‘দেখেছো ফাল্গুন মাসেই আমাদের বিয়ে হল, তোমাকে আমি আগেই বলছিলাম মনে আছে’? ভিজিটিং কার্ডের এক টুকরা বাকা করে কিছুটা ঝালমুরি গালে দিতে দিতে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলল সুমি। মাত্র গতকালই বিয়ে হয়েছে ওদের।
‘উঃ, কি বললে’? অন্যমনস্ক রাহাত সুমির দিকে তাকায়। সুমির কথাগুলা আসলে ওর কানেই যায়নি।
‘আমি বললাম, আমাদের বিয়ে ফাল্গুন মাসেই হল। আমার কথাই সত্যি হল’। মুচকি হেসে সুমি আবার কথাগুলা বলে। স্বামীর মনে কি চলছে তা সুমি ঠিকি টের পায়। স্বামীর মনকে একটু হাল্কা করার চেষ্টা আর কি।
‘তুমি কি জ্যোতিষী নাকি’? একটু হাসার চেষ্টা করে নিজেকে বৃথা আড়াল করার চেষ্টা করে সুমির চোখে।
‘জ্যোতিষী হব কেন? মন থেকে কোন কিছু চাইলে আল্লাহ তা দিয়ে দেন’। মুড়ি শেষ। কাজগের ঠোঙ্গাটা মুড়ে ছুড়ে রাস্তায় ফেলে দিল সুমি। হাত দিয়ে রাহাতের কনুই ধরে বলে, ‘চল বাসাই যাই। ঠান্ডা পড়ছে’।
‘তোমাকে উপহার কিছুই দিতে পারলাম না সুমি। আমার যে কেমন লাগছে আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। তোমাকে নিয়ে বাইরে এসে কিছুই খাওয়াতে পারলাম না’। বলতে বলতে রাহাতের গলা ধরে আসে। স্বামীর চোখে যে চাঁদের আলো বেশী করে প্রতিফলিত হচ্ছে তা সুমির বুঝতে বাকী থাকে না। একদম শূন্য হাতে বেকার রাহাত বিয়ে করেছে সুমিকে।
‘আরে ধুর ধুর, কি যে বল। আমার বার কি উপহার লাগবে? তোমার হাতে যখন টাকা আসবে তখন তোমার যা খুশি কিনে দিও না হয়। এটা কোন ব্যাপার হল? আর খাওয়ার কথা বলছ? মাত্র না বাসা থেকে একগাদা নাস্তা খেয়ে আসলাম’? সুমি রাহাতের হার ধরে হাটতে হাটতে বলে।
‘সুমি, বিয়েতে তোমাকে ভালো একটা আংটি দেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিছুই পারলাম না। আমি যদি খুব সামান্য একটা জিনিস তোমাকে দেই তুমি কি নিবা’? রাহাত ক্ষীণ স্বরে জানতে চায়। মনের ভেতর তোলপাড় করতে থাকে তার। চোখ সামনের দিকের দোকানে।
‘তুমি যা দিবা আমি তাই নেব রাহাত। তুমি কি মনে কর আমাকে? অবশ্যই নেব আমি। কি দিতে চাও তুমি’? সুমি উৎসুক হয়ে জানতে চায়।
‘ধর খুব সামান্য টাকার জিনিস, মাত্র পাঁচ কি দশ টাকার হবে’। নিবা?
‘অবশ্যই নিব। কিন্তু জিনিসটা কি রাহাত’?
‘একটা শাঁখার আংটি। দাম বেশী না’। বলে সামনের শাঁখার দোকানের দিকে ইঙ্গিত করে রাহাত। ‘দিলে পরবা তুমি’? রাহাত আবার সন্দেহের সুরে জানরে চায়।
‘পরবো আমি। কিন্তু মুসলমানরা কি শাঁখা পরে’? সুমি প্রশ্ন করে। রাহাত বলে, ‘চুড়ি তো আর পরছ না। আংটিই তো। না হয় রেখে দিও’। ওরা প্রায় দোকানের কাছে চলে আসে কথা বলতে বলতে। রাহাত বয়স্ক দোকানদারকে আদাব দিয়ে শাঁখার আংটি দেখাতে বলে। দোকানদার বয়াম থেকে কয়েক কয়েকটা আংটি বের করে সামনে রাখে।
সুমি নেড়ে চেড়ে দেখে। শাঁখার যে আংটিও হয় তা সুমি জানতো না। এই প্রথম দেখলো। ‘এগুলা এমন এবড়ো থেবড়ো কেন? আঙ্গুলে পরলে ব্যথা লাগবে না’? সুমির সরল প্রশ্ন।
দোকানদার উত্তর দেয়, ‘মা এগুলা শঙ্খের খোলস থেকে কেটে বানায় তো তাই এমন দেখায়। আর আপনি পরে অভ্যাস করে ফেললে ব্যথা আর লাগবে না’।
‘আমার এইটা পছন্দ হয়েছে’। অনামিকায় একটা আংটি পরে রাহাতকে দেখিয়ে সুমি বলে, ‘এইটার দাম কতো কাকা’?
‘বিশ টাকা’।
রাহাত মানিব্যাগ খুঁলে বজ্রাহতের মত তাকিয়ে কিছুক্ষণ খুঁজে কি যেন দেখলো। টাকা আর বের করে না। সুমি আঙ্গুলে নেড়েচেড়ে আংটিটা দেখছিল। রাহাতের দিকে তাকিয়ে দেখে ও সুমির দিকে তাকিয়ে আছে। মানিব্যাগটা হাতে একটু খোলা। সুমি দেখে মানিব্যাগ এ দুই টাকার একটা নোট ছাড়া আর কিছুই নেই। আর কিছুই বুঝতে বাকী থাকে না ওর। ঝালমুড়ি খেতে গিয়ে রাহাতের মানিব্যাগ এর সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আংটিটা খুলে দোকানদার কে ফেরত দিয়ে বলে, ‘আজ না কাকা। পরে না হয় নিয়ে যাব। আমাদের বাসা কাছেই’।
দোকানদার কে কিছু বুঝতে না দিয়ে সুমি রাহাতের হাত ধরে টান দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে যেতে চায়। দোকানদার কে বুঝতে দিতে চায় না ওদের পরিস্থিতি। ওরা যখন দোকান থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন দোকানদার সুমিকে ডাক দেয়, ‘মা শুনে যান’। সুমি অবাক হয়ে তাকায় পেছনে। দেখে দোকানদার আংটিটা নিয়ে নিজেই উঠে এসেছে। সুমির হাতে আংটিটা দিয়ে বলে, ‘কোন দাম লাগবে না মা। আমি উপহার দিচ্ছি আপনাকে’।
‘না না কাকা তাই কি হয় নাকি? সুমি লজ্জা পেয়ে ফেরত দিতে চায়। স্পষ্ট বুঝতে পারে যে চোখ জ্বালা করছে ওর।
‘উপহার ফেরত দিতে নেই মা’, বলেই দোকানদার আবার তার আসনে গিয়ে বসে। সুমি ধন্যবাদ দেয়ার কথাও ভুলে যায়। রাহাতের এক হাত ধরে দোকার থেকে বের হয়ে বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। রাহাতের অন্যহাতে তখনও মানিব্যাগটা ধরা। আছে মাত্র দুই টাকা।