কাজী মুজাম্মেল হক স্যার ছিলেন আমাদের হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক। স্যারের সাথে দেখা হয় সেই ১৯৯৪ সালে যখন গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল (ঢাকা) তে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই তখন থেকে। স্যারের ক্লাস আমরা পেয়েছিলাম ক্লাস সেভেনে গিয়ে। স্যার যখন গল্প গুলো পড়ে পড়ে শোনাতেন বই থেকে তখন মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকতো না। স্যার এক বিশেষ কায়দায় বই ধরতেন হাতে। হাতে বই নিয়ে ক্লাসে হেঁটে হেঁটে স্যার আমাদের গল্প পড়ে বুঝিয়ে দিতেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা রম্যগল্প ‘রসগোল্লা’ স্যার আমাদের পড়িয়েছিলেন। আমার কানে এখনও স্যারের কথাগুলো বাজে। স্যারের সাথে আমার একটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমি এটা কখনই ভুলে যাই না। ভোলার মত নয়!
ক্লাস সিক্সের প্রথমদিকে আমাকে স্কুল ছুটির পর নিতে কেউ না কেউ আসতো। আব্বুর সুযোগ থাকলে আব্বু আসতেন মটর বাইকে করে। আর না হলে আমার বড় কাজিন (ফুফাত ভাই) কাউকে পাঠিয়ে দিতেন নিতে। আর না হলে কমপক্ষে আব্বুর অফিসের পিওনকে পাঠিয়ে দিতেন আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পিওনটার নাম ছিল আলম। বাড়ি রংপুরে। প্রথম কয়েকমাস এমন হয়েছিল। এরপর অবশ্য বছরের মাঝামাঝি থেকে আমি একাই একাই যাতায়াতের অভ্যাস করে ফেলি। একদিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল। এক এক করে সবাই চলে যেতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হয়ে গেল কিন্তু আলমের দেখা নেই। আমার মন খারাপ হয়ে যেতে লাগলো। আরো কিছুক্ষণ করে দেখতে পেলাম পুরা স্কুলে আমি একাই মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কার কাছে যাব কি বলবো, কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছি না। কেমন যেন দিশেহারা লাগছে। ওইদিন কোন একটা কারণে রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম লেগে আলমের আসতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলি ফেলি, তখন মুজাম্মেল হক স্যার করিডোরে বের হয়ে এলেন। আমাকে একা দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে বললেন আমার কি হয়েছে। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে স্যারকে বললাম, স্যার আমাকে এখনও নিতে আসেনি। স্যার আমাকে বললেন, তোমার বাসায় ফোন আছে? তুমি ফোন করে দাও। আমি জানালাম স্যার ফোন আছে। কিন্তু আমার কাছে কোন কয়েন নেই। কয়েন থাকলে আমি কয়েন ফোন থেকে কল করতে পারতাম। স্যার একথা শোনা মাত্র নিজের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে খুঁজে আমার হাতে দু’টা পঞ্চাস পয়সার কয়েন বের করে দিলেন। বললেন, এই নাও, তুমি এটা দিয়ে জলদি ফোন করে দাও।
আমি কয়েন নিয়ে কয়েক মূহুর্ত বিমূঢ় হয়ে রইলাম। স্যার আমাকে কয়েন দিলেন! স্যার এরপর আবার কমন রুমের দিকে চলে গেলেন। আমি কয়েন নিয়ে আসতে আসতে ঢাকা কলেজের দিকে যেতে লাগলাম। কারণ ঢাকা কলেজে তখন একটা কয়েন ফোন ছিল। আমি গিয়েছিলাম এবং ফোন করেছিলাম বাসায়। বাসা থেকে আম্মু জানালো, আলম গেছে সময় মতই। আরেকটু দেখতে না হলে আব্বু নিজেই আসবে আবার আমাকে নিতে। ঢাকা কলেজের গেট থেকে বের হয়ে আলমকে দেখতে পেলাম। আমার ধড়ে পানি এল। পকেটে তখনও স্যারের দেয়া আরো একটা কয়েন রয়ে গেছে। আমি বাসায় চলে এলাম আলমের সাথে।
স্যার! টাকার অঙ্কটা নিতান্তই তুচ্ছ ছিল আপনার সামনে! আমার আর সাহসে কুলায় নেই আপনাকে গিয়ে সেই আট-আনা (পঞ্চাশ পয়সা) দু’টো ফেরত দেই। আপনার এই উপকার আমার সাথেই স্মৃতি হয়ে সারাজীবন রয়ে গেছে। আমি কখনই সেটা ফেরত দেব না আপনাকে স্যার। আমার জন্য দোয়া করবেন স্যার। আপনাদের দেয়া শিক্ষা আর মূল্যবোধ নিয়ে যেন বাকী জীবনটাও চলতে পারি।