আমেনা বেগমের সদ্য জন্ম নেয়া চাঁদের মতন দেখতে শিশু কন্যাটিকে নার্স এইমাত্র তোয়ালেতে জড়িয়ে আমেনার মা সখিনা বেগমের কাছে দিয়ে অন্য রোগীকে দেখতে চলে যায়।
আমেনার বিছানার কাছেই সখিনা বসে আছেন। ওনার চোখে মুখে আনন্দের রেখা স্পষ্ট। খেজুর গাছের কলসিতে যেমন বিন্দু বিন্দু করে রস জমে পূর্ণ হয়, তেমনই যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখময় অনুভূতি পুঞ্জিভূত হয়ে সেই হাসপাতালে আমেনার বিছানায় উপস্থিত হয়েছে।
সখিনা অনেকক্ষণ ধরেই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কখনও বসে আছেন, কখনও তার কান্না থামাতে এদিক ওদিক হেঁটেছেন। তিনি মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকছেন যাতে ওনার মেয়ের জ্ঞান খুব দ্রুত ফিরে আসে।
সখিনার স্বামী জামাল কয়েকদিন আগে তাকে তালাক দিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। সখিনার মা ছাড়া আপন বলতে আর কেউ নেই এখন। মাকে নিয়েই ঢাকা শহরে যাযাবরের মত কোনওমতে জীবনের চাকা টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছেন দুজন।
কখনও রাস্তার পাশের বড় পাইপের ভেতর, কখনও বা ফুটপাতে উপরে পলিথিন আর নিচে বস্তা বা কাগজের টুকরা রেখে অতি কষ্টে দিন রাত পার করতে হয় ওনাদেরকে। এর মধ্যে পৃথিবীর আলোয় আসা এই শিশুকন্যার ভবিষ্যৎ যে পুরোপুরি অন্ধকার তা বলাই বাহুল্য।
সামনের ভয়াল দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে সখিনার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কোলের শিশুটিকে কার কাছে রেখে যাবেন এটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ বিছানায় রেখে যাওয়াটা মোটেও ঠিক হবে না। তাছাড়া আশেপাশে কোনও নার্সকেও দেখতে পাচ্ছেন না।
যে দুয়েকজন নার্স সখিনার সামনে দিয়ে গিয়েছেন ওনারা সবাই কোনও না কোনও কাজে খুবই ব্যস্ত। তিনি অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। কোলের শিশুটিও অনবরত কেঁদেই চলেছে।
সখিনার খুব কাছেই একটা চেয়ারে একজন মহিলা বসে আছেন। বয়স ৩৭ বা ৩৮ হবে। দেখতেও বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ভালো বলেই মনে হয়। তিনি বললেন,
- কাউকে খুঁজছেন নাকি?
- জি, আমার মাইয়াডা বেহুঁশ হইয়া বিছনাত পইড়া রইছে। অহন আমার একটু বাথরুমে যাওন দরকার। বাইচ্চাডারে কার কাছে থুইয়া যাই হেই চিন্তায় আছি।
- ও তাই, আপনি আমার কাছে রেখে যেতে পারেন। আমার এক আত্মীয় ঐ যে পাশের বিছানায় আছে। তাকে দেখার জন্যই আমি এসেছি। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। মাত্র তো কয়েক মিনিটের ব্যাপার।
- না থাউক, আফনারে কষ্ট দিতাম চাইনা আমি।
- আরে না না, কি যে বলেন? কোনও সমস্যাই না। আপনি দেন তো আমার কাছে!
- আইচ্ছা ঠিক আছে। নেন, আমি যামু আর আমু।
- আপনি নিশ্চিন্তে যান। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে ঐ চেয়ারেই অপেক্ষা করছি।
প্রায় পাঁচ মিনিট পরেই সখিনা ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি ঐ মহিলাকে নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে দেখতে না পেয়ে মনে হয় যেন ওনার পায়ের নিচে মাটি নেই। যেন কোনও বিষাক্ত সাপ ওনাকে এইমাত্র ছোবল মেরেছে। আশেপাশে তাকিয়েও কোথাও সেই মহিলার দেখা মিলছে না।
সখিনার হঠাৎ সেই রোগীর কথা মনে পড়ে যায়, যার কথা সেই মহিলা বলেছিল। নির্দিষ্ট রোগীর বিছানার পাশেই আরেকজন বয়স্ক মহিলা বসা ছিল। হয়তো সেই রোগীর মা হবেন। যাইহোক, ওনাকে সেই মহিলার এবং শিশু কন্যাটির বর্ণনা দিলে তিনি চেনেন না বলে মুখ ফিরিয়ে নেন।
সখিনার দু চোখে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে। তিনি কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। একজন নার্সকে ব্যাপারটা জানাতেই তিনি খুব বিরক্তি প্রকাশ করেন সখিনার উপর। নার্সটি বারবার বলছেন যে সখিনা মস্ত বড় ভুল করেছেন। এভাবে অজানা অচেনা কারো হাতে শিশুকে রেখে যাওয়া মোটেও ঠিক হয়নি।
একটি দুষ্ট চক্র নানা কৌশলে হাসপাতাল থেকে প্রায়ই শিশু চুরি করে নিয়ে যায়। সখিনার দুর্ভাগ্য যে তিনি অন্ধবিশ্বাসে ঐ মহিলার উপর আস্থা রেখে শিশুটিকে ওনার দায়িত্বে রেখেছিলেন কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে!
সখিনা হাসপাতালের করিডরে, প্রধান ফটকের কাছে এমনকি রাস্তায় গিয়েও পাগলের মত খোঁজ করেছেন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। অবশেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দিলে তদন্ত কাজ শুরু হয়। হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ক্যামেরার মাধ্যমে অপরাধীকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে।
সখিনার দু চোখ জুড়ে যেন অন্তহীন বাণ নেমেছে। তিনি আমেনার বিছানার পাশে গিয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদেই চলেছেন। তিনি মনে মনে ভাবছেন যে ওনার মেয়ের যখন জ্ঞান ফিরবে তখন তিনি তার প্রশ্নের কি জবাব দেবেন?