মেয়েটির নাম সখিনা খাতুন। বয়স ২২ বছর। তার বাবা সুরুজ মিয়া রিক্সা চালিয়ে কোনোমতে সংসারের যক্ষাক্রান্ত শরীরটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সখিনার মা বিউটি খাতুন বছর জুড়ে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। যে কোনও দিন ওপাড়ে যাবার ডাক পড়বে। তার মায়ের খুব ইচ্ছে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে সখিনার বিয়েটা দেখা।
এলাকার ছ্যাঁচড়া ছেলের দল সখিনাকে রাস্তাঘাটে উত্যক্ত করে। কেউ কেউ প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কেউ আবার তার ওড়না ধরে টান দেয়। বয়স্কদের মধ্যে দু একজন তাকে বিভিন্ন কু-প্রস্তাবও দিয়েছে। এসব নিয়ে সখিনার মন খারাপ থাকতো প্রায়ই।
তার একজন বান্ধবী এসব সম্পর্কে জানে। সখিনা দু একটা ঘটনা মাকেও বলেছে। তার মা ওনার স্বামীকে সবকিছু খুলে বলেছে। উনি বারবার সখিনার বাবাকে বলেছেন তাড়াতাড়ি সখিনার জন্য একটা ভালো ছেলে খুঁজে বিয়ে দিয়ে দিতে। পরে কখন কোন বিপদ হয়!
সখিনার বাবার ইচ্ছে নেই এখনই সখিনার বিয়ে দেবার। কিন্তু স্ত্রীর কথায়ও যুক্তি আছে। দিনকাল খুব খারাপ। মানুষের উপর আর বিশ্বাস নেই। একেকটা যেন পশু হয়ে গেছে। যদিও পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাঙ্গা গরুর গাড়ির মত, তবুও সখিনার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করে দেয় তার বাবা।
সুরুজের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে যৌতুক। সখিনার গায়ের রং একটু ফর্সা হলে এতো চিন্তা করতে হতোনা। একেতো শ্যামলা মেয়ে, তার উপর যৌতুক নামক পাহাড়। সুরুজের রিক্সাটাই তার সম্বল। এটা তার সন্তানের মত। বিয়ের খরচাপাতি এবং আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্রের যোগাড় কিভাবে হবে সুরুজ তা ভেবে পায়না। কেউ তাকে টাকা ধার দিবে এমন নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে।
ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাইহোক, কয়েকদিন পরেই সুরুজের কাছে এক লোক আসে। লোকটা একটু বয়স্ক। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। ওনাকে উঠানে চেয়ার টেনে বসতে দেয় সুরুজ। লোকটাকে এর আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হয়না। সুরুজ মনেমনে ভাবে এমনিতেই এতো সমস্যার সাথে প্রতিদিন তাকে যুদ্ধ করতে হয়, নতুন কোনও আপদ না হলেই ভালো।
-মুরব্বী, কিছু মনে কইরেন না। জি আফনারে ঠিক চিনতে পারলাম না।
-হে, হে, হে, আমারে ছিনার কোনও কারণ নাই।
-জ্যা?
-মানে আমারে আফনে না ছিনারই কতা।
-তো আমি আফনারে কেমনে সাহাইয্য করতে ফারি?
-এক গেলাস ফানি খাইতে ফারমু নি? গলাডা একটু ভিজাইয়া কই?
-সখিনা, গেলাস ধুইয়া এক গেলাস ফানি আন।
সখিনা পানির গ্লাস নিয়ে এসে মুরব্বী লোকটার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার মাথায় ওড়নাটা নতুন বউয়ের ঘোমটার মত জড়ানো। লোকটা সখিনার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় গ্লাসটি হাতে নেয়। সখিনা তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে যায়। কিন্তু লোকটির দৃষ্টি সখিনার উপর থেকে সরেনা।
-জি, আমার নাম হইল গিয়া কুদ্দুস আলী। আমি আফনার মাইয়াডার লাইজ্ঞা একটা খুব ভালো ফাস্ট কেলাস সম্বন্ধ আনছি।
-আফনে আমাগো সম্বন্ধে কেমনে জানলেন?
-এইসব জাইনা কি কোনও লাভ অইব? আসল কথায় আহেন।
-পোলার নাম কি?
-আক্কেল আলী।
-কি করে?
-পোলায় আপাতত কিছু করেনা তয় কয়েকমাসের মইধ্যেই বিলেত যাইব। তহন দেশে টেকা ফাডাইব।
-পোলার পরিবার?
-পোলা তার বাপ মারে লইয়া পাশের গেরামে থাকে। মা বাপের একমাত্র পোলা। এক্কেবারে কলিজার টুকরা! বাপে টেম্পু চালায়। মা পাশের ইটভাঁটায় কাম করে।
-কিছু মনে কইরেন না মুরব্বী? আফনের কাছে কি পোলার কোনও ছবি আছে?
-আছে, আমি লগে ছবি লইয়া আইছি। এই লন।
-আফনার লগে কথা কইয়া খুব ভালো লাগছে আমার। ছবিটা রাখলাম কারণ আমার পরিবাররে একটু দেখাইতে চাই।
-হে, অবশ্যই দেখান।
-তারার পছন্দ অইলে কথা আগান যাইব।
-আলহামদুলিল্লাহ্, আশা করি পছন্দ অইব।
-আফনে কষ্ট কইরা আফনার ফোন নাম্বারটা দিলে ভালো হয়। আমি আফনারে ফোন দিয়া জানাইতে ফারমু।
-জি, জি, জি, অবশ্যই। এই নেন আমার কার্ড। ঐ যে একদম কোনায় আমার নাম্বার দেয়া আছে। ঘটকালী করাই আমার কাম। হে, হে, হে।
-অনেক খুশী হইলাম।
-এইবার যে উঠতে হয়।
-দুপুরে আমাগো লগে চাইরটা ডাইল ভাত খাইয়া জান?
সুরুজ ভেবেছে হয়তো ‘না’ বলবে কিন্তু লোকটি বলে-
-আইচ্ছা ঠিক আছে, আফনে যখন কইতাছেন তাইলে দুপুরে খাইয়াই যাই। হে, হে, হে। রিজিকের মালিক আল্লাহ। আইজ আফনার এইখানেই আমার রিজিক লেখা আছিল।
বেচারা সুরুজ! দরজার চিপায় আঙ্গুল চাপ খেলে যেমন ব্যথা ও জ্বালা অনুভূত হয়, সুরুজের অবস্থাও অনেকটা সেই রকম! শেষপর্যন্ত পেটপুরে খেয়েই বিদায় হয় কুদ্দুস।
ছেলের ছবি বিউটির পছন্দ হয়েছে। সখিনা একপলক দেখেই লজ্জায় দৌড়ে পালিয়েছে। সুরুজ এবং বিউটি বেশ খুশী। তাদের একটাই কামনা- একমাত্র মেয়েটার বিয়েটা যাতে ভালোমতো হয় আর সে যেন আজীবন সুখী হয়।
মোটামুটি খরচের মধ্যেই বিয়েটা হয়েছে। কিন্তু সুরুজের জন্য একটা সমস্যা অপেক্ষা করে আছে। বরপক্ষ নগদ বিশ হাজার টাকা দাবী করেছে কিন্তু সুরুজের পক্ষে এতো বড় অংকের টাকা দেয়া সম্ভব নয়, তাও আবার নগদ!
বরের বাবা দয়া ইসলামকে আড়ালে নিয়ে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজী করেছে। টাকাটা সে বিয়ের পর কিস্তিতে দেবে।
বিয়ের এক মাস পর সুরুজ মেয়েকে দেখতে তার শ্বশুর বাড়ি যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ব্যাবহার এতই খারাপ ছিল যেন মনে হয়েছে কোনও মানুষ নয় একটা কুকুর এসেছে বাড়িতে।
বিউটি তার বাবার সামনে এলো ঠিকই কিন্তু কোনও কথা বলেনা। সুরুজের আর বুঝতে বাকি রইল না যে মানব সম্পর্কগুলোকে মাপা হচ্ছে টাকা দিয়ে, সেখানে মায়া-মমতা এবং সম্মানের স্থান নেই। ফিরে যাবার আগে বেয়াই সাহেবের হাতে ৫০০০ টাকা গুঁজে দিয়ে বুক কাঁপা কণ্ঠে বলেন,
-আমার মাইয়াডারে দেইখা রাইখেন। বড়ই আদরের মাইয়া আমার।
দয়া টাকাটা নিয়ে আর কোনও কথা না বলে সোজা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সুরুজের মনে হল সে যেন দরজায় দাঁড়ানো নামহীন এক ফকির যে এক মুঠো চালের জন্য আর্তনাদ করছে আর বাড়ির কর্তা তাকে দেখেই ঘৃণাভরে মুখের উপর দরজা বন্ধ করছে।
সুরুজ সখিনার মাথায় হাত বুলাতেই তার মনের বাঁধ যেন ভেঙ্গে গেছে। সে তার বাবার কোলে মাথা রেখে বাচ্চা শিশুর মত কাঁদছে। যেন আকাশে কালো মেঘের দল জমতে জমতে এমন ভারী হয়েছে যে বৃষ্টি হয়ে ধরণীতে নেমে আসতেই হল। সে বলে,
-বাবা, আমারে এইখান থাইকা লইয়া যাও। আমারে তুমি বাঁচাও।
সুরুজ আর কোনও কথা না বলেই চলে যায়। তিনমাস পরে দয়া সুরুজকে ফোনে জানায় যে সখিনা রান্নাঘরে দুর্ঘটনাবশত পুড়ে মারা গেছে।