১৫ নভেম্বর ২০১৯

মোবাইল ফোন নিয়ে আমার কিছু স্মৃতি আছে। বাংলাদেশে যখন প্রথম মোবাইল ফোনের প্রচলন হয় তখন আমরা ক্লাস নাইন টেনে পড়ি। এর আগে ‘পেজার’ নামক একটা বস্তুর অস্তিত্ব কিছুদিন দেখেছিলাম। তখন অবশ্য ধারণা ছিল শুধুমাত্র ‘বড়লোক’ বা পয়সাওয়ালা লোকজনই পেজার বা মোবাইল ফোন ইউজ করতে পারে। খুব কায়দা করে প্যান্টের বেল্টের সাথে পেজারটা আটকে রাখা হত ‘ইন’ করা শার্ট বা টি-শার্ট এর সাথে। সে কি ভাব! উরি আল্লাহ! যা হোক, একদিন বড় খালার বাসায় গিয়ে প্রথম দেখলাম মোবাইল নামক বস্তুটি। বড়খালু কিনেছেন। কালো রঙের ঢাউস সাইজের জিনিস। হাতে নিয়ে আমি আর আমার কাজিন নাড়াচাড়া করছি। বুঝে উঠতে পারছি না, এইটা নাকি নতুন ধরণের টেলিফোন! এ দিয়ে কিভাবে কল করে? খবরের কাগজে তখন এই বস্তু নিয়ে সে কি গুঞ্জন! গ্রামীন ফোন তখন প্রথম সিম কার্ড নিয়ে এল। কল রেট ছিল ৭ টাকা পার মিনিট। ওই জামানাতে ‘মিসকল’ নামক একটা খেলাধুলার উদ্ভব হয়েছিল। যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে কল রেট কমে যাওয়াতে এই খেলা এখন বিলুপ্তপ্রায়।

 

টি.অ্যান্ড.টি টেলিফোনের অভিজ্ঞতা কে কাজে লাগালাম। বড়খালুর মোবাইল ফোন টা কানে দিয়ে অপেক্ষা করছি কখন ডায়াল টোন আসবে! ওই প্রথম জীবনে মোবাইল হাতে নেয়া। অনেক্ষণ কানে লাগিয়ে রাখলাম। নাহ, ফোন ডেড নাকি? কোন শব্দই তো নাই। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এ দিয়ে কিভাবে কি করে? বারান্দায় চলে গেলাম, ভাবলাম ফোন লাইন পাচ্ছে না মনে হয়। এবার খালাতো ভাই এসে বললো, কি করছো? বললাম, কই ডায়াল টন তো পাচ্ছি না? এটা শুনে সে ভারী একচোট হেসে নিলো। কারণ প্রযুক্তিগত বিদ্যায় সে মোটামুটি বিশারদ। যাবতীয় লেটেস্ট টেকনোলজি তাঁর মোটামুটি নখদর্পনে। বলল, আরে বোকা! এই ফোনে ডায়াল টোন লাগে না। যেই নাম্বারে কথা বলবা, নাম্বার টিপে এই সবুজ বাটন চাপ দিলে কল চলে যাবে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ডায়ালটোন ছাড়াও ফোন হয়?

 

আব্বু যখন মোবাইল ফোন কিনলো তখন আমরা একটা ভাড়া বাসায় থাকি। আমাদের বাড়ীটা তখন ডেভেলপারের কাছে। ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছিলো। আমি তখন নটরডেম কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। একদিন দেখি আব্বু নোকিয়ার কালো রঙের একটা মোবাইল ফোন কিনে এনেছে। সেটার সিম কার্ড নামক বস্তুটারই নাকি পাঁচ হাজার টাকা দাম। কলরেট সেই ৭ টাকা পার মিনিট। আম্মু ঠাট্টা করে আব্বুকে বললো, বাহ! তুমি দেখি বড়লোক হয়ে গেছ। এর কিছুদিন পরে আম্মুও একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলেন। তখন পর্যন্ত আমার কাছে মোবাইল ফোনের কোন অপরিহার্যতা ছিল না। দেখতাম আব্বু কথা বলছে। আমিও বলেছি। কিন্তু ওয়ার্নিং থাকতো অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না, অনেক টাকা কেটে নিচ্ছে। তিনশো টাকা করে কার্ড কিনে ব্যালান্স রিচার্জ করা লাগতো।

 

ভার্সিটিতে উঠলাম। ২০০২ সালে প্রথম সেমিস্টারের মাঝামাঝি। সনি হত্যাকান্ড হয়ে গেল। প্রচন্ড আন্দোলন চলছে। সেই আন্দোলনে আমরা সাধারণ ছাত্ররাও যোগ দিলাম। একদিন মিছিল করছিলাম, তখন চ্যানেল আই থেকে আমার আর আমার এক বন্ধুর সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিলেন চ্যানেল আই এর সিনিয়র রিপোর্টার মিস ফারজানা রূপা। আমার সে কি ভাব। ঐদিন ছোটখালার বাসায় ছিলাম। বাসায় এসে রাতের বেলা মোট চারবার রিপিট টেলিকাস্টে নিজেকে দেখেছিলাম খবরের মধ্যে। (মনে মনে ভাব এসে গিয়েছিল, আহারে ‘আমি কি একখান সেলিব্রেটি হয়ে গেছি’ টাইপ)। এর পরদিন আন্দোলন করছি, বিকাল বেলা ক্যাম্পাসে হঠাৎ করে পুলিশ ঘেরাও করে ফেললো। বলা হল আপনারা কেউ বের হবার চেষ্টাও করবেন না। হায় হায় এখন? এখন আমি বাসায় জানাবো কি করে? ওদিকে টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া শুরু হয়ে গেছে। আমি চোখে অন্ধকার দেখতেসি। আমার পাশেই ছিল বন্ধু জনি। ওর একটা নিজস্ব মোবাইল ফোন ছিল আমি জানতাম। কিভাবে যে ওকে বলি! উপায়ন্তর না দেখে বললাম, জনি আমি কি তোমার মোবাইলে আব্বুকে একটু জানাতে পারি আমাদের এই অবস্থা? জনি, অবশ্যই বলে ওর মোবাইল ফোন বের করে দিল। আব্বুকে ফোন করে জানালাম। বললেন, ভয় পেও না। বন্ধুরা সবাই একসাথে থাকো। একটু পরে দেখবে ছেড়ে দিবে। বন্ধু জনির সেদিনের সেই উপকারের কথা আমি কোনদিন ভুলবো না। তখন আমাদের পুরো ক্লাসে মাত্র দুই তিনজনের মোবাইল ছিল বলেই জানতাম।

 

স্টাইপেন্ড এর টাকা জমাতাম টুকটাক ব্যাংকে। কিছু টাকা জমে গেল। সালটা ২০০৫ এর মাঝামাঝি। থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন। মোবাইল ফোন আমার তখনও নেই। ঐসময়ে সারা বাংলাদেশে গ্রামীন ফোন ‘Djuice’ প্যাকেজ নিয়ে মোটামুটি দেশ তোলপাড় করে ফেলেছে। এমন কিছু আজন আজব বিজ্ঞাপন দিত তখন টেলিভিসনে যে সেটা আসলে যে কি বুঝে উঠতেই আমাদের অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। ঝাকড়া চুলের এক ছেলে, ছেঁড়া জিন্স পরে হাতে একটা কাল্পনিক গিটার নিয়ে বাঁকা হয়ে ভেঙ্গে চুরে মুখ দিয়ে “ট্যা- ট্যা- ট্যাটা ট্যাটা ঝাকানাকা” বলতে বলতে স্ক্রীনের এপাশ থেকে ওপাশে চলে যেত। এরপর স্ক্রীনে শুধু ‘Djuice’ কথাটা ভেসে উঠতো। মনে করেছিলাম বাজারে নিশ্চই নতুন কোন juice আসছে। খেয়ে দেখতে হবে কি জিনিস। পরে ক্লাসে এক বন্ধু জানালো, আরে এইটা মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন! কিনবা নাকি? আমি বললাম এতো দাম! কিভাবে কিনব? পরে শুনলাম সেট সহ নাকি মোটামুটি হাজার পাঁচেকের মত পড়বে। দেখলাম আছে এই টাকা। আমাকে যে বন্ধু বলেছিল, সে আমি আর আরো একজন তিনজন মিলে গেলাম বসুন্ধরা গার্ডেন সিটি শপিং মল এ। কিনে ফেললাম স্বপ্নের মোবাইল ফোন। একেবারে আনকোরা নতুন ফোন। নোকিয়া ১১০০ Djuice প্যাকেজ দিয়ে। এই ফোন আমার কাছে ২০০৮ পর্যন্ত ছিল। একদিন আরেক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে ওর বাসা থেকে বের হবার পথে সেই মোবাইলটা ছিনতাই হয়ে যায়। এরপর কত মোবাইল ফোন হাতে এলো গেলো, কিন্তু আমার সেই প্রথম নোকিয়া ১১০০ কে ভুলতে পারি না।

View shawon1982's Full Portfolio