“আমার বাবা তোমার বাবা! চুম্বন বাবা! চুম্বন বাবা! আমার বাবা তোমার বাবা! চুম্বন বাবা! চুম্বন বাবা!” এ আজব স্লোগান শোনার সাথে সাথে বাথরুমে শেভ করা রত ফরহাদ আজম বজ্রের গতিতে দোতলা বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ান। ওনার এক গালে এখনও মেঘের মত শুভ্র ফোম শোভা পাচ্ছে। যেন এক গুচ্ছ সাদা দাড়ি!
ফরহাদকে এভাবে ছুটতে দেখে ওনার তিন বছর বয়সী ছেলে জাফরও দৌড়ে বাবার পা জড়িয়ে ধরে। এক হাতে বাবাকে ধরে আছে এবং আরেক হাতের তিনটি আঙুল তার নিজের মুখে পুরে আছে। যেন সে ললিপপ খাচ্ছে!
বারান্দা থেকে রাস্তাটা একেবারে পরিষ্কার দেখা যায়। ফরহাদ দেখলেন যে একজন দুধের মত সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক সাধুর মত মুচকি হাসতে হাসতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ওনার গালভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। দেখতে কার্ল মার্ক্সের মতন।
লোকটির পেছনে সহস্র মানুষ। আশেপাশের পথচারীরাও একটু থেমে সেই সাধুকে একনজর দেখছে এবং বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করছে। কারো দৃষ্টি ক্লাসে পাঠদানরত কোনও গম্ভীর শিক্ষকের মত, কেউ জেমস বন্ডের মত সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ আবার গাল চেপে হাসছে।
চুম্বন বাবা এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন এবং দুহাত তুলে সবাইকে আশীর্বাদ করার ছলে ধীরে ধীরে রাজা যেমন হেঁটে যান তেমনই অগ্রসর হচ্ছেন। ফরহাদ তখনও বারান্দায় দাঁড়ানো। বাতাস ওনার গালের অবশিষ্ট ফোম আস্তে আস্তে চেটে শেষ করে ফেলছে। জাফর অনেক আগেই হতাশ হয়ে ফিরে গেছে তার পছন্দের কার্টুন দেখতে।
ফরহাদের বুঝতে আর বাকী রইল না যে এত বাবার ভিড়ে আরেক নতুন বাবার উদয় হয়েছে। লোকমুখে তিনি ওঝা, ফকিরদের অনেক বুজরুকির কথা শুনেছেন। মাঝে মাঝে ওনার কাজের মেয়ে আসমাও অনেক গল্প বলে কিন্তু তিনি কখনই এসবে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন না।
এলাকায় নব আগত এই চুম্বন বাবাকে নিয়ে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। বলিউডের অভিনেতা ঋত্বিক রোশানের মত তিনি যেন রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গেছেন। ওনার নামডাক কাছে দূরে ছড়াতে ছড়াতে এমন অবস্থা যে পত্রিকায়ও ওনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন এসেছে।
চুম্বন বাবাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। সবার জানার ইচ্ছে তিনি কি করেন, ওনার কি কি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে ইত্যাদি সম্পর্কে। আসমা একদিন ফরহাদকে কথা প্রসঙ্গে বলে যে চুম্বন বাবা নাকি ফুঁ, পানিপড়া বা তেলপড়া ইত্যাদি কিছুই দেন না। তিনি শুধু রোগীকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেন আর তাতেই রোগমুক্তি হয়।
ফরহাদ ওনার এই চল্লিশ বছর বয়সে অনেক ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতির নাম শুনেছেন কিন্তু কখনও চুম্বন থেরাপির নাম শুনেননি। আসমা ওনার কাছে এ তথ্য দিয়ে লজ্জায় শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে রান্নাঘরে দৌড় দিয়েছে। ফরহাদও যে মনে মনে হাসেননি সেটা বললে ভুল হবে।
কিন্তু এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ সাধারণ মানুষকে সাবধান করে দিয়েছেন। কারণ অনেক সময় এসবের পেছনে কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে মহিলাদের অবশ্যই একটু বেশীই সতর্ক থাকা উচিত।
কয়েকদিনের মধ্যেই চুম্বন বাবার ভক্ত সংখ্যা দুবাইয়ের আকাশচুম্বী অট্টালিকার মত হয়ে যায়। ওনার বাসার সামনের রাস্তায় রীতিমত যানজট লেগেই থাকে। ওনার প্রশংসার বানী যেমন প্রচার হতে থাকে, সাথে সাথে কিছু মানুষ ওনার সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকে- যেমন চুম্বন বাবা ভণ্ড, প্রতারক, লোভী, অসৎ ইত্যাদি।
একদিন ফরহাদের চোখ সংবাদপত্রের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে আঠার মত আটকে যায়। যথারীতি চুম্বন বাবাকে নিয়েই প্রতিবেদনটি কিন্তু বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ নেতিবাচক। চুম্বন বাবার গলায় ফুলের মালার পরিবর্তে জুতার মালা শোভা পাচ্ছে। ওনার মুখমণ্ডল চেনার উপায় নেই কারণ সর্বত্র কালিতে ঢাকা। ওনার চারপাশ ভক্তদের পরিবর্তে পুলিশরা দখল করে আছে। চুম্বন বাবার হাতে হাতকড়া।
প্রতিবেদনটি বেশ বড় আকারের। চুম্বন বাবাকে কিভাবে হাতেনাতে ধরা হয়েছে সেটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে। একজন মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা নাকি রোগী সেজে সাধারণ বেশে চুম্বন বাবার কাছে যান। চুম্বন বাবা ওনাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে থাকেন যেন তিনি নিজের স্ত্রীকে চুম্বন করছেন! পরবর্তীতে তিনি মহিলার স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিতে চেষ্টা করার সাথে সাথেই ছদ্মবেশী মহিলাটি চিৎকার দিয়ে বাইরে সাধারণ বেশে অপেক্ষারত বাকী পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে ডেকে আনেন।
চুম্বন বাবার চুম্বন থেরাপির এভাবেই করুণ পরিসমাপ্তি হয়। ওনাকে যখন শত শত মানুষের মাঝখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন সবাই ওনার দিকে জুতা ছুঁড়ে মারে। কেউ কেউ খুব বাজে গালি দিতে থাকে। দুদিন আগেও যারা চুম্বন বাবাকে মাথায় তুলে নেচেছে আজ তারাই ওনার ফাঁসির আবেদন করে গলা ফাটায়!