১৭ নভেম্বর ২০১৯

রেল-ভ্রমন আমার অতি পছন্দের একটা ব্যাপার। যদিও রেল ভ্রমণের সুযোগ জীবনে মনে হয় সবচেয়ে কম সময়ই এসেছে। তবুও ভ্রমনের কথা শুনলেই মনে হয়, ইশ! ট্রেনে হত যদি। হাতেগুনে মনে হয় বলে দিতে পারবো কতবার ট্রেনে উঠেছি। ট্রেনের সিটগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে, কখনও মনে হয় ট্রেন সামনের দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আবার কখনো মনে হয় পিঠের দিক দিয়ে। ভারী অন্যরকম লাগে তখন। আর ট্রেন যখন চলে, তখন মৃদু মৃদু ঘটাং ঘটাং করে যে শব্দ হয়, সেটাও দুলুনির তালে তালে শুনতে ভালও লাগে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মানুষের ব্যস্ততা দেখি, গাছ দেখি। সবকিছু কত দ্রুততার সাথে দৌড়ে পেছনে চলে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে কত কিছুর চিন্তা মাথায় আসে। কত চিন্তা, কত কবিতা, কত ছন্দ! কিন্তু হাতে থাকে না কাগজ কলম। আর থাকলেই বা কি? লিখতে কি ইচ্ছে করে তখন? তখন তো শুধু মনে হয় দু’চোখ দিয়ে প্রকৃতির যতটা পারি সবুজ নিজের আত্মার সাথে মেখে নেই। শহুরে জীবনে কতকিছুই পাই, শুধু পাইনা এই মোহময় সবুজের হাতছানি।

 

তখন অনেক ছোট। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে। ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি হয়ত। বড়খালার সাথে ট্রেনে করে খুলনা গিয়েছিলাম। সাথে কাজিনরা ছিল। সেই ট্রেন জার্নি বেশ লম্বা সময়ের ছিল। ট্রেনটা প্রথমে রাজশাহী যাবে এরপরে খুলনা। ট্রেনের খাওয়া খাবারের মধ্যে কমলালেবু তো মাস্ট! থাকতেই হবে। হাতে নিয়ে কমলার খোসা ছিলছি আর কোষগুলো খেয়ে ছোবড়াটা হাতে রাখা খোসার ভেতর জমাচ্ছি। ট্রেন ঝমঝমিয়ে চলছে। কাজিন রিতা আপা (ছদ্মনাম) তার মায়ের চোখ এড়িয়ে আমার হাত থেকে খোসাগুলো নিয়ে সোজা ছুঁড়ে জানালা দিয়ে বাইরে। আর সেই খোসা গিয়ে ডিরেক্ট লাগলো রাস্তার পাশে দাঁড়ানো লুঙ্গি পরা এক লোকের পশ্চাদ্দেশে। খোসাটা ওখানে কিছুক্ষণ লেগে রইলো। হাসতে হাসতে তো আমাদের হেঁচকি ওঠে আর কি। খালা ম্যাগাজিন পড়ছিলেন একটা মন দিয়ে। উনি খেয়াল করেন নি এ আমরা আসলে কি করেছি। দেখে ফেললে বকুনি শোনা থেকে বাদ যেতাম না একটাও!

 

আরেকবার চট্টগ্রাম থেকে টেনে ফিরছি। ২০০৩ সালে। তখন ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টার ফাইনাল দিয়ে বন্ধুর সাথে ওর বাসায় চট্টগ্রাম ঘুরতে গেছিলাম। যাই হোক, ট্রেনটা কমলাপুর স্টেশনে থামলো। প্লাটফর্ম থেকে একটু দূরের পাটিতে ছিল ট্রেনটা। ফেব্রুয়ারী মাস ছিল। ভোরবেলা। ঘাসগুলো ছিল শিশির ভেজা। সকালের সূর্য্যের আলো লেগে কি সুন্দর একটা সোনালী আভা তৈরি করেছে। আহা কি রোমান্টিক পরিবেশ তাই না? আমি পিঠে ব্যাগপ্যাক নিয়ে ঘাসে এক পা, আরেকপা ট্রেনের সিঁড়িতে তখন। একপা ঘাসে দিতেই ধড়াম করে আছাড়। আছাড় খাওয়াতে আমি মোটামুটি বিশারদ টাইপের। আমি খুব একটা যে লজ্জা টজ্জা পেলাম তা নয়। এমন ভাব করলাম যে কিছুই হয় নাই। বন্ধু তাড়াতাড়ি নেমে এসে টেনে তুললো! ঐ চট্টগ্রাম ভ্রমনে আমরা অনেক মজা করেছিলাম। বন্ধুর সাথে অনেক ঘোরাঘুরি করেছিলাম। অনেক স্মৃতিই আছে। সেই সাথে জ্বলজ্বলে স্মৃতি হল ট্রেন থেকে নেমে আছাড় খাওয়ার সেই অপূর্ব দৃশ্য। আহা!

 

সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন সময়, বহুবার মালেশিয়া বেড়াতে গিয়েছি। মুলত বাসে করেই গিয়েছি। প্লেনে গিয়েছি একবার। কিন্তু ফেরত আসার পথে আমি মাঝে মাঝে ট্রেনে এসেছি KL Central থেকে। শুধুমাত্র ট্রেনে একটি জার্নি করার জন্য। ট্রেনে আসতে সময় লাগত ৮ ঘন্টা প্রায়, সেখানে বাসে আসলে লাগে ৫ ঘন্টার মত। তারপরেও আমি ট্রেনে এসেছি বার কয়েক। শুধু ঐ ট্রেনে আসার জন্যই। এ.সি কম্পার্টমেন্ট, চেয়ারগুলা ভারী সুন্দর সুন্দর। ট্রান্সপারেন্ট জানালার ওপাশ থেকে মালেশিয়ার অপরূপ প্রকৃতি দেখতে দেখতে আসতাম সিঙ্গাপুরের দিকে। একবার এক বয়স্ক ভারতীয় দম্পতিকে পেয়েছিলাম আমার সহযাত্রী হিসেবে। উনাদের ছেলে সিঙ্গাপুরে চাকুরী করে। কোন এক এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে হবে। উনারা মালেশিয়া থেকে ঘুরে যাচ্ছেন সিঙ্গাপুরে ছেলের কাছে বেড়াতে। কিন্তু জেনে অবাক হলাম উনাদের কাছে মোবাইলে কোন মালেশিয়ান সিমকার্ড ছিল না। আমি বললাম ছেলের সাথে যোগাযোগ করবেন কিভাবে? উনারা বললেন ছেলে স্টেশনে থাকবে। আমি বললাম, তাও আপনাদের ফোনে কথা বলা উচিত। আমি আমার ফোন দিয়ে বললাম, নিন আপনারা কথা বলুন। ভদ্রমহিলা খুশি হলেন। ফোন দিলেন ছেলের নাম্বারে, বললেন, ‘হ্যালো মন্টু! হাম আ রাহে হ্যায়...”।

 

ট্রেনে উঠতে যেমন ভাল লাগে, আবার কিছু কিছু কথা মনে পড়লে গা ছমছম করতে থাকে। ইউটিউববের বদৌলতে কিছু ভিডিও দেখেছি। সেগুলো মন থেকে যায় না। মোছা যায় না ওগুলো। ট্রেনে কাঁটা পড়ে আত্মহত্যার কিছু বীভৎস দৃশ্য। কি ভয়ঙ্কর! মূহুর্তেই একতা লোক মারা গেল ট্রেনে কাঁটা পড়ে। মাঝে মাঝে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার খবর দেখতে পাই। সম্প্রতি বাংলাদেশে পরপর দুইটা ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কি মর্মান্তিক সেই দৃশ্য, অবর্ণনীয়! হাসিখুশি কতগুলো মানুষের প্রাণ মূহুর্তের মধ্যে শেষ। ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখেছিলাম। শ্রীলঙ্কাতে মাতারা ট্রেন আত্মহত্যার ঘটনা। মাতারাতে যেখানে এই ঘটোনাটা ঘটে, ওখানে একটা বাড়ীর CCTV footage থেকে ধরা পড়ে পুরো ঘটনা। যে ছেলে ট্রেনের সামনে নিজের গলা পেতে শুয়ে পড়ে তার নাম লাহিরু মাদুশঙ্কা। বাংলাদেশেও একটা অল্পবয়সী ছেলে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। জনৈক চেয়ারম্যানের ছেলে। ছেলেটার নাম রিশান হোসেন সেন্টু। কি অভিমানে ছেলেটা জীবন নিয়ে নিয়েছিল ২০১৬ সালে, জানি না। ফেসবুকে দেখে ভীষন কষ্ট লেগেছিল। মারা যাবার আগে ছেলেটার শেষ স্ট্যাটাস ছিল-

“জীবনে কি পাইছি... সবই তো হারাইছি

অন্ধকার জীবন দেখতে আর ভালও লাগে না

তাই সব ছেড়ে চলে যাবো

যদি কারো কোন ক্ষতি করে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দিবেন...আমিন

Sorry Baba”

 

সবার জীবন আনন্দময় হোক, কল্যানময় হোক। আমাদের সন্তানরা বেঁচে থাকুক এক সুন্দর মূল্যবোধ নিয়ে। আমাদের ভালোবাসা নিয়ে আমাদের সন্তানরা দেশের সম্পদে পরিণত হোক। কেউ যেন আত্মঘাতী না হয়। এই কামনা সকলের প্রতি। সবার ভ্রমন আনন্দময় হোক। সেই ভ্রমন পৃথিবীতেই হোক অথবা অনন্তের পথে।   

 

View shawon1982's Full Portfolio