বয়স চল্লিশের উপরে, নাম তার গেঁদা মিয়া। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে ‘গেঁদু ছোরা’ বলেই ডাকে। হালকা পাতলা গড়ন, অপুষ্টি যেন তার পরতে পরতে ঠাসা। অনেকদিন ধরেই চুরিচামারি করেনা। শেষ যেবার করেছিল তার পরে আল্লাহর কাছে খাস নিওতে তওবা করেছে যে জীবনে আর চুরির কথা মাথায় আসতে দেবেনা। কিন্তু সংসারতো চলেনা। বাচ্চা দুটো না খেতে খেতে একেবারে কঙ্কালসার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন আফ্রিকার কোন এক জায়গা থেকে ওদেরকে অনেক দিন পর উদ্ধার করে আনা হয়েছে। সংসারের ঘানি টানতে টানতে গেঁদা রীতিমত ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তার উপর বউয়ের প্যাঁচালে তার কান ঝালাপালা হবার জোগাড়।
গেঁদা ভেবে পায়না কি করবে? এর ওর কাছ থেকে ধার নিয়ে চলেছে এতদিন। মানুষ তাকে আর ধার দেয়ার কথা দূরে থাক তার নাম শুনলেই মেজাজ গরম করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। তার বউ বেশ কয়েকবার বলেছে এই সংসারে লাথি মেরে বাবার বাড়ি চলে যাবে। গেঁদার কেন জানি মনেহয় এই কাজটা তার বউ খুব শীঘ্রই সম্পাদন করবে।
যাইহোক, গেঁদা আর কোন উপায় না দেখতে পেয়ে শেষ পর্যন্ত তার সেই পুরনো চুরিবিদ্যাতেই ফিরে যাবার জন্য মনস্থির করে। চুরি করার পর আল্লাহর কাছে শেষবারের মত তওবা করবে। এবার সে ঠিক করে যে এই চুরি থেকে যা পাবে তা দিয়ে ছোটখাটো একটা কিছু করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। দুদিন পর সে তার চিন্তাকে বাস্তবতার চাদরে মোড়াতে প্রস্তুতি নেয়।
রাত ২:৩০, বউ বাচ্চারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাদের নিস্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কোন এক অদ্ভুত কারণে গেঁদার দু চোখ পানিতে ভিজে যায়। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, “আমার দুই ছ্যারা আমার লাখান ছোরা অইবনাতো?” এত নিস্তব্ধ রাত গেঁদা আগে কখনো দেখেনি। সে চুপিসারে পাকঘর থেকে সয়াবিন তেলের বোতলটা নিয়ে বাইরে এলো।
গাঁও গেরামে চুরির ক্ষেত্রে তেলের বিকল্প নেই! চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার তার রাজত্ত কায়েম করেছে। গেঁদা তার নিজের হাতও দেখতে পাচ্ছেনা। অনেক দূর থেকে থেমে থেমে দু একটা শিয়ালের ডাক কানে এসে বাজে। আর দেরী না করে সে জলদি তার সারা গাঁয়ে সয়াবিন তেল মাখা শুরু করল। আজ সে একটু বেশিই ব্যবহার করছে। তেল মাখা শেষ।
মনেহয় এই দুনিয়ায় গেঁদাই একমাত্র চোর যার চুরিতে ধরা পরার ভয় নাই, কিন্তু মানুষের গণধোলাই তার আত্মারামকে খাঁচাছাড়া করে দেয় মাঝেমাঝে। অনেকদিনের চুরির অভিজ্ঞতা তাকে অবশ্যই নিরাশ করবেনা এই বিশ্বাস তার আছে। আজ সে ঠিক করেছে কিছুটা দূরের কোন গ্রামে চুরি করবে কারণ নিজ গ্রামে তার যে কুখ্যাতি, তাতে আরেকবার ধরা পরলে বাকি জীবনটা লালঘরেই কাটাতে হবে। সময় খুব তাড়াতাড়ি বয়ে যাচ্ছে। সে তার পা দুটোকে যত দ্রুত সম্ভব সামনের দিকে ধাবিত করছে। চাইলে সে দৌড়াতে পারে কিন্তু তাতে শরীর বিদ্রোহ করবে নিশ্চিত। শেষপর্যন্ত গেঁদা তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছল। জোরে হাঁটার ফলে কিছুটা হাঁপিয়ে গিয়েছে সে। কিন্তু বিশ্রাম নেবার সময় এখন নয়, গেঁদা তা ভাল করেই জানে।
প্রত্যেক চুরির আগে সে তার নিজ মনে কি যেন বিড়বিড় করে বলে, আজো তার ব্যাত্তয় ঘটেনি। বাসাটা বেড়ার তৈরি হলেও বোঝা যায় যে পরিবারটি বেশ সচ্ছল। গেঁদা মোটামুটি নিশ্চিত যে একদম খালিহাতে তাকে আজ বাসায় ফিরতে হবেনা।
খুবই সাবধানে তার ধারালো যন্ত্র দিয়ে কৌশলে বেড়া কাটতে শুরু করল। এ কাজে বেশ দক্ষ সে। যখন বেড়া কাটা প্রায় শেষ, তখনি গেঁদা একটা দরজা খোলার এবং লাগানোর আওয়াজ পেল। আসলে যে আওয়াজ গেঁদা শুনতে পেয়েছিল তা ছিল বাড়ীর মালিকের শৌচাগার থেকে বের হবার পর দরজা লাগানোর। শৌচাগারটা বাড়ী থেকে একটু দূরে। গেঁদার গলা শুকিয়ে কাঠ।
সে একটু থামল, এদিক ওদিক তাকাল। কাউকে দেখল না; আবার কাজ শুরু করল। ঠিক তখনি গেঁদার মনে হল কেউ তার পিছনে। সে মুখ ফেরাতেই একজন বলিষ্ঠ লোক ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চীৎকার দিতে দিতে তাকে সজোরে জাপটে ধরে বাড়ীর সামনে আলোকিত উঠোনের কাছে নিয়ে গেল। গেঁদা মনে মনে সয়াবিন তেলের উপর রাগ ঝাড়ল। তার মনে হল তেলটা দুই নাম্বারি না, তিন নাম্বারি! গেঁদার চেহারা দেখার পর বাড়িওয়ালার চোখ কপালে উঠল। গেঁদাও সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে লোকটির দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। এ যে তারই এক সময়কার অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহযোগী “তেইল্লা চোরা”!