আমি একটি নদী। খুব বেশী দীর্ঘ না হলেও আমার বুকে জমা কথামালা কিন্তু কোনও মহাকাব্যের চেয়ে কম নয়! আমি সময়ের মত শুধু বয়েই চলেছি নিরবধি। থামলেই যেন আমার মৃত্যু হবে। আমার বুকে বয়ে চলা ঘোলাটে পানি যখন গ্রামের বধূরা কলসিতে করে নিয়ে যায়, তখন আমার প্রাণটা গর্বে ভরে ওঠে।
প্রতিদিন কত নাম না জানা পশু পাখীর তৃষ্ণা মেটে আমার পানি পান করে! পার হতে মাঝে মাঝে ঠুসঠাস করে পাকা তাল এসে যখন পড়ে, তখন আমার বেশ মজা লাগে। কখনও কখনও মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় যখন তুমুল বৃষ্টিতে আমার দু পার উপচে পানির ধারা লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
আমি বড়ই নিরুপায়! আমার করার কিছুই থাকে না কারণ আমি যে প্রকৃতির অংশ। এমন নিয়মেই যে চলছি আমি জন্ম হতে আজ পর্যন্ত। যাইহোক, আমার আনন্দের আর সীমা থাকে না যখন আমি লোকালয় ছেড়ে আবার পূর্বের স্থানেই ফিরে আসি। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি দেখলে যে আমার মনও তৃপ্ত হয়।
আমার যে রাগ হয় না তা বললে ভুল হবে। মাঝে মাঝে কিছু বিবেকহীন মানুষ আমার গা ঘেঁষে পায়খানা নির্মাণ করে। যার ফলে আমি প্রতিনিয়ত দূষিত হই। কিছু কিছু স্বার্থপর এবং অর্থলোভী মানুষের কারণেও আমার বুকটা কষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে। তারা আমার দুই পারে কল কারখানা নির্মাণ করে; সেইসব কারখানার দূষিত এবং বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ আমার বুকে ফেলে। আমি তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে করি। আমার যে করার কিছুই নেই। যদি কথা বলতে পারতাম, তবে নিশ্চয়ই আমার সাধ্যমত প্রতিবাদ করতাম। আমি ধর্ষিতা কোনও মেয়ের মত মুখ বুজে কাঁদি।
তবে আমি আশাহীন নই। আমি জানি যে রাত্রির পরে আলো আসবেই, আলো আসতেই হবে। এক সময় সবই আগের মত সুন্দর, সুষ্ঠু হবে। আমি সে দিনটি দেখেতে চাই। সে দিনটির অপেক্ষার প্রহর গুনে যাই।
আমি সেই জেলের কথা বলতে চাই যে প্রতিদিন আমার বুক থেকে মাছ ধরে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে, তারপর তার পরিবারের জন্য চাল, ডাল নিয়ে হাসি মুখে বাসায় ফিরে। আমি সেই অভাগিনীর কথা বলতে চাই যে তার অবৈধ সম্পর্কের চিহ্ন তার শরীরে নিয়ে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি অগণিত হতভাগা যাত্রীদের কথা বলতে চাই যারা দু চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে, হাজারো আশা নিয়ে পাড়ি দেয় গন্তব্যের দিকে কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যাদের প্রাণ পাখী উড়ে যায় আমার এই পানিতে ডুবেই।
মাঝে মাঝে মনে হয় যে আমার যদি হাত থাকতো তাহলে আমি সেইসব মানুষরূপী জানোয়ারদেরকে চুবিয়ে মারতাম যারা নিরীহ জনগণদের বস্তাবন্দী করে আমার বুকেই নিক্ষেপ করে। আমি তখন কাঁদি কিন্তু আমার কান্নার ধ্বনি কি কারো কানে পৌঁছে? আমার কান্না কি কেউ দেখতে পায়?
তবে আমি আশাহীন হইনা কখনও। বীজ থেকে যেমন নব প্রাণের সূচনা হয়, তেমনি আমিও কষ্টকে পেছনে ফেলে নবরূপে জেগে উঠি। আমাকে যে জাগতেই হবে, আমি যদি ভেঙ্গে পড়ি, তবে হাজারো মানুষের কি হবে যারা আমার উপর নির্ভর করে বাঁচে।
একটা বিষয় আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি। আমি যেমন সবার মঙ্গল কামনা করি, তেমনি নিশ্চয়ই আরও লাখ লাখ মানুষ আছে যারা অন্যের ভালো চায়, যারা নিপীড়িতের জন্য কিছু করতে চায়, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সিংহের মত গর্জে ওঠে, যারা অনাচার দেখলেই পথে নামে, যাদের মন দুঃখীর জন্য কাঁদে। এমন মানুষ নিশ্চয়ই আছে। থাকতেই হবে।
যখন ছোট ছোট নিস্পাপ শিশুরা আমার বুকে রাজহাঁসের মত সাঁতরে বেড়ায়, তখন আমার বুকে জমে থাকা কষ্টের পাথরের স্তুপ থেকে যেন একটি একটি করে টুকরা সরে যেতে থাকে। আমি যেন ভারমুক্ত হয়ে যাই। মনে হয় যেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য এসে জড়ো হয়েছে আমার মাঝে। তখন আমার খুশীতে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। বাচ্চারা যখন উঠে বাড়ির দিকে রওনা হয়, তখন আমার মন তাদের জন্য খুব কাঁদে। মনে হয় আরেকটু সময় পানিতে থাকলে কিইবা ক্ষতি হত?
রাত্রি আমায় বিষণ্ণ করে না। আমি বরং আনন্দের ভেলায় ভাসি যখন চাঁদ এসে আমার সাথে দেখা করে। আমায় আলিঙ্গনে ভরিয়ে দেয়। যতক্ষণ চাঁদ আকাশে থাকে, ততক্ষণ আমি তাকে পরম আদরে আমার বুকে আগলে রাখি। চাঁদ যখন চলে যাবার সময় হয়, তখন আমার মন একটু খারাপ হয় ঠিকই কিন্তু একটি অন্যরকম ভালোলাগাও কাজ করে এই ভেবে যে পরবর্তী রাতে চাঁদ নিশ্চয়ই তার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে আবার আমার কাছে আসবে!
অনেক কথা বলে ফেললাম। তবে একটি কথা না বললেই নয়। বৃদ্ধা মা যেমন সুঁই সুতা নিয়ে সোয়েটার বুনে যায়, আমিও তেমনি নীরবে স্বপ্নের জাল বুনে যাই। কারণ আমি জানি যে আমার স্বপ্নই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে যেমনটি রেখেছে অগণিত মানুষদেরকে। আমি জানি যে পৃথিবীতে স্বপ্ন দেখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ! স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়াটা কতটা আনন্দের!