১১ নভেম্বর ২০১৯

পিঠা কার না ভালও লাগে বলেন? এমন কোন বাংলাদেশী মনে হয় খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যাবে যার কোন না কোন ধরণের পিঠা খেতে ভালও লাগবে না। বাংলাদেশী মাত্রেই কোন না কোন পিঠা তার পছন্দের তালিকায় থাকবেই বলে আমার বিশ্বাস। সারা বাংলাদেশে নানা জেলায় নানা অঞ্চলে কতরকম পিঠার সমাহার পাওয়া যায়। পিঠার সবই যে মিষ্টি স্বাদের হবে এমন কিন্তু না। ঝাল পিঠাও আছে! চিতৈ পিঠার সাথে মাংশের ঝোল! আহ! মনে হলেই জিহবায় পানি চলে আসে। এই পিঠা তো আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ। বিয়েতে এবং মেহমান আপ্যায়নে পিঠার কি কোন তুলনা চলে? নতুন জামাইকে খাওয়াতেও পিঠা কোন কোন অঞ্চলে তো অপরিহার্য।

 

সেই ১৯৯৪ সালের কথা। সদ্য হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। পুরো পরিবার বরিশাল বেড়াতে গেলাম লঞ্চে করে। কনকনে শীত তখন। ওটাই আমার প্রথম বরিশাল যাবার অভিজ্ঞতা লঞ্চে করে। ডেকের উপর উপরে কনকনে শীতে মানুষের কাঁথা লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়ার সেই দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। এর মধ্যেই কেউ কেউ আবার টিফিন ক্যারিয়ার খুলে নানা রকম খাবার খাচ্ছে। যেটুকু বাতাস পাচ্ছিলাম তা যেন সরাসরি হাড়ে গিয়ে লাগছিল! তখনকার দিনের লঞ্চগুলোর সাথে এখনকার গুলো তুলনাতেই আসে না। এখনকার লঞ্চগুলা দেখলে মনে হয় এ কোন জগতে চলে আসলাম! এতো সুন্দর, এতো আলো! বরিশালের দিকের লঞ্চগুলোতে ভ্রমন যে করেনি তাকে বলে বোঝানো যাবে না। ইশ! ছিলাম পিঠার মধ্যে, চলে গেলাম লঞ্চে। যাক আমি পিঠাতে আবার ফেতর আসছি। বরিশালের বানারীপাড়াতে যেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম, ওখানে গিয়ে তো অবাক। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শুরু হয় পিঠা পর্ব। সকালের নাস্তাই শুরু হয় পিঠা দিয়ে। এরপর প্রত্যেক খাবারের পর আলাদা আলাদা রকম পিঠা। কোনটা শুকনা, কোনটা রসে ভেজা, কোনটা আবার তেলে ভাজা। কত রঙ, স্বাদ আর তার বৈচিত্র্য। এগুলো কি শুধু লিখে প্রকাশ করা যায়?

 

সেই নব্বইর দশকের কথা আমার স্মৃতিপটে খুব বেশী করে মনে পড়ে। আমার ফেলে আশা সেই সব হারানো শৈশবের দিনগুলো। তখন নানু দাদু দুইজনেই বেঁচে ছিলেন। উনাদের স্মৃতি আমার মনের মনিকোঠায় সর্বদা ভাস্বর হয়ে আছে। দাদু সবসময় বলতেন, বাড়ী যেও, পিঠে খাবা। নানু দাদু যখনই ঢাকা আসতেন, সাথে করে নিয়ে আসতেন কত রকমের পিঠা। আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে, নানুকে পিঠা বানাতেও দেখেছি। আটার গোলা তেলে দিয়ে ভাজা হত এক ধরণের পিঠা। খুলনার ভাষায় যাকে বলে ‘পান পিঠা’। ছোটবেলায় মনে হয় এই পানপিঠাই আমি সবচেয়ে বেশী খেয়েছি। বাদামি রঙের এই পিঠাগুলো গরম গরম খেতে সে কি ভীষণ মজা ছিল। নানু খুলনাতে তো নিয়মিত বানাতেন। ঢাকায় কেউ এলে তার হাতে পাঠিয়ে দিতেন। নানুর দাদুর জেনারেশনের পর আমাদের জীবন থেকে পিঠার চল মনে হয় উঠেই গেছে একেবারে। কারণ ছোটবেলায় আম্মুকে দুই একবার বানাতে দেখেছি। আম্মু এখন আর পিঠা বানান না। ওগুলা বানানোর জন্য সাধারণত যে জাতীয় আয়োজনের দরকার হয়, সেগুলো ঢাকার বাসাবাড়ীতে যোগাড় করা ঝামেলার ব্যাপারই বটে। শুধু তাই নয়! নিয়মিত বানানোর হাত না থাকলে, হুট করে বসেই পিঠা বানানো যায় না। মাপের একটা ব্যাপার আছে।

 

ছোটবেলা যখন নানুবাড়ী বা দাদুবাড়ী গিয়েছি তখন আমাদের আগমন উপলক্ষ্যেও পিঠা বানানো হত। মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে চুলা ধরিয়ে, মাটির ছাঁচে পিঠা বানানো হত। ভাপা পিঠা, চিতৈ পিঠা, পানপিঠা, কুলিপিঠা আরো কত কি! পিড়ি নিয়ে আমিও বসতাম চুলার আসে পাশে। দেখতাম পিঠা বানানো। আমাকে বারবার বড়রা বলতো, দূরে সরে বসতে, কারণ চুলা থেকে ধোঁয়া লাগতে পারে। সরে বসলেও আসে পাশেই থাকতাম। মাঝে মাঝে পাটকাঠি, শুকনা পাতার টুকরা চুলার মধ্যে ঠেলে দিতাম। কারণ শহুরে জীবনে আমাদের কাছে, মাটির চুলায় রান্না মানেই হল পিকনিক! শুরুতে শুরুতে মনে হত, গ্রামে তাহলে প্রত্যেকদিনই পিকনিক! কারণ এখানে যে প্রতিদিনই মাটির চুলায় রান্না হয়! মাটির চুলা থেকে ওঠা ধোঁয়া, লকলকে হলুদ রঙের আগুন, মাটির চুলা, মাটির হাড়িতে রান্না! কি সব দিন ছিল! লাকড়ি পোড়া সেই ধোঁয়ার গন্ধটাও যে আমার ভালও লাগতো। মাঝে মাঝে আমি গিয়ে ঢেঁকির উপরে বসতাম। এখনকার ছেলেমেয়েদের ঢেঁকি চেনানোই মুশকিল। বললেও অনেকেই বুঝবেনা যে। সভ্যতার নাম করে যত এগিয়ে যাচ্ছি, ততই মনে হয় যেন আমাদের ঐতিহ্য থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। এমন দিন আসবে, তখন মানুষ এগুলো আর চিনবে বলেও মনে হয় না। এটাকে কি আমরা আমাদের ব্যর্থতা বলবো নাকি এগিয়ে যাওয়া বলবো? এগিয়ে যাওয়ার মানে কি নিজের শেকড়কে ভুলে যাওয়া?

 

আমাদের শহরে তো সবই পাওয়া যায়। পিঠা খেতে চান? কোন সমস্যা নেই। পিঠার দোকান আছে, অনলাইনে বেচাকেনার ব্যাপার আছে, অর্ডার দিন, পিঠা চলে আসবে বাসায়। ঢাকার এলাকায় এলাকায়, রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে পিঠা বিক্রি হয়। ওরাও মাটির চুলায় পিঠা বানায়। গিয়ে অর্ডার করেন, কয়টা লাগবে, নিয়ে আসেন। চিতৈ পিঠার সাথে নানা রকম ভর্তা পাবেন। ভাপা পিঠার সাথে বেশী গুড় খাবে? বলে দেন, টাকা বাড়ায়ে দেন বেশী গুড় দেয়া বেশি মিষ্টি ভাপা পিঠা পেয়ে যাবেন। সবই তো আছে। সেই পিঠাই তো! কিন্তু কোথায় যেন কি একটা নেই? এমন কি শুধু আমার মনে হয়? আপনাদের কি মনে হয় না? আমি কি আপনাদের বোঝাতে পারছি আমি আসলে কি বলতে চাইছি? ঢাকার মোড়ে মোড়ে যারা বিক্রি জন্য পিঠা বানায়, আপনি কি কখনও তাদের মুখে হাসি দেখেছেন? যেই হাসি আমি আমার নানীর মুখে, দাদীর মুখে দেখেছি আমাকে পাশে বসিয়ে পিঠা বানানোর সময়? সেই আদর সোহাগ ভালোবাসা যা নানী দাদীর পিঠার মধ্যে আমি পেয়েছি, সেই আদর ভালোবাসা কি রাস্তায় বানানো পিঠার মধ্যে আছে? বরং তাদের মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, দারিদ্রের এক নিদারুণ চিত্র ফুটে উঠেছে তাদের মুখাবয়বে। তাদের পিঠার মধ্যেও যেন দারিদ্রের কষাঘাতের এক স্বকরুণ মানচিত্র। অনেক ঘরের গৃহবধূরাই হয়ত সংসারে বাড়তি কিছু টাকা যোগান দেয়ার জন্য আমাদের কাছে পিঠা বিক্রি করছে পাঁচ টাকা দশ টাকা করে এক এক পিস পিঠা। একটা পিঠা’র মুল্য কি তাহলে পাঁচ টাকা আর দশ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল? আমার মনে চায় এরপরেও সেই ছোটবেলার অনুভুতি থেকে তাদের বলি, আমি কি একটু বসে আপনাদের পিঠা বানানো দেখতে পারি? মাটির চুলা জ্বেলে পিঠা বানানো দেখতে যে আমার অনেক ভাললাগে। বলা হয় না। আমার কথা আমার মনের ভেতরেই অঙ্কুরিত হবার আগেই ঝরে যায়। সব কথা যে বলা যায় না।  

 

নানু দাদু আজ নেই। আর আর কেউ বলে না, বাড়ি এস পিঠা খাওয়াবো। আজ বুঝতে পারি, পিঠার দোকান হয়ত দিয়েও ফেলতে পারব, কিন্তু ঐ মায়া মাখানো, আদর মেশানো ওই পিঠা চিরতরে জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। নানু দাদু যেমন চিরতরে হারিয়ে গেছেন জীবন থেকে, তেমনি হারিয়ে গেছে উনাদের ভালবাসার হাতছানি মেশানো সেই পিঠাগুলো।

View shawon1982's Full Portfolio