পুস্পার বাবা মারা গেছে দুই মাস আগে। মা আশা ইসলাম পার্শ্ববর্তী একটা স্কুলের শিক্ষিকা। পুস্পা সবেমাত্র এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার চিন্তায় খাওয়াদাওয়া, ঘুম ইত্যাদিতে ব্যাপক অনিয়ম হওয়াতে তাকে দেখে এক কংকালের মত মনে হয়। সে মনেমনে ঠিক করে যে পরীক্ষার ফলাফল আসার আগ পর্যন্ত ইচ্ছেমত বন্ধুদের সাথে ঘুরবে, আড্ডা দেবে, নতুন নতুন কিছু ভালো সিনেমা দেখবে ইত্যাদি।
কয়েকদিন আগে পুস্পা ফেইসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছে। তার পরিচিত আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদেরকে ‘ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট’ পাঠিয়েছে। এর মধ্যেই তার বন্ধুর সংখ্যা প্রায় বিশজন হয়ে গেছে। সে তার প্রোফাইলে এখনো নিজের কোনও ছবি দেয়নি। তার একটু ইতস্তত লাগে।
তার শুধুই মনেহয় যে তার ছবি কপি করে কেউ যদি ফেইক বা নকল অ্যাকাউন্ট খুলে! এই ভয়ে সে খুব মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি দিয়ে রেখেছে। তার অন্য প্রায় সব বন্ধু বান্ধবীদের নিজেদের ছবিই প্রোফাইলে দেয়া আছে।
প্রায়ই পুস্পাকে তার বান্ধবীরা খোঁচা দেয়। তারা বলে যে সে নাকি গ্রামের মেয়েদের মত আচরণ করছে। নিজের ছবি দিলে কি হয় ইত্যাদি? সে অবশ্য তাদের কথাকে খুব একটা পাত্তাটাত্তা দেয় না। এক কান দিয়ে ঢুকায় আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়।
বেশ কয়েকদিন পর কি জানি কি মনে করে পুস্পার ইচ্ছে হয় যে সে তার প্রোফাইলে নিজের একটা ছবি দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ছবি দেয়ার পর অনেকেই খুব ভালো ভালো মন্তব্য করে। অনেকেই ‘লাইক’ করে।
পুস্পার মনে হয়েছিল যে ছবিটা খুব একটা ভালো হয়নি। কিন্তু বন্ধুদের এতো প্রশংসাসূচক মন্তব্য পড়ে তার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। ইতোমধ্যে দু তিনজন বান্ধবী তাকে ফোনে জানিয়েছে যে ফেইসবুকে তার ছবি দেখে সবাই বেশ পুলকিত। পুস্পা স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত আবার সাথে সাথে কিছুটা লজ্জিতও বোধ করে। নিজেকে ‘স্টার, স্টার’ মনে হয়!
যাইহোক, রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যাবার আগে পুস্পা একবার ফেইসবুকে ঢুঁ মারার কথা ভাবে। কম্পিউটারের ‘স্টার্ট’ বাটনটি চালু করে দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত দাঁত ব্রাশ করে ফিরে আসে। ততক্ষণে কম্পিউটার চালু হয়ে গেছে। ফেইসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে ঢুকেই সে ১০টা ‘ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট’ দেখে।
সে গণহারে যাকে তাকে ফেইসবুকে বন্ধু বানায় না। ৯টা ‘ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট’ বাতিল করে দেয়ার পর শেষের একটা ‘রিকুয়েস্ট’ সে গ্রহণ করে। অ্যাকাউন্টটা একটা ছেলের। নাম শুভ আহমেদ। একটা কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। সেই মুহুর্তে তার মা রুমে প্রবেশ করেন।
- কি রে এখনো ঘুমাসনি?
- এইতো মা ঘুমাতে যাচ্ছি।
- রাত জেগে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকলে চোখের নিচে কালি পড়ে, বুঝলি? ঘুম নষ্ট হয়। নিজের খেয়াল রাখতে শিখ এখন থেকে।
- খেয়াল রাখি তো মা। তোমার সব কথা কি আমি শুনি না বলো?
- আচ্ছা ঠিক আছে। আর কোনও কথা না। সোজা বিছানায় যাও।
সাবধানী হরিণী যেমন গলা উঁচু করে দেখে, ঠিক তেমনি পুস্পা বিছানায় যাবার পরে তার মা খেয়াল করে দেখে সে আদৌ ঘুমাতে গিয়েছে নাকি ভান করছে? নিশ্চিত হবার পর যাবার পথে দরজা বন্ধ করার সময় পুস্পার কণ্ঠ শুনতে পায়,
- আই লাভ ইউ মা।
- ‘আই লাভ ইউ টু’ আমার লক্ষ্মী মেয়ে।
- গুডনাইট, সুইট ড্রিমস।
- গুডনাইট।
এরপর কয়েকদিন ধরে শুভ পুস্পার সাথে চ্যাট করে। মনে হয় যেন তারা একে অপরকে অনেকদিন থেকেই চেনে। শুভ খুব সুন্দর করে কথা বলে। অক্সিজেন ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না ঠিক তেমনি পুস্পার প্রতিদিন একবার অন্তত শুভর সাথে কথা না হলে ভালো লাগে না। পুস্পা মনেমনে ভাবে এটাকেই কি প্রেম বলে?
যার সাথে কথা হয় তাকে কাছে পেতে ইচ্ছে হয়। স্পর্শ করতে মন চায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার সাধ জাগে। আশেপাশের সবকিছুই সুন্দর মনে হয়। চোখের সামনে যেন রংধনুর ছড়াছড়ি। এ অনুভূতি শুধুই একান্ত। যেন এক তীব্র মাদকতা ভর করে আছে পুস্পার মনেপ্রাণে! এটা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
এখন পর্যন্ত শুভ আর পুস্পার কথা ফেইসবুক চ্যাট পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। ফোনে কথা হয়নি। পুস্পার খুব ইচ্ছে হয় শুভর কণ্ঠস্বর শুনতে। ফোনে তাকে চুমু খেতে। কিন্তু তার লজ্জা এতই বেশী যে সে কখনো ফোন নাম্বারের কথা শুভকে বলতে পারবে বলে মনে হয় না।
সৌভাগ্যবশত একদিন শুভ পুস্পার কাছে ফোন নাম্বারটা চায়। পুস্পা তখন লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে সাথে সাথে দেয়নি তবে বলেছে পরে দেবে। ঐ দিনের পর থেকে সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। সে নিজেই এতোদিন ধরে শুভর সাথে ফোনে কথা বলতে চেয়েছে, আর এখন যখন ঐ সুযোগটা সামনে এসেছে, কেন জানি তার মন সায় দিচ্ছে না।
তার শুধুই মনে হয় যে ফোনে যখন তখন কথা বললে আম্মু শুনে ফেলতে পারে। দুর্ঘটনাবশত ম্যাসেজ পড়ে ফেলতে পারে। সর্বোপরি হাতেনাতে ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু সে শুভকে কথা দিয়েছে যে নাম্বারটা পরে দেবে। সে যে এখন কি করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না!
এ বয়সে ভুল বা অন্যায় বলে কিছুই মনে হয় না। মন যা করতে মন চায়, তাই মনে হয় সঠিক। কেউ যদি বাধা দিতে আসে তখন তাকে ঘোর শত্রুর মত মনে হয়- “All is fair in love and war!”
পুস্পা ফোন নাম্বারটা শুভকে দেয় চ্যাটের মাধ্যমে। যেই মুহূর্তে সে নাম্বার পেয়েছে ঠিক তার দুই মিনিটের মধ্যে পুস্পার ফোনে কল আসে। পুস্পার বুঝতে একটুও বাকী থাকে না যে এটা শুভর ফোন। সে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। বিশেষ করে তার কানের লতি যেন আগুনে পুড়ছে।
কয়েকবার রিং হয়েছে। পুস্পা হাত বাড়িয়ে ফোনটা নেয় আবার রেখে দেয়। ফোন ধরার পর কি কথা বলবে এই চিন্তায় সে ফোন ধরতে চায় না। অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা বাজতেই থাকে। অবশেষে শুভর জন্য পুস্পার মায়া হয়।
সে ফোনটা ধরে। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো পুস্পা’ কানে আসতেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে সে লাইনটা কেটে দেয়। ফোন ক্লান্তিহীনভাবে বাজতেই থাকে!
পরেরদিন থেকে নিয়মিত তাদের মধ্যে কথা হতে থাকে। ফোনে কথা বলা যেন খাবার খাওয়ার মত দৈনন্দিন কাজের অংশ হয়ে গেছে। একদিন কথা না হলে যেন কেউই বাঁচবে না। এভাবে অনেকদিন চলে। একদিন শুভ পুস্পাকে দেখা করতে বলে। সে প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। সে বলে,
- কি?
- আরে বাবা, তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
- না, না, অসম্ভব!
- অসম্ভব? কেন? সমস্যা কি?
- সমস্যার পাহাড়, আর তুমি বলছো সমস্যা কি?
- কি অসুবিধা বলো আমাকে?
- কেউ যদি দেখে ফেলে?
- ঢাকা এতো বড় শহর! কে দেখবে?
- না বাবা, আমার খুব ভয় লাগে। যদি আমার আত্মীয়স্বজনরা কেউ দেখে তাহলে আমাকে জানে মেরে ফেলবে। আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে। এমনকি বাইরে বের হওয়া এবং ফোনে কথা বলাও নিষিদ্ধ হবে।
- তুমি খামাখা এতোসব ভাবছো! আমার উপর বিশ্বাস রাখো, কিছুই হবে না।
- কিছুই হবে না বললেই হলো? আর তোমার এতো দেখা করার সাধ কেন?
- তোমার সাথে একটু একান্ত সময় কাটাতে চাই আর কি।
- তোমার মতলবটা কি?
- কি যে বলো না? আমার আবার কি মতলব? প্লীজ বাবা, একবার দেখা করি। তারপর আর কখনো বলবো না, কথা দিচ্ছি।
- তুমি যে আমাকে কোন বিপদে ফেলবা আল্লাহই জানেন!
- আরে কোনও বিপদ-টিপদ কিচ্ছু হবে না। আমি আছি না? সব ঠিক করে ফেলবো।
- আচ্ছা দেখি চিন্তা করে। তবে আমি কোনও কথা দিতে পারবো না। কোনও এক সময় চেষ্টা করে দেখতে পারি।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তুমি মন থেকে চাইলে ঠিকই পারবা আমি জানি।
- এখন রাখি। বাই।
- বাই, সি ইউ।
তারপর একদিন দুই ভালোবাসার পাখির দেখা হয়। শুভ পুস্পাকে এক নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করায় যার সম্পর্কে এতোদিন তার মনে লজ্জা আর ভয়ের এক ধুম্রজাল মাকড়শার জালের মত জড়িয়ে ছিল। যে দুনিয়ায় প্রেম, স্পর্শ, ব্যথা, সুখ সবই আছে। যার শেষ প্রান্তে বিরাজ করে ঝড়ের পরের নিস্তব্ধতার মত বোধহীন, প্রায় প্রাণহীন মন!
পুস্পা খুব দ্রুত বাসায় ফিরে আসে। আজ অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে সে। যেন শরীর এবং মনের সকল নোংরা আবর্জনা নিস্পাপ পানির তোড়ে সময়ের অতল গহ্বরে বিলীন করে দেবে।
একদিন বান্ধবীর কাছ থেকে শুনে যে এইচ.এস.সি.-র ফল বের হয়েছে। কেন জানি পুস্পার আগ্রহ নেই ফল জানার ব্যাপারে। পরে সে জেনেছে যে সে A- পেয়েছে। পরিবারের সবাই খুব হতাশ। বিশেষ করে পুস্পার মা। উনি নিশ্চিত ছিলেন যে তার মেয়ে A+ পাবে।
পুস্পার মন খারাপ অন্য কারণে। শুভর সাথে দেখা করে আসার পর থেকে সে নিজেকে খুব দোষী মনে করছে। কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলতেও পারছে না। শুভ রীতিমতো ফোন করে কিন্তু তার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না।
একদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন ধরে। শুভ তার সাথে আবার দেখা করতে বলে। এ কথা শুনেই পুস্পা ফোন কেটে দিয়ে সুইচ বন্ধ করে দেয়। দিনে দিনে পুস্পা যেন পড়ন্ত বিকেলের আধমরা ফুলের মত হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে একদিন তার ফোনে একটা এম.এম.এস. আসে। নাম্বারটা শুভর। সে বেশ অবাক হয়ে সেটা দেখে।
কিছুক্ষণ পর তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। পুস্পা গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ার মত ধপাস করে বিছানায় আছড়ে পড়ে। তার মনে হয় সে যেন এক মরুভূমির মাঝখানে সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে যেখানে সে তার চোখ খুলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না!
আজ শুক্রবার। পুস্পার মা দুপুরে পুস্পার রুমে এসে তাকে না পেয়ে ফিরে যান। মা ভাবেন সে হয়তো ওয়াশরুমে আছে। কিছুক্ষণ পর এসে ওয়াশরুমের দরজায় অনবরত ধাক্কা দিতে থাকেন এবং “পুস্পা, পুস্পা” বলে চিৎকার করতে থাকেন।
কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ মেলে না। আতঙ্কে আশার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার মত অবস্থা। ওনার বারবার মনে হতে থাকে যে পুস্পার এইচ.এস.সি-র ফল ভালো হয়নি এ হতাশায় সে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসেনিতো?
আশেপাশের লোকজনের সহায়তায় অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর দরজা ভেঙ্গে পুস্পাকে মেঝেতে বেহুঁশ অবস্থায় পাওয়া যায়। তার এক হাতের রগ কাটা। রক্তের বন্যা বয়ে গেছে যেন। হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তাররা খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারেনি পুস্পার মাকে। ইতোমধ্যে আরও অনেক আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে।
এদিকে পুস্পা নামক নিস্পাপ ফুলের মত একটি প্রাণ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। অন্যদিকে শুভ নামের অশুভ শয়তান পুস্পার সাথে শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে। অনেকেই বিষয়টা জেনে গেছে।
পুস্পার এক বান্ধবী পুস্পাকে ফোনে না পেয়ে তার মাকে এ ব্যাপারে জানিয়েছে। তার মা যেন একটা জীবন্ত কাঠ হয়ে গেছেন। কান্নার ক্ষমতাও যেন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
সন্ধ্যার দিকে পুস্পা এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া চিরতরে ত্যাগ করে পরপারে চলে যায়। পেছনে রেখে যায় সৈকতে পড়ে থাকা সোনালী বালির মত কিছু স্মৃতি, হতাশা আর কষ্টময় উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস!
পুলিশ নাকি তার কাজ করছে! আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে!