মরণ [Story]

        শায়লাদের বাড়ির ঠিক সামনেই একটা পুকুর। স্বভাবতই পুকুরের পানি নদীর পানির মত চঞ্চল নয়, স্থির। সেটার যেন নেই কোনও তাড়া। যেন খাঁচায় বন্দী এক পাখী যেটার খুব ইচ্ছে সত্ত্বেও খাঁচার ভেতরেই ছটফট করছে। পুকুরের পানিও যেন চার দিকের মাটির ঢিবিতে আবদ্ধ হয়ে আছে।

 

        এ পুকুরটির কোনও দাপ্তরিক নাম নেই। তবে অনেকে এটাকে মরণ পুকুর বলে ডাকে। এমন ভয়ানক নামকরণের পেছনে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা জড়িত। জনশ্রুতি আছে যে অনেক অনেক বছর আগে একটি চার বছরের শিশু এই পুকুরে ডুবে যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে তার লাশ কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

        সাধারণত কেউ পানিতে ডুবে মারা গেলে তার লাশ অবশ্যই ভেসে ওঠার কথা কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। কেউ এটাকে গাঁজাখুরি কথা বলে হেসে উড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ অবশ্য এটা বিশ্বাস করে। বিশেষ করে যারা একটু বয়স্ক তাদের প্রায় সকলেই এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে একমত।

 

        বর্তমানে কেউ যখন ঘটনাটিকে অযৌক্তিক বলে এড়িয়ে যেতে চায়, তখন যারা এতে বিশ্বাস করেন তাদের মেজাজ আগুনের মত জ্বলে উঠে। যাইহোক, পুকুরটিকে ঘিরে ঐ একটি ভয়ানক জনশ্রুতিই শুনতে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে কখনও এমন কোনও ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়নি।

 

        পুকুরটি শায়লাদের বাড়ির একেবারে কাছে হওয়ায় বেশ সুবিধাই হয়েছে। বিশেষ করে বাসার পানি সরবরাহ লাইনে যদি কখনও কোনও সমস্যা হয় সেই ক্ষেত্রে পুকুরের পানি আশীর্বাদের মত কাজ করে।

 

        শায়লা একটি কলেজে পড়ে। সে এইচ. এস. সি. পরীক্ষার্থী। মা লায়লা ইয়াসমিন একটি স্কুলের গণিতের শিক্ষক। তার বাবা জাকারিয়া হাবিব ব্যাংকার। শায়লার ছোট ভাই আফজালের বয়স চার বছর। শায়লা কলেজে খুব একটা যায় না। কলেজের নিয়ম কানুনে একটু শিথিলতা থাকাতে সে প্রতিদিন কলেজে না গিয়ে বেশিরভাগ সময় বাসাতেই পড়াশুনা করে।

 

শায়লার বাবা এবং মা যখন নিজ নিজ চাকরিতে ব্যস্ত থাকেন তখন শায়লার গুরুদায়িত্ব থাকে তার ছোট ভাইটিকে চোখে চোখে রাখা। যাতে তার কোনও বিপদ না হয়। বিশেষ করে সে যাতে পুকুরের আশেপাশে কখনও একা না যায় এ বিষয়টা খেয়াল রাখা।

 

যাইহোক, অসহায় এবং একলা ঘরগোশের উপর যেমন শকুনের কু দৃষ্টি পড়ে, তেমনই একদিন এই পরিবারটির উপর দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া এসে পড়ে। যথারীতি শায়লা এবং আফজাল ছাড়া ঘরে অন্য কেউ নেই।

 

লায়লা ফোনে শায়লাকে বলেছে যে আজ বাসায় ফিরতে একটু দেরী হবে; সে আর আফজাল যেন খাওয়া দাওয়া করে নেয়। শায়লা ছোট ভাইটিকে ভাত খাইয়ে দিতে দিতে নিজেও সামান্য খেয়ে নেয়।

 

খাওয়া দাওয়া শেষ করে শায়লা খাটে উঠে টিভি দেখতে বসে। আফজালও তার পাশে গিয়ে শুয়ে টিভি দেখতে থাকে। টিভি দেখতে দেখতে শায়লা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ একটি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখার পর সে লাফ দিয়ে উঠে। তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে।

 

শায়লা কপালে হাত দিয়ে খেয়াল করে সেখান থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। মুহূর্তেই দুঃস্বপ্নের কথা ভুলে গিয়ে সে তার ছোট ভাইয়ের নাম ধরে খুব জোরে জোরে ডাকতে থাকে। কিন্তু তার কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে শায়লার বুক গাছের পাতার মত কাঁপতে থাকে।

 

অমাবস্যায় যেমন চাঁদ ঢেকে যায়, ঠিক তেমনই এক অজানা আতংক এবং ভয় এসে শায়লার মনকে গ্রাস করে ফেলে। সে মানসিক রোগীর মত আচরণ করতে থাকে। এদিক ওদিক আফজাল আফজালবলতে বলতে ছুটে বেড়ায়।

 

শায়লা একসময় বাসার সামনের পুকুরের কাছে গিয়ে থামে। পুকুরের সবুজ পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। যেন পুরো পুকুরটি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। শায়লার মনের ভয় আরও বেড়ে যায়। তার মনে হতে থাকে যে আফজাল হয়তো কোনও এক ফাঁকে পুকুর পারে এসেছে এবং সেখানে ডুবে গিয়েছে।

 

শেষপর্যন্ত শায়লা তার মাকে ফোন করে। তার মুখ ফুটে কোনও কথা বের হয় না। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার মা অপর প্রান্ত থেকে হ্যালো হ্যালো বলতেই থাকে। একসময় শায়লা বলে যে আফজালকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

 

অতঃপর পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ তদন্ত করে দেখার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে কেউ হয়তো বা আফজালকে অপহরণ করেছে। কিন্তু শায়লার মা বাবা এতে দ্বিমত পোষণ করেন। ওনাদের যুক্তি হচ্ছে যে এটা যদি অপহরণের ঘটনা হত তবে এতক্ষণে নিশ্চয়ই অপহরণকারীদের কাছ থেকে মুক্তিপণের ব্যাপারে ফোন আসত।

 

লায়লার ধারণা আফজাল নিশ্চয়ই পুকুরে ডুবে গেছে। কিন্তু পুলিশ এ কথায় কোনও যুক্তি দেখেন না কারণ যদি সত্যিই ছেলেটি পানিতে ডুবে মারা যেত তবে তার লাশ নিশ্চয়ই ভেসে উঠত। যাইহোক, লায়লার অনেক অনুরোধের পর পুলিশ পুকুরে জাল ফেলে এবং দক্ষ ডুবুরী নামিয়েও তল্লাশি চালান। কিন্তু ফলাফল শুন্য।

 

         এ ঘটনার পর অনেক দিন কেটে গেছে। মানুষের চামড়া কেটে গেলে ঔষধ যেমন আস্তে আস্তে সেটা ঠিক করে দেয়, সময়ও তার অদৃশ্য ঔষধের মাধ্যমে সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে দিয়েছে। কিন্তু আফজালের মা লায়লা স্বাভাবিক হতে পারেননি। এখন তিনি কারো সাথেই কথা বলেন না। প্রতিদিন জানালার পাশে বসে থাকেন এবং পুকুরের ঐ সবুজ পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন যেন ওনার হারানো মানিক পুকুর থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে তার মায়ের বুকে ফিরে আসবে!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: