সাহিত্যে নোবেলজয়ী সোয়েতলানা অ্যালেক্সিয়েভিচ (সাক্ষাৎকার)

২০১৫ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ৬৭ বছর বয়সী বেলারুশিয়ান সাংবাদিক এবং লেখিকা সোয়েতলানা অ্যালেক্সান্ড্রোভনা অ্যালেক্সিয়েভিচ। তিনিই প্রথম সাংবাদিক, এবং প্রথম বেলারুশিয়ান নাগরিক যিনি এই দুর্লভ বিজয়মাল্যে ভূষিত হন। রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমীর স্থায়ী সেক্রেটারি প্রফেসর সারা ডানিয়াস ৮ই অক্টোবর ২০১৫ আনুষ্ঠানিকভাবে সোয়েতলানাকে  সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী ঘোষণা করেন- বহুমাত্রিক লেখনীতে সমকালীন যাতনা এবং সাহসিকতার সৌধের রূপকার হিসেবে। সোয়েতলানা সাহিত্যে ১১২তম এবং নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে ১৪তম নোবেল বিজয়ী। সুইডিশ অ্যাকাডেমীর তরফ থেকে বিজয়ী ঘোষণা করা পরে সোয়েতলানার সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন জুলিয়া চায়কা। টেলিফোনে গ্রহন করা সাক্ষাতকারটির ভাবানুবাদ দেওয়া হল-

 

 

জুলিয়াঃ হ্যালো! আমি জুলিয়া চায়কা বলছি nobelprize.org অফিসিয়াল সাইটের পক্ষ থেকে। এবছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করায় আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে পেরে আমি আনন্দিত।

 

সোয়েতলানাঃ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

 

জুলিয়াঃ আপনিত ইতিমধ্যেই আপনার পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে জেনেছেন তাই না?

 

সোয়েতলানাঃ জ্বী জেনেছি। বিশ্বাসই করতে পারছিনা যে আমি এই পুরস্কার পেয়েছি।

 

জুলিয়াঃ আপনিতো এখন একটা প্রেস কনফারেন্সে যাচ্ছেন তাই না?

 

সোয়েতলানাঃ জ্বী, আমার জন্য ট্যাক্সি অপেক্ষা করছে।

 

জুলিয়াঃ আশাকরি আপনার ২-৩ মিনিট সময় হবে আমাদের এই কথোপকথন এর জন্য। পরবর্তিতে অন্যান্য নোবেল বিজয়ীদের সাক্ষাতকারের সাথে এটিও প্রকাশিত হবে আমাদের সাইটে।

 

সোয়েতলানাঃ জ্বী নিশ্চয়ই।

 

জুলিয়াঃ কেমন লাগছে এই পুরস্কারের ঘোষণার পর? নাকি আমি খুব তাড়াহুড়া করে ফেলছি আপনার প্রতিক্রিয়া জানার ব্যাপারে?

 

সোয়েতলানাঃ (হাসি) তাতো বটেই! তবে আমি বলব আমার অনুভূতি। অবশ্যই এটা অত্যন্ত আনন্দের আর এতে গোপন করার কিছু নেই। সাথে সাথে আমি চিন্তিত এজন্য যে, ইতিপূর্বে যেসব খ্যাতনামা রুশ সাহিত্যিতক নোবেল পেয়েছেন যেমন সোলঝেনিৎসিন, বুনিন, প্যাস্টারনাকের নামের পাশে আমার নাম এসে যাচ্ছে। বেলারুশ থেকে ইতিপূর্বে কেউ এই পুরস্কার পায়নি। আমার চিন্তা হয় এজন্য যে, অনেক কিছু করা হয়েছে। এখনও অনেক কিছু করার বাকি আছে। অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে আরও।

 

জুলিয়াঃ এই সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার লেখার ধরণ সম্পর্কে একটু জানতে চাই। সংবাদ, সাংবাদিকতার ব্যাপারগুলো আপনার লেখাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে?

 

সোয়েতলানাঃ আপনি জানেন বর্তমান বিশ্বে সবকিছুই অনেক দ্রুত প্রগতিশীল। একজন ব্যক্তি বা একটি জাতির একার পক্ষে সবকিছু একসাথে ধারণ করা সম্ভব নয়। সাংবাদিকতার কারণে এক জায়গায় দীর্ঘ সময় বসে পরিকল্পনা করে কোন কিছু লেখা হয়ে ওঠেনি যেটা টলস্টয় পেরেছিলেন। তাঁর লেখনীতে দক্ষতা ও পরিপক্কতার ছাপ সুস্পষ্ট। যে কোন লেখক বা আমার পক্ষেও কোন একটা বিষয় নিয়ে তার উপরে বাস্তবতার ভিত্তিতে আলোকপাত করে কিছু লেখা সম্ভব। কিন্তু কখনও কখনও প্রতিবেদনে আমার লেখা থেকে একশ লাইনের মধ্যে মাত্র দশ লাইন বা মাত্র এক পৃষ্ঠা বেছে নিয়ে হয়েছে। এইসব নিয়েই রচিত হয় আমাদের সমকালীন জীবনের বহুস্বরের উপাখ্যান যাতে প্রতিফলিত হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাপ্রবাহের প্রতিফলন।

 

জুলিয়াঃ মাত্রই আপনি খুব সুন্দর একটা উপমা দিয়েছেন বহুস্বরের উপাখ্যান। আমার পরের প্রশ্ন এটা নিয়েই। আপনি অনেক মানুষের দুর্দশার চাক্ষুশ সাক্ষী। মানুষের এইসব অবস্থা, মানুষের প্রতি আপনার মূল্যবোধ, আপনার লেখনীকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে?

 

সোয়েতলানাঃ আপনার এই প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিত বলতে হলে আমার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। আপাতত আমি বলতে চাই, যে সংস্কৃতিতে আমি লালিত হয়েছি সেখানে আমাকে প্রতিনিয়ত মানুষের সুর্দশার চাক্ষুশ সাক্ষী হতে হয়েছে। যে ঘটনা অন্য কোন জাতির জন্য অভাবনীয় বা অবর্ণনীয়, সেটাই আমার জাতির কাছে খুব স্বাভাবিক ছিল। আমরা প্রতিনিয়ত এর মাঝেই বসবাসে করেছি এবং এটাই ছিল আমাদের আশপাশের অবস্থা। সব পরিবারে এমনকি আমাদের পরিবারেও... ১৯৩৭ সালে, মনে পড়ে যায় চেরনোবিল যুদ্ধের কথা। এটাই অনেক কিছু। সবগুলো পরিবারই আপনাকে এমন সব দুঃখভরা উপাখ্যান শোনাতে পারবে। এটা শুধু আমার নিজের মতামত বা অন্যের ভাবনা নিয়ে আমার মতামত না বরং এটাই প্রকৃত বাস্তবতা। ধরেন একজন মানুষ পাগলা-গারদ থেকে বের হয়ে সে সম্পর্কে কিছু লিখলো। তখন আমি তাকে কি বলব? এই যে শুনুন! আপনি এসব কি লিখেছেন? প্রিমো লেভির কথাই ধরুণ। সে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প সম্পর্কে লিখেছে। নিজেকে টুকরো টুকরো ছিঁড়েও সরাতে পারেনি। অথবা কালামভর কথা ধরুণ। তাকে ওখানে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হল অথচ সে কিছুই লিখে যেতে পারলো না। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি, আমরা আসলে কি? কেন আমাদের এই যন্ত্রণাগুলো স্বাধীনতায় পরিবর্তিত হতে পারে না? এটা আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখন। এই দাস-মনোবৃত্তি কেন বাস্তবতার লড়াইয়ে টিকে থাকবে? কেন আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে বস্তুবাদিতায় পর্যবসিত করি? অথবা কেন আমরা ভীত হই, যেমন আগেও করেছি?

 

জুলিয়াঃ আপনি তাহলে কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন?

 

সোয়েতলানাঃ আমি মনে করি আমার নিজের মধ্যে উদয় হওয়া প্রশ্নগুলো আমি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবো, তখন এর প্রকৃত উত্তর দিতে পারবো। বাস্তবতায় হোক বা লেখনীতে, যখন আমি লিখব, তখন যেন আমি মনে করতে পারি কথাগুলো আমি আমার কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলছি। আমি তাদের বলে যেতে চাই যে আমি এই জীবনে কি উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমি নিজেকে কখনই একজন বিচারকের আসনে বসাইনি। আমি কোন ইতিহাস রচয়িতা নই, কিন্তু আমার মন সর্বদা ইতিহাসেই পড়ে থাকে। বারবার আমাকে যে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়, ভীতিকর এই রাস্তায় আমার কতকাল আমাদের চলতে হবে? একজন মানুষ কতখানি সহ্য করতে পারে? এটাই সম্ভবত বেদনার কাব্যিকতা। আমার কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যখন কেউ বলে, কেই এই বেদনার উপাখ্যান পড়েছে আর তার চোখ দিয়ে হৃদয় নিংড়ানো অশ্রু ঝরেছে। এইসব কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। অহেতুক ভয় দেখান আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

 

জুলিয়াঃ আপনাকে আবারো ধন্যবাদ ও স্বাগতম জানাচ্ছি। আশাকরি আগামী ডিসেম্বরে আপনার সাথে স্টকহোমে দেখা হবে পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে।

 

সোয়েতলানাঃ আপনাকেও ধন্যবাদ। বিদায়।

 

জুলিয়াঃ বিদায়।  


[সূত্রঃ ইন্টারনেট]

 

 

Author's Notes/Comments: 

19th October 2015

View shawon1982's Full Portfolio