বেচারা! [Story]

স্বাধীন ছেলেটা নামে যেমন স্বাধীন, তেমনি তার কর্মকাণ্ডও স্বাধীনচেতা। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলে ছোট বড় যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা প্রতিযোগিতা হলে সেখানে সে তার নাম দিত। পারুক আর না পারুক। কেন জানি তার খুব ভাল লাগত।

 

এই বিষয়টা একটু অদ্ভুত! কারণ স্বাধীন মানুষ হিসেবে খুবই অন্তর্মুখী। খুবই লাজুক প্রকৃতির একটা ছেলে। যে ছেলের সামনে দিয়ে কোন মেয়ে হেঁটে গেলে তার সারা শরীর কেঁপে উঠে সে কিনা স্কুলের সকল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বেরায়!

 

মাঝে মাঝে সে নিজে যখন এটা নিয়ে চিন্তা করে তখন তারও হাসি পায়। কি অদ্ভুত এই পৃথিবী এবং এখানকার বাসিন্দারা!

 

শুধু নাচের প্রতিযোগিতা বাদে বাকি সব অনুষ্ঠানে স্বাধীনের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। তবে তার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হচ্ছে গান গাওয়া এবং অভিনয় করা। মাঝে মাঝে তার প্রতিভার ঝলক দেখে শিক্ষকরাও অবাক না হয়ে পারে না।

 

এত ছোট ছেলে, কিন্তু কি আশ্চর্য তার প্রতিভা। সাধারণত কেউ নির্দিষ্ট একটা বা দুটো দিকে পটু হয় কিন্তু স্বাধীন সব দিকে সমানভাবে দক্ষ। তার এতসব গুনের বহিঃপ্রকাশ তাকে কারো কাছে নায়কে এবং কারো কাছে শত্রুতে পরিণত করেছে। সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে সর্ব গুণে গুণান্বিত করে এই নশ্বর পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।

 

তবে একটা সমস্যা স্বাধীনকে সবসময় তারা করে ফেরে। যখনি অচেনা কোন স্থানে তার প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ আসে, তখন সে একটু ঘাবড়ে যায়। তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। খুব ইতস্তত করতে থাকে। দুশ্চিন্তা এবং ভয় গ্রাস করে ফেলে তাকে।

 

খালি মনে হয় কাজটা ঠিকমত করতে পারবেতো? না পারলেতো শিক্ষকরা বকা দিবেন; বন্ধুরাও হাসাহাসি করবে তাকে নিয়ে। তবে কোনভাবে শুরুটা যদি ভাল হয়, শেষটাও বেশ ভালভাবেই হয়।

 

যথারীতি একদিন স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় ঘনিয়ে আসে। শিক্ষকরা ক্লাসে ক্লাসে আগ্রহী ছাত্রদের নাম সংগ্রহ করতে থাকে। বরাবরের মত স্বাধীন এবারো খুব খুশী এবং একইসাথে চিন্তিতও বটে।

 

কারণ এবার অনুষ্ঠানে অনেক নামীদামী এবং সম্মানিত অতিথিরা আসবেন। বলাই বাহুল্য যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের উপস্থাপনা হতে হবে এক কথায় চমৎকার। স্বাধীনের উপর তার শিক্ষকদের আস্থা বাকি সবার চেয়ে বেশী। তার এতদিনের উপস্থাপনায় সবাই সন্তুষ্ট।

 

এবার নাম জমা পড়েছে অনেক। কেউ কবিতা আবৃত্তি করতে চায়, কেউ চায় নাচে অংশ নিতে ইত্যাদি। স্বাধীন এবার একটু নতুন কিছু করতে চায়। মানে এর আগে সে কখনও অংশ নেয়নি এমন কোন পর্বে অংশ নিয়ে নিজের যোগ্যতা আরও দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করতে চায়। সে ঠিক করল জারি গান করবে।

  

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সামগ্রিক দায়িত্বে ছিলেন মোঃ আব্দুর রহমান স্যার। সবাই ওনাকে রহমান স্যার বলেই ডাকতো। ওনাকে জানানোর পর উনি দ্রুতই রাজি হলেন কারণ স্বাধীনের উপর ওনার আস্থা ছিল। সে জারি গানেও ভাল করবে বলে সবার আশা।

 

জারি গান যেহেতু দলগত, তাই স্বাধীনের কমপক্ষে তিনজন দরকার যারা তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার গাওয়া বিশেষ কয়েকটি লাইনের পুনরাবৃত্তি করবে। কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে কিন্তু কেউ সাহস করছে না।

 

সত্যি কথা বলতে কি এরকম বড় মাপের অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে নিজের প্রতিভা তুলে ধরার মত সাহস হচ্ছিল না কারোই। তার উপর ভয় এবং লজ্জাবোধ তো ছিহিলই। যাইহোক, স্বাধীন এতো সহজে হাল কখনো ছাড়েনি, ছাড়বেও না। অনেক কষ্টে তিনজন যোগাড় হল। খুব খুশিমনে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছে গিয়ে হাজির হল।  

 

শিক্ষক তাদেরকে একটি গানটি গাওয়ার জন্য ঠিক করে দিলেন। গানটি স্বাধীন ও তার বন্ধুদেরও খুব পছন্দ হল। স্কুলে, বাসায়, পাড়ার চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে তারা খুব জোরেশোরে গানের অনুশীলন করা শুরু করল। অনেক সময় তাদের গান গাওয়া দেখে রাস্তার পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে শুনত। কেউ হয়তো মনে মনে প্রশংসা করতো, কেউ বা ভাবতো পাগলামি ছাগলামি। কে জানে!

 

স্বাধীন প্রায়ই তার বন্ধুদেরকে বাসায় বাসায় নিয়ে আসতো। মার বকুনির ভয়ে সে তার গানের আসর বসাত ছাদে। এই একটা জায়গায় ওরা যতক্ষণ খুশী মনের আনন্দে গানের রেওয়াজ করতে পারতো।

 

মাও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতো এই ভেবে যে বাচ্চারা বাসাতেই আছে। ছাদে গান গাওয়াটা  স্বাধীন ও তার বন্ধুদের কাছে বেশ রোম্যান্টিক ছিল। কারণ বিকেলে সূর্য কিছুটা ক্লান্ত হলে ওরা খুব আরামেই অনুশীলন করতে পারতো।

 

দিগন্তে প্রায় ডুব দেয়া সূর্যকে তখন একটা ডিমের কুসুমের মত দেখাতো। মৃদু বাতাসে চলতো তাদের আড্ডা আর গান গাওয়া। ওরা যখন পাশের বাসার ছাদে কোনও সুন্দরী মেয়েকে দেখত, তখন তাদের গলার আওয়াজ তিনগুন চারগুণ বাড়িয়ে দিতো!

 

এভাবেই চলল বেশ অনেকদিন। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে কড়া নাড়ল সবার মনের দরজায়। মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্কুলের মাঠে বিশাল এক মঞ্চ প্রস্তুত করা হল। সবার মধ্যেই একটা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে।

 

দুদিন পরেই অনুষ্ঠান শুরু হবে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে স্বাধীন এবং তার বন্ধুদের বুকের ধকপকানি যেন স্কুলের ছুটির ঘণ্টার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। সবাই বলাবলি করছে যে এবার নাকি অনেক বড় মাপের গণ্যমান্য লোকজন আসবেন এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে। এটা শুনার পর থেকে সকল প্রতিযোগীদের দুশ্চিন্তায় ঘাম ঝরা যেন বেড়ে গেল।

 

যাইহোক, যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। সব প্রতিযোগীরাই আশানুরূপ না হলেও বেশ সন্তোষজনকভাবে যার যার কাজটা সম্পাদন করছে। যখন মাইকে স্বাধীন এবং তার দলকে মঞ্চে ডাকা হল, তখন মঞ্চের দিকে হেঁটে যেতে যেতে টের পেলো যে তার গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। কোনও ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতায় দৌড়বিদদের দৌড়ানোর পর যে অবস্থা হয় ঠিক সে রকম।

 

মনেমনে আল্লাহ্‌কে ডাকছে আর সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মঞ্চে উঠে সামনে তাকাতেই স্বাধীন যেন এক মানব সমুদ্র দেখতে পেলো। সবাই যেন তাকেই দেখছে। প্রতিটা চোখ যেন তীর হয়ে তার শরীরে বিঁধছে। স্বাধীন গান গাওয়া শুরু করলো। শুরুটা বেশ চমৎকার হয়েছে। দর্শকরা খুব আনন্দের সাথে করতালি দিচ্ছে।  

 

দর্শকসারির একেবারে পেছন দিকে দুই তিনজন পাগলের মত লাফাচ্ছে! কিন্তু আজ ভাগ্য মোটেও স্বাধীনের পক্ষে নেই। হঠাৎ সে গানের লাইন ভুলে গেছে! তার গাওয়া শেষ লাইন হচ্ছে মরি হায় রে হায়!। বাদ্য বাজছে এবং ঐ লাইনটা তার পেছনে দাঁড়ানো সঙ্গীরা বারবার গাইছে এবং পরবর্তী লাইন গাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু স্বাধীন না গাওয়া পর্যন্ত তাদের কিছুই করার নেই!

 

না, স্বাধীন কিছুতেই পরের লাইন মনে করতে পারল না। সে সামনে তাকিয়ে দর্শকশ্রোতাদের একবার দেখল। দর্শকরা ভাবছে হয়তো একটা লম্বা বিরতির পর আবার গান গাইবে মঞ্চের গায়করা। স্বাধীনের মনে হল একেকটা দর্শক যেন একেকটা তিমি!

 

সবাই যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলছে তাকে! পানির ঢেউ যেমন পদ্ম প্রতিনিয়ত অনুভব করে, ঠিক তেমনি দর্শকদের পিনপতন নিস্তব্ধতা যেন বাতাসের সাথে মিশে প্রতিধ্বনির মত প্রবল বেগে স্বাধীনের দিকে ধেয়ে আসছে।

 

     একবার তার মনে হল ডান বাম না দেখে চোখ বন্ধ করে একটা দৌড় দিতে! ইশ! বেচারা স্বাধীন! তার যদি ইকারাসের মত ডানা থাকতো!  

View kingofwords's Full Portfolio