কুমিল্লার ছোটরা কলোনি নামক স্থানে থাকতো মাহফুজ এবং তার বাবা মা। যে বাসায় ছিল সেটার সামনে কোন মাঠ ছিল না। তাই খেলাধুলার সুযোগ খুব একটা ছিল না বললেই চলে। স্কুলে টিফিন বিরতির সময় ইচ্ছেমত দৌড়ে আর লাফালাফি করে বিকেলে খেলতে না পারার সাধ মিটিয়ে নিতো।
মাঝে মাঝে বিকেলবেলা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে এলাকার বন্ধুদের সাথে হেঁটে রওনা হতো বাসা থেকে খানিকটা দূরের ঈদগায়। ওখানটার অর্ধেক পাকা আর বাকি অর্ধেক ছিল ঘাসযুক্ত খোলা জায়গা।
বেশ খানিকটা হাঁটতে হয় বলে তারা সেখানে খুব একটা যেতো না। তাছাড়া ওখানে সময়মত পৌঁছতে না পারলে অন্যরা এসে মাঠ দখল করে খেলা শুরু করে দিতো। তারপরও ঈদগায় যাওয়ার মধ্যে একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতো। নতুন নতুন বন্ধু তৈরির একটা আদর্শ জায়গা ছিল সেটা। নতুন নতুন শত্রুও তৈরি হতো বটে!
একদিন যথারীতি রাস্তা পার হয়ে ঈদগাহর দিকে যাবার সময় একটা ঘটনা মাহফুজের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সে লক্ষ্য করলো যে একটা বাড়ীর সামনে অনেক পুরুষ এবং মহিলার লম্বা লাইন।
পুরুষদের উপস্থিতি তুলনামুলকভাবে কম কিন্তু মহিলা এবং যুবতী মেয়েদের সংখ্যা অনেক। কিছু কিছু মহিলাদের কোলে ছোট ছোট বাচ্চা। বাসার ভেতর থেকে একজন বের হবার পর ক্রমানুসারে আরেকজন প্রবেশ করছিলো। মাহফুজ তার বন্ধু ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলো,
- দোস্ত, ঐখানে এতো লম্বা লাইন কিসের?
- কি বলছিস মাহফুজ, তুইতো জানিস!
- বিদ্যা বলছি, কসম আল্লাহর, আমি জানি না!
- ফাজলামো রাখ! তাড়াতাড়ি চল, পরে মাঠ দখল হয়ে যাবে।
- বলনা শালা।
- ঐ বাসায় এক সাধু বাবা থাকেন।
- নাম কি?
- ভোলা, কিন্তু উনার ভক্তরা তাঁকে ‘ভোলা বাবা’ বলেই ডাকে।
- তো? উনি কি করেন ওখানে? আর মানুষগুলো এভাবে লাইন ধরে ঢুকছে আর বের হচ্ছে কেন?
- আমি নিজেও তেমন একটা জানি না, তবে শুনেছি বাবা নাকি পানিপরা টানিপরা জাতীয় কিছু একটা দেয়।
- তুই বিশ্বাস করিস এগুলো?
- জানি না দোস্ত, বিশ্বাস করি কিনা জানি না, বিশ্বাস করি না কিনা তাও জানি না।
- মানে? কি পাগলের মত কথা বলছিস?
- আসলে এসব নিয়ে কখনও ভাবিনি বন্ধু। ভাবতেও চাই না।
কেন জানি ফাহিমের এই কথাগুলো মাহফুজের মনে এক গভীর দাগ কেটে গেলো। অন্য কেউ হলে হয়তো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতো, কিন্তু মাহফুজ সবার চেয়ে একটু আলাদা। ছোটবেলা থেকেই একটু বেশী কৌতূহলী প্রকৃতির ছেলে সে। কোনো জিনিস সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে না জানা পর্যন্ত তার মনে শান্তি আসে না। তার জানার অদম্য আগ্রহের সাথে ম্যাথিউ আর্নল্ডের “দ্যা স্কলার জিপসি” কবিতার স্কলার মানে পণ্ডিতের তুলনা করলে খুব একটা বাড়াবাড়ি হবে না। মাহফুজ যেন একটা ক্ষুদে পণ্ডিত!
একদিন ভোলার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হলো যে তার এক বন্ধু থাকে বাবা ভোলার বাসার আশেপাশেই। বন্ধুটির নাম সত্য দাস। অনেকদিন ধরে সত্যকে সে ক্লাসে দেখেনি। হয়ত অসুস্থ সে, কে জানে? অবশেষে তার আশা পূর্ণ হলো। সত্যের দেখা সে পেলো। স্কুলে এসব নিয়ে আলাপ করার মত পর্যাপ্ত সময় বা সুযোগ ছিল না।
তারপরও অতি আগ্রহের ঠেলায় ক্লাসে একটু পর পর সত্যকে ঐ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিল। ইতোমধ্যে স্যার দুবার চোখ রাঙ্গানি দিয়েছিলেন। পরেরবার নিশ্চিতভাবে হাতের উপর বেতের বাড়ি পড়বে খুব জোরেশোরে; এতে কোনও সন্দেহই নেই!
অতএব, তারা সাবধান হয়ে মনোযোগের সাথে স্যারের কথা শুনতে লাগলো। মাহফুজ মনেমনে ভাবতে লাগলো কখন ছুটির ঘণ্টা বাজবে আর সে তার বন্ধুকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসল ঘটনা শুনবে। যেহেতু সত্যের বাসা ঐ ভোলা বাবার বাসার পাশে, সেহেতু সে কিছু না কিছু তো জানবেই।
ছুটির ঘণ্টা বাজলো। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সব ছাত্ররা দৌড় শুরু করলো। মনে হলো যেন কোন দৌড় প্রতিযোগীতা চলছিল! কে কার আগে যেতে পারে! ভিড়ের মধ্যে সত্য যে কোথায় হারিয়ে গেলো মাহফুজ তা বুঝে উঠতে পারলো না।
অনেকক্ষণ তার দৃষ্টিগোচরেই ছিল। মাঠে এসে এদিক ওদিক তাকানোর পর সত্যকে দেখতে পেয়ে চিৎকার দিলো-
- সত্য, এই সত্য!
সে শুনলো না। মাহফুজও দ্রুতগতিতে দৌড়ানো শুরু করলো আর ‘সত্য সত্য’ বলে ডাকতে থাকলো। আসলে স্কুলের বাইরে ছুটির সময় এত চিৎকার চেঁচামেচি হয় যে কারো ডাক পরিস্কারভাবে শুনতে পাওয়া খুব মুশকিল। যাইহোক, অবশেষে সত্য মাহফুজের ডাক শুনলো। মাহফুজ তার সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
- দোস্ত, কথা আছে।
- কি কথা?
- চল হাঁটতে হাঁটতে বলি।
এই ফাঁকে মাহফুজ তার ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে পানি খেলো। পানি খুব একটা ছিল না। সত্যের কাছে চাইলো,
- তোর বোতলে পানি আছে?
সত্য একটু বিরক্তির সাথে পানির বোতলটা বের করে মাহফুজের হাতে দিলো। মাহফুজ এমনভাবে পানি খেলো যেন সে জীবনেও পানি খায়নি! বোতলটা ফিরিয়ে দিতে দিতে সত্যকে বলল,
- বন্ধু, তোর বাসার পাশে একজন বাবা থাকেন না?
- হ্যাঁ, থাকেনতো।
- উনি নাকি কি সব ঝাড়ফুঁক করে।
- হ্যাঁ, এটাতো সবাই জানে।
- না মানে, ঠিক আছে, আমি একটু বিস্তারিত জানতে চাই আর কি।
- মাগনা বলবো কেন?
- মানে? এর জন্য আবার কি চাস?
সত্যের একটা শখ ছিল সেটা হলো বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেট সংগ্রহ করা। মাহফুজেরও ছিল কিন্তু সত্যের মতো এত তীব্র ঝোঁক ছিল না।
- আমার কাছে গিনি দেশটার কোন ডাকটিকেট নেই। তুই আমাকে দিলে তবেই বলবো।
- জো হুকুম জাহাপনা, কথা দিলাম। দিবো।
- তোর বিশ্বাস নাই, বিদ্যা বল।
- কি যন্ত্রণা! এর জন্য আবার বিদ্যা বলতে হবে?
- হ্যাঁ হবে। তুই যদি পরে ধোঁকা দিস।
- আচ্ছা বিদ্যা, খুশি এখন।
- না হয়নি, তিনবার বল, জোরে জোরে।
- বিদ্যা, বিদ্যা, বিদ্যা! তিন বিদ্যা। হয়েছে?
- হ্যাঁ, হয়েছে। কি জানতে চাস তাড়াতাড়ি বল। বাসায় সময়মত না গেলে আম্মু মারবে।
- ঐ ভোলা বাবার কাছে কারা যায়, কি সমস্যা নিয়ে যায়- এই এসব আর কি।
- মানুষের সমস্যার কি আর শেষ আছে? একেকজনের এক এক সমস্যা, সত্য একটু হেসে বললো।
- দু একটা ঘটনা বলনা শুনি।
- কেউ ভোলা বাবার কাছে আসে ধন সম্পদ প্রাপ্তির আসায়, কেউবা পরীক্ষায় ভাল নাম্বার পেতে। নিঃসন্তান দম্পতিরা আসে সন্তান লাভের আসায় ইত্যাদি।
- মানে? ওনার কাছে গেলেই সবার মনের আশা পূর্ণ হয় নাকি?
- হ্যাঁ, লোকজনতো তাই বলে।
- তুই গিয়েছিলি কখনও?
- না বাবা! কেন জানি এসব ঝাড়ফুঁক আমার ভয় করে। একবার আম্মু চেষ্টা করেছিল আমাকে ভোলা বাবার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। আমি এমন কান্নাকাটি শুরু করলাম যে আমাকে দ্বিতীয়বার এ ব্যাপারে বলার সাহস করেননি।
- ভোলা বাবা এসবের বিনিময়ে ভক্তদের কাছ থেকে কিছু নেন না?
- কারো সাথে নির্দিষ্ট করে কিছু আনতে হবে এমন নয়। তবে ভক্তরা ওনাকে খুব সম্মান করে বলেই মাঝেমাঝে চাল, ছাগল, নিজের গাছে ধরা আম, পেঁপে ইত্যাদি সাথে করে নিয়ে যায় তাঁকে দেওয়ার জন্য।
- তোর বাসাতো প্রায় চলেই এলোরে সত্য!
- হ্যাঁ, এখন যাই দোস্ত, পরে কথা হবে।
- আচ্ছা দাঁড়া, এক মিনিট, প্লিজ!
- আর কি জানার আছে? সবইতো বললাম। এর বেশী কিছু জানি না আমি।
- শেষ একটা জিনিস জানতে চাই তোর কাছে।
- কি?
- যারা নিঃসন্তান তারা ওনার কাছে যাবার পর কি সন্তান লাভ করে নাকি?
- এটা সত্যি।
- কিভাবে?
- শুনেছি উনি এক গ্লাস পানিতে ফুঁ দিয়ে ওটা নির্দিষ্ট মহিলাকে পান করতে বলেন।
- ব্যস? এটুকুতেই বাচ্চা হয়ে যায়?
- আরে না গর্দভ! এই সমস্যার সমাধান পেতে বেশ কয়েকবার ওনার কাছে যেতে হয় তারপর ফল পাওয়া যায়।
- বুঝলাম।
- আমাদের পাশের বাসার এক মহিলার বাচ্চা হচ্ছিলো না অনেকদিন ধরে। পরে ভোলা বাবার কাছে যাওয়াতে কয়েকদিন আগে একটা ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছে।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ।
- তাহলেতো ওনার সত্যি সত্যি কোন স্বর্গীয় ক্ষমতা আছেরে!
- কি জানি। একবার কি হয়েছে শোন। এক লোকের মাথায় চুল নাই বললেই চলে।
- মানে স্টেডিয়াম?
- ঠিক তাই। যে দু একটা চুল আছে তাও পরে যাবার অপেক্ষায় আছে। একদিন ঐ লোকটা ভোলা বাবার কাছে গেলো ওনার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে।
- যাতে মাথায় নতুন চুল গজায় এই জন্য?
- হ্যাঁ, লোকটা বাবার কাছে গিয়ে বললো যে মাথায় চুল কম বলে তার বউ প্রতিদিন খোটা দেয়। এলাকার মানুষ নাকি আঙ্কেল বলে ডাকে আর তাকে দেখলেই বলে- “দেখ, দেখ, কি সুন্দর স্টেডিয়াম যায়!” হা, হা, হা!
- তো ভোলা বাবা কি সমাধান দিলেন?
- ভোলা বাবা ওনার পাশে রাখা তেলের বোতল থেকে হাতে তেল ঢেলে ঐ টাক লোকটার মাথায় মালিশ করে দিলেন। লোকটাকে এক বোতল তেল দিয়ে বললেন প্রতি রাতে মাথায় মালিশ করার জন্য। তারপর লোকটা জিজ্ঞেস করলো যে খাওয়ার আগে মালিশ করবে নাকি পরে? হা, হা, হা।
- হাবা! হা, হা, হা। বেশ মজা লাগলো। এরকম আরেকটা ঘটনা বলনা?
- আরেকবার ভোলা বাবার কাছে এক বিদেশী এসেছে পেটের সমস্যা নিয়ে।
- পেটের ব্যথা নাকি?
- হ্যাঁ, কিন্তু সমস্যা হলো এই যে বিদেশীটা বাংলা বলতে পারে না আর বাবা ভোলা বাবা ইংরেজি বোঝেন না।
- পরে সমাধান হলো কি করে?
- সমাধান কিছুই হয়নি। এক মজার কাণ্ড ঘটেছে।
- কি!
- বিদেশী যে কথাই বলে, ভোলা বাবা শুধু চার পাঁচটা শব্দ বলে- ‘ইয়েস’, ‘নো’ ‘গুড’ আর ‘থ্যাঙ্ক ইউ’!
- যেমন?
- বিদেশী বলে, বাবা, ‘আই এম ডাইং’, ভোলা বাবা বলে, ‘গুড’। বিদেশী বলে, বাবা, ‘প্লিজ ডু সামথিং’, ভোলা বাবা বলে, ‘নো’। বিদেশী বলে, ‘হোয়াট আর ইউ সেইং বাবা?’, ভোলা বাবা বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’! হা, হা, হা!
- আসলেই মজার কাণ্ড, হা, হা, হা!
- এখন যাইরে। ভালো থাকিস। স্কুলে দেখা হবে।
দৌড় দিয়ে বাসার দিকে যাবার সময় সত্য হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। মাহফুজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
- তুই তোর কসম ভুলে যাবি নাতো?
- তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমি আমার কথা রাখবো।
সত্যি কথা বলতে কি ঐদিন ভোলা বাবার প্রতি মাহফুজের শ্রদ্ধাবোধ হলো। ওনাকে এক নজর দেখার সাধ জাগলো তার মনে। পরদিন স্কুলে যাবার সময় এক আতঙ্কিত পরিস্থিতির মুখামুখি হলো সে। দেখলো যে ভোলা বাবার বাসার সামনে অনেক মানুষের ভিড়।
সাধারণত ভক্তরা সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়, কিন্তু আজ ঘটনা ঠিক উলটো। মানুষগুলো যেন জটলা পাকিয়ে আছে। কেউ চিৎকার করছে, কেউবা ভোলা বাবার বাসার দরজায় লাথি মারছে, কেউ ইট ছুড়ছে জানালার দিকে। সে এক তুলকালাম কাণ্ড! মাহফুজের কানে এলো যে কেউ একজন বলছে পুলিশে খবর দিতে।
‘পুলিশ’ শব্দটা শুনে মাহফুজের শরীরের রক্ত হিম হবার জোগাড়। সে ভাবলো যে কেউ খুনটুন হয়নিতো? যাইহোক, অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে সে স্কুলে গেলো। আজ সত্যকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে বলে সে মনঃস্থির করলো। কিন্তু সত্য আসেনি। মনটা একটু খারাপ হলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে মাহফুজ বারবার ভোলা বাবার বাসার দিকে তাকাচ্ছিলো। কেন জানি তার মনে হচ্ছিলো যে সত্যকে আশেপাশে দেখতে পাবে। ঐ রাতে আর ঘুম হয়নি তার।
পরদিন সত্যকে মাহফুজ স্কুলে পেলো। টিফিন বিরতির সময় তাকে জিজ্ঞেস করলো,
- দোস্ত, গতকাল কি হয়েছে রে?
- কোথায়?
- ভোলা বাবার বাসায়।
- আগে আমার জিনিস দে, তারপর বলবো। আমাকে বোকা পেয়েছিস?
- আরে ব্যাটা, এত অস্থির হচ্ছিস কেনো? বললামতো পাবি।
- আসল ঘটনা শুনলেতো তুই বিশ্বাস করতে পারবি না!
- তোর ভণিতা বন্ধ করে বলতো তাড়াতাড়ি! পরে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
- ছুটির পরে বলি।
- না, এখনি বল।
- ঐ ভোলা বাবা নাকি ভণ্ড!
- মানে?
- হ্যাঁ, পানিপরা টানিপরা সব ভুয়া।
- কিভাবে ধরা পড়লো?
- ঐদিন তোকে আমাদের পাশের বাসার এক নিঃসন্তান দম্পতির কথা বলেছিলাম না?
- হ্যাঁ, মনে আছে আমার। পরে মহিলার একটা বাচ্চা হয়েছিল, তাই না?
- আসল ঘটনা ওখানেই।
- একটু বিস্তারিত বল।
- যে বাচ্চা ছেলের জন্ম হয়েছে তার সাথে নাকি বাবা মা কারো মিল নেই। দেখতে নাকি একদম ঐ ভোলা বাবার মত হয়েছে!
- কি বলছিস?
- হ্যাঁ, চোখ, নাক সব ঐ ভোলা বাবার সাথে মিলে যায়!
- তারপর।
- নিকটাত্মীয়রা দেখে সন্দেহ করেছে এবং ডাক্তারি পরীক্ষার পর ধরা পড়েছে এই বাচ্চার বাবা অন্য কেউ।
- মানে ভোলা বাবা!
- ঠিক তাই। এ কথা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকায় পুলিশ এসে ভণ্ড ভোলা বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে।
- কিন্তু, তার কি আদৌ কোনও শাস্তি হবে? কিছু টাকা খাইয়ে নিশ্চয়ই বের হয়ে যাবে।
- তা জানি না, তবে অনেক মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করলো ঐ ধোঁকাবাজ। পানির সাথে নেশাদ্রব্য মিশিয়ে মহিলা এবং যুবতী মেয়েদের খাইয়ে এসব কুকর্ম করতো সে।
- পুলিশে ধরেছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে!
টিফিন বিরতি শেষ। ক্লাসে ফিরে গেলো দুজন। ছুটি শেষে বাসায় ফিরে আর কোনওকিছুতেই মন বসলো না মাহফুজের। সারাক্ষণ শুধু ভণ্ড ভোলা বাবার কথা মনে পড়লো। অনেকবার ভাবলো যে মাকে বলবে কথাটা, পরে আর বলা হয়নি।
অনেকদিন পর মাহফুজের একটা বিরল অসুখ হলো। অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখানোর পরও কোন উন্নতি হচ্ছিলো না। পরে প্রতিবেশী এক মহিলা বললেন কোনও সাধু বাবার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোনও তাবিজ দিলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
বলাতো যায় না কে কার অছিলায় ঠিক হয়! সাধুর কথা শুনে মাহফুজের অসুখ যেন আরও বেড়ে গেলো। সে তার মাকে ওখানে না নিয়ে যাবার জন্য কাকুতিমিনতি করতে লাগলো। মাহফুজ বললো,
- এসব ঝাড়ফুঁক আর তাবিজে মানুষ এখন বিশ্বাস করে নাকি? এসবই মানুষকে ঠকিয়ে টাকা খাবার ধান্দা!
- কি যে বলিস না তুই! আমি এক সাধু বাবার কাছে গিয়েছিলাম বলেইতো তোর জন্ম হলো!
মায়ের মুখ থেকে এ কথা শোনার পর মাহফুজের মনোজগতে যে আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, ঘৃণা ও ক্ষোভের সুনামি শুরু হলো তা পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণনের মতই যেন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে রইলো!