‘মেডিক্যাল চেক-আপ’ এর কথা যখন শুনেছিলাম, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে, তখন ভয়ে আর লজ্জায় তো বটেই, আমার মাথা কাটা গিয়েছিল প্রায়! আমার এক বন্ধুর কাছে ফোন দিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কালকে তো মেডিক্যাল চেক-আপ, কি করবে রে? জানিস কিছু? এর উত্তরে আমার সেই বন্ধু খানিক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে আমাকে যে ঘটনা বললো তা শুনে ফোনের এপাশ থেকে আমার মুখ দিয়ে কোন উত্তর বের হচ্ছিল না। হায় কি সর্বনাশ! এ আমি কি শুনলাম? আমার মনে তখন এই জাতীয় কথারই গুঞ্জন হচ্ছিল। সার সংক্ষেপে যদি বলি, নর্বাচিত ছাত্রদের ‘হার্নিয়া’ চেক করেন ডাক্তার তাঁর চেম্বারে আর অন্য একটা ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে কিছু এক্স-রে আর চোখ ইত্যাদি করে আসতে হয়। সময়টা জানুয়ারী মাস। কিঞ্চিত শীত তো বটেই! ৬ই জানুয়ারী ২০০২ সালের ঘটনা যেদিন আমার জীবনের এক আতঙ্ক ‘মেডিক্যাল চেক-আপ’ হয়েছিল। প্রকৌশল থেকে সদ্য পাস করা এক বড় ভাই (আমাদের আত্মীয়)কে ফোন দিলাম। ভাইয়া আবার আমার টিচার ও ছিলেন। শুকনা মুখে মেডিক্যাল এর কথা জিজ্ঞাস করলাম। ভাইয়া সব জেনে শুনেও বললো, কিছুই না। ডাক্তারের রুমে যাবা, টুকটাক প্রশ্ন করবে, রিপোর্ট দেখবে, এই ব্যস! রেগুলার চেক-আপ আরকি!
আমি শুনে আস্বস্ত হলাম কিছুটা কিন্তু ভয় গেল না। পরদিন শীতের মধ্যেও আমি ঘামতে লাগলাম। গ্যাবডিনের একটা ঢোলা ফুল-প্যান্ট আর ফুল হাতার কালো গেঞ্জি পরে গিয়েছিলাম। লম্বা সিরিয়াল পার হয়ে ডাক্তারের রুমে গেলাম। ডাক্তার সাহেব একজন বয়স্ক মানুষ ছিলেন। যাকে দেখে আবার আব্বুর চেয়েও বেশী বয়স্ক বা প্রায় সমবয়সী বলেই মনে হয়েছিল। উনাকে দেখ আমার ভেতর থেকে ভয় আর লজ্জা ভাব এতক্ষণ যেটা জগদ্দল পাথরের মত বুকে চেপে বসে ছিল সেটা চলে গেল। উনি যা যা বললেন, রোবটের মত করে গেলাম! কাশি দিতে বললেন, উপরের দিকে তাকায়ে কাশি দিলাম! নীচে তাকানো উনার সামনে সম্ভব ছিল না। বললেন, হয়েছে! এরপর রিপোর্ট লিখে দিলেন, বের হয়ে এলাম! এখনও এই মেডিক্যাল চেক-আপের প্রসঙ্গে কোন সতীর্থর সাথে কথা বললেই হাসির খোরাক পাওয়া যায়। ভীষণ অস্বস্তি লাগে যখন, ঐ অবস্থায় কাশি দিতে হয়!
এতক্ষণ অনেক আতঙ্কের কথা হল। এবার বলি খুব আনন্দের একটা কথা। ১৩ই এপ্রিল ২০০২ ছিল আমাদের প্রথম ক্লাস। আজও আমাদের ব্যাচমেটরা এই দিনটাকে আমরা ‘Entrance Day’ হিসেবে পালন করি। বাস থেকে নেমে ধীর পায়ে আমি আর আমার এক বন্ধু হেঁটে যাচ্ছিলাম আমাদের Old Academic Building এর দিকে। যেখানে আমাদের ক্লাস হত। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন এক ঝলক দমকা বাতাস এলো। আর ঠিক তখনই মাথার উপরে ঝরে পড়েছিল উপরের গাছ থেকে অতি ক্ষুদ্র ছোট ছোট হলুদ রঙের হাজার হাজার ফুল! কি যে অদ্ভুত একটা আনন্দ হয়েছিল যা বলার মত না। আমার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখলি, মনে হচ্ছে আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিল! মেডিক্যাল চেক-আপের কথাও যেমন ভুলতে পারি না, তেমনি ভার্সিটি লাইফের প্রথক ক্লাসের দিনে মাথার উপর এই প্রাকৃতিক পুষ্পবৃষ্টি! এই সুখস্মৃতি কি ভোলা যায়?