দোতলা বাড়িটা রহস্যপুর গ্রামে মায়া নদীর তীর ঘেঁষে একগুঁয়ে ছেলের মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনও এক কালে এ বাড়ির প্রাঙ্গণ, দেয়াল, সম্মুখের বটগাছ, প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত জলকন্যার নগ্ন মূর্তি- এ সবই নীরবে যেন কত না গল্প বয়ে বেড়াচ্ছে!
কত না আনন্দ বেদনার কাব্য দেয়ালের প্রতিটি ইটের সাথে লেপটে আছে! বাড়ির ভেতরে এবং বাহিরে বিভিন্ন আগাছা, লতাগুল্ম ইত্যাদি মনের আনন্দে যেন দিন কাটাচ্ছে। বাড়িটির দেয়ালে সবুজাভ শ্যাওলার জঞ্জাল দেখতে যেন পুরুষের দাড়ির মত দেখাচ্ছে!
এলাকার মানুষ বাড়িটিকে ‘তুড়ে বাড়ি’ বলেই ডাকে। বেশ কয়েক মাস আগে মিডিয়ার লোকজন এসে একরাত্রি বাড়িটিতে অবস্থান করেও ভৌতিক কোনও ব্যাপার লক্ষ্য করেনি।
তবুও দূর থেকে দূরান্তে মানুষের মনে বছরের পর বছর ধরে এই বাড়িটি সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি রয়েছে। কোনও কোনও গ্রামবাসী নাকি গভীর রাতে বাড়িটিতে মোমবাতি জ্বলতে দেখেছে। কেউ কেউ আবার ধবধবে সাদা শাড়ি পরিহীতা অনিন্দ্য সুন্দর নারীকে বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে জাদুকরের ভেলকির মত হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখেছে।
বাড়িটিকে ঘিরে আরেকটা বেশ অদ্ভুত গল্প শোনা যায়। কোনও এক গ্রামবাসী নাকি রাতে নিজ বাড়ির কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল ঠিকই, কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে এই ভুতুড়ে বাড়িতে আবিস্কার করে মূর্ছা গেলো! পরবর্তীতে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করলেন।
এমনকি দিনের বেলায় সূর্য যখন তার আলোর রাজত্ব কায়েম করে, তখনও কেউ ভুলেও এ বাড়ির পাশ দিয়ে যায় না। যদিও এসব অদ্ভুত ব্যাপারগুলোর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবুও মানুষের মনে ভুত প্রেত সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণা এমন গভীরভাবে প্রবেশ করেছে যেন কারো শরীরে বিদ্ধ ধারালো কোঁচ। না পারে কেউ বের করতে, না পারে ভিতরে রাখতে।
এ বাড়ির মালিক সম্পর্কে কারোই তেমন কোনও ধারণা নেই। যারা অতীতে বাস করতো তারা হয়তো বহু আগেই হারিয়ে গেছে মহাকালের গর্ভে। অথবা এমনও হতে পারে যে ভুত প্রেতের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে তারা অন্যত্র পালিয়ে বেঁচেছেন।
সে যাই হোক, একদিন বিকেল বেলা একটা ট্যাক্সি এসে থামলো ঠিক ঐ ভুতুড়ে বাড়ির সামনে। ট্যাক্সিচালক ভয়ার্ত চোখে যাত্রীটিকে বললো,
- ভাইজান! তাড়াতাড়ি কইরা আমার ভারাডা দিয়া দেন। আমি যাইগা।
যাত্রীটির নাম নূর ইসলাম। সে ভাড়া পরিশোধ করার সময় একবার ট্যাক্সিচালকের দিকে তাকালো। সে লক্ষ করলো যে ট্যাক্সিচালকের চোখে কি যেন এক ভয় এসে ভর করেছে। ভরা পূর্ণিমায় মাত্র এক খণ্ড মেঘ যেমন করে পৃথিবীকে অন্ধকারের চাদরে ঢেকে দেয় তার মনের আকাশও যেন কি এক অজানা আতংকে ঢাকা পড়লো।
নূর লোকটিকে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই সে ট্যাক্সি চালিয়ে মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। যেন কোনও প্রেতাত্মা কোনও সাধু বাবার ভয়ে মুহূর্তেই বাতাসের সাথে মিশে গেলো!
এই নূর ইসলামের সাথে ভুতুড়ে বাড়িটির এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সে তার লাগেজ, ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে যাবে এমন সময় তার চোখ পড়লো সম্মুখবর্তী বটগাছটার দিকে। সেখানে সে একজন বৃদ্ধ সাধককে গভীর ধ্যানে মগ্ন অবস্থায় দেখতে পেলো।
নূর মনে মনে ভাবলো যে পরে কখনও সাধকের সাথে আলাপ জমানো যাবে। আগে বাসায় ঢুকে কাপড়চোপড় ছেড়ে একটু বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।
গল্পের এই পর্যায়ে এসে একটু ইতিহাসের অন্দরমহলে উঁকি দেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নূর ইসলামের বাবা মা এই বাড়ির মালিক। ওনারা অনেক বছর আগে এখানে থাকতেন। নূরের জন্ম হবার পর, তার মা লাকি চৌধুরী অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করলেন। কখনও অর্ধ নগ্ন অবস্থায় বটগাছের দিকে দৌড় দিতেন। গাছের উপরের দিকে তাকিয়ে কার সাথে যেন কথা বলতেন।
গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে নদী তীরে বসে একা বসে থাকতেন যেন অনেকদিন পর কেউ ওনাদের ঘরে আসছেন যার জন্য এত অপেক্ষা!
বাথরুমে গিয়ে নিজের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলতেন। অনেক ডাক্তার, কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েও কোনও সুফল আসেনি। নূরের বাবা শান্ত ইসলাম এবং আত্মীয়স্বজন একদম আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।
এভাবেই চললো আরও কয়েকদিন। তারপর নিঃস্ব কাঙালের মত আর কোনও উপায় না দেখে বাড়ি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন শান্ত। অন্য এলাকায় বাড়ি পাওয়া গেল এবং যত দ্রুত সম্ভব আসবাবপত্র স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে সবাই একমত হলেন।
পরদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। লাকির আচার আচরণ একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেলো! যেন এতোদিন ধরে তিনি অভিনয় করছিলেন। নাটকের শেষ অংকের সমাপ্তি ঘটলো যেন।
আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা সেদিন বিকেলে নূরের বাবার সাথে ঘটল। তিনি বিষণ্ণ মনে দূর আকাশের কোনও এক একাকী তারার মত নদী তীরে বসে ছিলেন। খুব বেশী সময় হয় নি। তবুও কেন জানি মনে হচ্ছিলো সহস্র বছর ধরে তিনি সেখানে বসে ছিলেন এবং সময় যেন মৃত, পড়ে থাকা পাথর খণ্ডের মত স্থির।
বাসায় ফেরার পথে শান্ত লক্ষ করলেন যে অতি বৃদ্ধ একজন লোক ঐ বটগাছটার নিচে একটা শীতল পাটিতে বসা। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, শুভ্র মেঘের মত সাদা চুল এবং দাড়ি। দেখে মস্ত বড় সাধু বা দরবেশ মনে হয়।
দরবেশ বাবার সাথে চোখাচোখি হবার সাথে সাথেই শান্ত যেন কোনও জাদুকরের মায়াজালের মত নিস্পলক তাকিয়েই রইলো। যাযাবররা যেমন হিপনটিজমের মাধ্যমে কোনও মানুষের মস্তিস্কপ্রসুত চিন্তাগুলোকে পড়তে পারে, ঐ সাধুও যেন শান্ত-এর চোখের ভাষা অবলীলায় পড়তে থাকলেন। সম্পূর্ণ পড়া শেষ করে তারপর চোখ বন্ধ করলেন।
শান্ত যেখানে ছিলেন ঠিক সেখানেই মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। দরবেশ বাবা চোখ খুলে শান্তকে ইশারায় নিজের কাছে ডাকলেন। শান্তও বাধ্য শিশুর মতন সাধু বাবার দিকে অগ্রসর হলেন। বাবা বললেন,
- আমি থাকতে তোর আর কোনও কষ্ট হবে না। এ বাড়িতে এক মারাত্মক প্রেতাত্মা বাস করে। আমি তার শায়েস্তা করতেই এসেছি। এই তাবিজটা নে। এটা তোর স্ত্রীর গলায় পরিয়ে দিবি। কখনও যেন এটা গলা থেকে না খোলা হয়। যদি ভুলেও কখনও এটা হারায়, বা গলা থেকে পড়ে যায়, তবে আর কোনও শক্তিই তোর স্ত্রীকে বাঁচাতে পারবে না। আরেকটা কথা- আগামীকাল তোরা এই বাসা ছেড়ে দিবি। তোর ছেলের বয়স যখন ৩০ হবে, তখন তার হাতে এই কাগজটা দিয়ে এই বাসায় এসে রাত তিনটা বাজে এই বটগাছের নিচে মাটিতে পুঁতে রাখতে বলবি। যা, আল্লাহ্ তোদের রক্ষা করুন।
দরবেশ বাবার কথাগুলো শান্ত শুনতেই থাকলেন। যেন ওনার নিজের বলার মত কিছুই নেই। যেন তিনি একটা নির্বাক গাছ!
পরদিন সকালেই ঝড়ো হাওয়ার গতিতে বাসা পরিবর্তন করা হলো। সেই দরবেশকে অবশ্য দেখা গেলো না সেদিন আর।
আজ সেই রাত যে রাতে নূর সেই দরবেশের নির্দেশনা মতে এবং তার পিতা হতে প্রাপ্ত সযত্নে সংরক্ষিত কাগজের টুকরাটিকে সেই বটগাছের নিচে পুঁতে রাখতে এসেছে। কেউ জানে না কাগজটায় কি লেখা আছে।
নূর ব্যাগে থাকা খাবার খেয়ে মোমের আলোয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ক্ষুধিত পাষাণ” গল্পটি পড়ছে। বাইরে শো শো শব্দে হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে যেন ঝড় আসবে। একটু পর পর মোমবাতি নিভে যাচ্ছে। নূরের মনে হল কেউ যেন ইচ্ছে করেই এমনটি করছে।
নূর মনে মনে কয়েকটি সূরা পড়তে থাকলো। তার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। এক অজানা ভয় তার মন প্রাণ কালো মেঘ যেমন সূর্যকে ঢেকে দেয় ঠিক তেমনি আচ্ছন্ন করেছে। নূরের মনে হচ্ছে যেন সে আর ভোরের আলো দেখতে পাবে না। আজ রাতেই ওর মৃত্যু হবে এবং কেউই লাশ খুঁজে পাবে না।
সময় যেন যাচ্ছেই না! মনে মনে প্রার্থনা করছে কখন তিনটা বাজবে? কখন কাজটি সম্পাদন হবে? কখন ভোর হবে? কখন সে বাড়ি ফিরবে? এক অস্বাভাবিক অস্থিরতা নূরকে গ্রাস করেছে।
রাত তিনটা বাজতেই নূর হাতে একটি টর্চলাইট নিয়ে বের হলো। গন্তব্য অতি নিকটেই কিন্তু তার মনে হলো এ দূরত্ব কভু শেষ হবার নয়। যেন যুগ যুগ ধরে অপেক্ষার পরে সে তার লক্ষ ভেদ করতে পারবে।
প্রকৃতি যেন আজ উন্মাদ হয়ে গেছে। মাতাল হাওয়ায় নূর নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতেই হিমশিম খাচ্ছে। অল্প বাতাসে কাগজের টুকরা যেমন বাতাসে ভাসে, ঠিক তেমনি নূর যেন প্রচণ্ড হাওয়ার সাথে উড়ে যাবে।
নূর বটগাছের নিচে পৌঁছতেই একটা বিশাল ডাল তার পায়ের উপর আছড়ে পড়ে। তৎক্ষণাৎ সে একটা চিৎকার দিয়ে ওঠে। বজ্রপাতের আওয়াজের কাছে তার চিৎকার যেন সমুদ্রের কাছে এক ফোঁটা জলবিন্দু! যাইহোক, ব্যথার তীব্রতায় নূরের হাত পা অসাড় হয়ে আসে।
অনেক কষ্টে ডাল থেকে পাটা সরিয়ে এনে খুব দ্রুততার সাথে নূর ইঁদুরের মতন একটা গর্ত খুঁড়ে কাগজের টুকরাটা রেখে মাটি চাপা দিয়ে পঙ্গু মানুষের মত ধীরে ধীরে বাসায় ফিরে আসে।
সারারাত ধরে নূর প্রচণ্ড ব্যথায় কোঁকাতে থাকে। সাথে তীব্র জ্বর। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। বটগাছটির নিচে সে সেই সাধু বাবাকে দেখতে পায়। দরবেশ নূরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়েই বাতাসে ভেসে থাকা অতি ক্ষুদ্র জলকণার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!