জিহান আহমেদ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হবার পরপরই বেশ কয়েকজনের সাথে ভালোই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তার। তাদের মধ্যে রাজীব, আবেদ, পাপ্পু, ইমাম এবং ইমু অন্যতম। তার মেয়ে বন্ধু নেই বললেই চলে। সত্যি কথা বলতে জিহান দেখতে সিনেমার নায়কদের মতই সুদর্শন হলেও তার স্বভাব বেশ লাজুক প্রকৃতির।
মেয়েদের সাথে কথা বলার কথা সে চিন্তাই করতে পারে না। কথা যে একেবারে বলে না তা নয়, তবে যতটুকু পারে সে মেয়েদেরকে এড়িয়েই চলার চেষ্টা করে। তাছাড়া কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলের এমন আচরণ খুব যে অস্বাভাবিক কিছু তা নয়। এমনটা হতেই পারে। কিছু কিছু ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে এবং মিশতে একটু সময় লাগে।
যাইহোক, একদিন এই জিহান একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। প্রেমে পিছলে পড়ে ভেসে থাকা নয়, রীতিমত হাবুডুবু খেতে থাকে সে। মেয়েটির নাম মুশফেকা চৌধুরী। সে বোরখা পড়ে। খুব ভদ্র স্বভাবের একটা মেয়ে।
মুশফেকা চশমা পড়ে না। তার শুধু দুই চোখ দেখা যায়। জিহান তার দু চোখ দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে। সে মুশফেকার সাথে কথা বলে না কিন্তু বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন তার চোখে কোনও রহস্য লুকানো আছে এবং জিহান গোয়েন্দাদের মত সেটা খুঁজে বের করতে ব্যস্ত!
ইতোমধ্যে মুশফেকা কয়েকবার খেয়াল করেছে যে জিহান তার দিকে তাকায়। একদিন জিহান তার ভালো লাগার কথাটা পাপ্পুকে জানায়। কিন্তু পাপ্পু তাকে বলে যে সরাসরি মুশফেকার সাথে কথা বলতে। এ কথা শুনে জিহানের হৃদয় নৃত্যরত কোনও ললনার মত লাফ দিয়ে উঠে। সে বলে,
- আমি তার সাথে গিয়ে কথা বলব?
- হ্যাঁ, বলবি। এতে সমস্যা কি?
- শালা! তুই আমার বন্ধু না, শত্রু।
- তুই একটু চিন্তা করে দেখ। আমি যা বলছি ঠিকই বলছি।
- ঠিক বলছিস না ছাই! আমি তাকে গিয়ে কি বলব?
- বলবি আমি তোমাকে ভালোবাসি।
- বাহ! এত সহজ! এটা কি তোর মায়ের হাতের মোয়া?
- তোর সাহস একেবারেই নেই। মেয়েদের মত তুই, ভীতু একটা।
- দেখ আমাকে ভীতু বলবি না। আমি একদমই ভীতু না।
- ভীতু না হলে তুই প্রমাণ কর যে তুই ভীতু না।
- আমার মনে একটু দ্বিধা কাজ করছে।
- কিসের দ্বিধা?
- মানে আমি যদি তাকে আমার ভালোবাসার কথা বলি, তখন সে যদি রাগ করে; যদি সে কোনও স্যার অথবা ম্যাডামকে বলে দেয়!
- একটু রিস্ক তো থাকেই।
- একটু রিস্ক না বন্ধু, অনেক রিস্ক। পরে বিষয়টা যদি আমার মা বাবার কানে চলে যায় তখন কি হবে?
- এত চিন্তা করলে তো জীবন চলবে না। একটু সাহস করে বলেই দেখনা কি হয়? সে তো রাজি হতেও পারে, তাই না?
- জানি না দোস্ত; তবে তার হরিণের মত মায়াবী চোখ দিনরাত আমার চোখে ভাসে।
- তাহলে আর কি করার আছে? বসে বসে আঙুল চুষতে থাকো আর কল্পনার রাজ্যে পাখীর মত উড়ে বেড়াও। তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না।
- আমার জায়গায় তুই থাকলে কি এত সহজে মেয়েটিকে ভালোবাসার কথা বলতে পারতি?
- অবশ্যই, আমার কলিজা বড় আছে বুঝলি। তোর মত মুরগীর কলিজা আমার না।
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, যায় মাসের পর মাস; জিহান যেন মুশফেকার মায়াজালে দিনদিন জড়িয়েই যাচ্ছে। এ জাল ছেঁড়া যেন অসম্ভব। তার শুধু মনে হয় মেয়েটি হয়তো বান্ধবীদের সাথে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। জিহান যেন সমুদ্রের মাঝখানে অনন্তকাল ধরে ভাসছে। শত চেষ্টা করছে কিন্তু কূলের দেখা পাচ্ছে না।
জিহান মনে মনে চিন্তা করতে থাকে যে মুশফেকাকে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারুক বা না পারুক, তার সাথে একদিন সে ঠিকই কথা বলবে। যখনই মুশফেকাকে দেখে জিহান যেন আকাশে মেঘের মত ভাসতে থাকে। তার নিজের উপর যেন আর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যেন মেয়েটি তাকে কোনও জাদুমন্ত্র দ্বারা পরিচালিত করছে।
অনেকদিন মুশফেকার সামনে গিয়েও জিহান কোনও কথা না বলেই ফিরে এসেছে। প্রতি রাতে সে নিজের সাথে পণ করে যে পরের দিন সে অবশ্যই মুশফেকার সাথে কথা বলবে কিন্তু তার সঙ্কোচের পাহাড় এতই শক্ত যে তা ভাঙ্গে না। হয়তো কাউকে ভালো লাগলে সেই ভালো লাগা মানুষটিকে ভালো লাগার কথা না বলতে পারার মধ্যেও এক ধরণের আনন্দ আছে। সেই আনন্দময় অনুভূতিতে জিহান নিজেকে হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সময় বড় নিষ্ঠুর, একগুয়ে বোবা, বধির এবং অন্ধ। সে কারো কথা শুনে না; শামুকের মত চুপচাপ এগিয়ে চলে। ইতোমধ্যে জিহানসহ তার সহপাঠীরা এইচ. এস. সি. পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। জিহানের পরীক্ষা যে খুব ভালো হচ্ছে তা নয়। তবে সে কোনোভাবে পাস করতে পারলেই খুশী।
যাইহোক, জিহান খুব দৃঢ়তার সাথে সিদ্ধান্ত নেয় যে শেষ পরীক্ষার দিন কলেজের গেইটে মুশফেকার জন্য অপেক্ষা করবে। সে কাছে আসলেই জিহান তাকে জিজ্ঞেস করবে পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সে মনে করে যে এটা জিজ্ঞেস করলে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। মেয়েটি নিশ্চয়ই ভালোভাবেই তার প্রশ্নের উত্তর দিবে। এভাবেই কথার সুত্রপাত হলে আলাপচারিতার ডালপালা গজাতে সময় লাগবে না।
যদিও গেইটে দাঁড়িয়ে খুব বেশী সময় ধরে কথা বলা যাবে না কারণ মুশফেকা দ্রুত বাসায় ফিরে যেতে চাইবে; তবুও তার সাথে কয়েকটা বাক্য বিনিময় করতে পারলে জিহান নিজেকে ধন্য মনে করবে। শেষ পরীক্ষার দিন তার সাথে কথা বলার আরেকটা কারণ হচ্ছে যে সে মুশফেকাকে আর দেখতে পারবে না। আর কলেজে আসা হবে না; বাসায় বসে পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। জিহান পরীক্ষা শেষ করে দ্রুত গেইটের কাছে এসে দাঁড়ায়। সে গোয়েন্দাদের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে মুশফেকাকে খুঁজতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটির কোনও পাত্তা নেই। জিহানের মনের জানালার ফাঁক দিয়ে ভয় ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে কারণ সে ভাবে যে মুশফেকা সে আসার আগেই চলে গেল কিনা।
ঠিক সেই মুহূর্তে জিহান মুশফেকাকে হেঁটে আসতে দেখে। জিহানের মুখে শাপলা ফুলের মত হাসি ফুটে উঠে। সে লক্ষ করে যে মুশফেকার সাথে তার কয়েকজন বান্ধবীও আছে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে গেইটের প্রায় কাছে চলে এসেছে।
জিহানের মনে আশা ছিল মুশফেকা একবার তার দিকে তাকাবেই। যখন সেই সুন্দর মুহূর্তটি আসবে, ঠিক তখন সে তাকে পরীক্ষা সম্পর্কে একটা প্রশ্ন করবে। মুশফেকা জিহানের সামনে এসে গেইটের বাইরে যাবে এমন সময় সে জিহানের দিকে তাকাতেই জিহান বলে,
- মুশফেকা, পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
- ভালোই, তোমার?
- মোটামুটি।
জিহানের মুখ দিয়ে যখন ঐ কয়েকটি শব্দ বের হয়েছে তখন মনে হয়েছে যেন তার হৃদয়ও মুখ দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসবে। যেন মুশফেকার মুখ থেকে শুনা ঐ কয়েকটা শব্দ সম্বল করেই সে জনমের পর জনম পার করে দিতে পারবে। যেন পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর, সবকিছুই ভালো। যেন সে আকাশ ছুঁয়ে দিয়েছে। যেন সেই শব্দগুলো আজীবন তার কানে প্রতিধ্বনির মত ফিরে ফিরে আসবে।