত কবরস্থানে খুব একটা যাই না। আমার কেমন যেন প্রচন্ড মন খারাপের অনুভুতির সাথে একটু ভয় ভয়ও করে। আমি জানি না কেন! ছোটবেলা থেকেই এমন হয়। কিন্তু যদি কখনও কোন কবর বা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর সমাধির দিকে নজর পড়ে, কিংবা কোন এপিটাফ সেখানে থাকে তাহলে আমি সেই এপিটাফের প্রতিটা কথা খুব মন দিয়ে পড়ি। এর কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।

 

এপিটাফগুলা পড়লে আমার সেই সমাধিতে থাকা মানুষটার প্রতি কেমন যেন অদ্ভুত একটা মায়া জন্মায়। তাঁর বয়স হিসাব করি। কেমন ছিল মানুষটা, তাঁর একটা অনর্থক ছবি মনের ভেতর আঁকার চেষ্টা করি। প্রার্থনা করি সেই মানুষটার জন্য। যেখানে আছে ভাল থাকুক। আমাদের মতই একসময় পৃথিবী কাঁপিয়ে চলাফেরা করেছিল এসব মানুষ, আজ হয়তো তাদের কথা সবার মনেও নেই। কিছুকাল মনে থাকবে, এরপর সবাই ভুলে যাবে। আমরা বেঁচে থেকে প্রতিনিয়ত মানুষের মৃত্যু দেখছি, কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে যাচ্ছি যে এমন আমাকেও মরে যেতে হবে। চোখের সামনে দেখা সমাধির মানুষটার একটা নির্দিষ্ট সমাধি হয়েছে, কারো কারো একটা এপিটাফও জুটে গেছে। কিন্তু আমিতো এও জানি না, আমার মৃত্যু কিভাবে হবে? আদৌ কোন সমাধি হবে? থাকবে কি কোন এপিটাফ? মৃত্যুর তারিখ কত থাকবে সেখানে?

 

যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন আব্বু একদিন আমার কাছে আসলেন। আমি তখন পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিলাম। উনি বললেন, কোন একটা কবরস্থানে গিয়ে একটা এপিটাফের লেখা পড়ে উনার ভাল লেগেছে। উনি লেখাটা একটা কাগজে লিখে এনেছেন। আমাকে উনি নির্দেশ দিলেন, যদি সম্ভব হয় তাহলে উনার মৃত্যুর পরও যেন উনার সমাধিতে আমি সেই কথাগুলো এপিটাফে লিখে দেই। আমার ছোট মন তখন খুব খারাপ হয়ে গেছিলো। আব্বু খামাখা মৃত্যুর কথা, এপিটাফে কি লেখা থাকবে না থাকবে সেসব আমাকে কেন বলছেন? মানুষের আবেগের মাত্রা বোঝার মত বয়স আমার তখনও হয়নি। আমি শুধু মুখে বলেছিলাম, আচ্ছা দেখা যাবে। এপিটাফটাতে একটা ছোট কবিতা ছিল। কাগজ থেকে দেখে আমি মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। লেখা ছিল-

 

“ক্ষণিক দাঁড়ায়ে মোর কবর পাশে

খোদারে বলিয়া যাও ক্ষমা কর দাসে

দু’চারটি আয়াত পড়ে দিও উপহার

তোমার চরণে এই মিনতি আমার”

 

কথাগুলো এখনও আমার মন ছুঁয়ে যায়। আমার নানা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স মাত্র ৭ মাস। তখন আমি আমার আম্মু সহ নানা নানুর সাথেই খুলনাতে থাকতাম। সবার কাছে শুনেছি, আমার নানা আমাকে ভীষণ আদর করতেন। নিজেও গায়ে তেল মাখতেন আর আমার গায়ে তেল মাখিয়ে উনার বুকের উপর নিয়ে শুয়ে নানা নাতি রোদ একসাথে রোদ পোহাতেন। নানা নাকি প্রায়ই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, ‘তোমাকে আমি অনেক লেখাপড়া করাবো’। আমার নানা নিজেও একজন বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। নানার এই কথার যোগ্য আমি হয়েছি তা আমি এখনও মনে করি না। লেখাপড়ার কোন শেষ নেই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় পড়ালেখার সর্বোচ্চ ডিগ্রী যখন অর্জন করলাম, তখন সবসময় নানার সেই কথাগুলো মনে পড়ত যা আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি। আমার নানার কবরে একটা এপিটাফ ছিল। সেখানে লেখা ছিল ‘পিতৃস্মৃতি’। নানার নাম, মৃত্যুর তারিখ ২১শে জানুয়ারি ১৯৮৩। বহুকাল দেখে এসেছি সেই এপিটাফটা। সাম্প্রতিক কালে, কবরস্থান সংস্কার কমিটির সিদ্ধান্তে, সব পুরান কবরের চিহ্ন কে তুলে ফেলা হয়েছে। আমার নানার কবরটা ইটের গাঁথুনীতে ঘেরা ছিল। এমন আরো যেগুলো ছিল সেগুলো সব নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। শুধু অবস্থানটা মনে আছে। চাতাল ঘরের দেয়ালের সাথে ছিল নানার কবর। এখনও গেলে তাকিয়ে দেখি। মনে হয় মানুষটা মাটির নিচ থেকেই দেখছে আমাকে। আমিও দেখার চেষ্টা করি আমার অনাগত পরিণতিকে।     

View shawon1982's Full Portfolio