সন্দেহ [Story]

পৃথিবীর সকল সন্দেহপ্রবণ মানুষদের মধ্যে যদি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তবে সবাইকে ছাড়িয়ে এক নাম্বার স্থানটি নিঃসন্দেহে অর্জন করবে ঝলক দেব! সে যেমন সন্দেহপ্রবণ তেমন খুঁতখুঁতে।

 

মাত্র কয়েকদিন আগে তার বিয়ে হয়েছে। তার স্ত্রী সুস্মিতা দেব এস. এস. সি.  পাস। বাবা মার অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে লেখাপড়ার চাকা আর বেশী দূর এগোয়নি। এ নিয়ে অবশ্য তাকে কখনও দুশ্চিন্তা বা ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।

 

ঝলক নিজেও খুব বেশী শিক্ষিত নয়। তার একটি দোকান আছে যেটায় প্রতিদিন গিয়ে বসে, ব্যবসার দেখাশুনা করে। দোকানে প্লাস্টিকের তৈরি মগ, বালতি ইত্যাদি পাওয়া যায়।

 

বিয়ের আগে এই দোকানটিই ঝলকের কাছে ঘরের মত ছিল। সারাদিন সেখানেই কাটত তার। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া সবই হত সেখানে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে বন্ধুরা তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করতে থাকে। এখন তার বন্ধুরা দোকানে গিয়ে ঝলকের ঝলক আর দেখে না। নৌকা এক পার থেকে অন্য পারে গিয়ে আবার আগের পারে ফিরে আসে কিন্তু ঝলক তার বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে, সে আর ফিরে আসার কোনও লক্ষণ অবশিষ্ট নেই। কেউ তাকে স্বার্থপর ডাকে, কেউ ডাকে বউপাগল, কেউ কেউ ঘরকুনো এবং স্ত্রৈণ বলতেও দ্বিধা করে না।     

 

ঝলক এখন দোকানে থাকে না বললেই চলে। পিনাক নামক একটি ছেলের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাসাতেই পড়ে থাকে সবসময়। হঠাৎ বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেলে তাদের সকল অভিযোগ ঝলক হেসে উড়িয়ে দেয়।

 

সুস্মিতা অবশ্য তার স্বামীর ব্যবহারে অত্যন্ত খুশী। প্রায় সবসময় ঝলক তার সাথে থাকে, তাকে সময় দেয়। তার মনে হয় সে যেন স্বর্গে আছে। লোকে বলে লেবু বেশী কচকালে সেটা নাকি তেঁতো হয়ে যায়, ঝলক এবং সুস্মিতার দাম্পত্য জীবনেও একটু একটু করে তেঁতো ভাব ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

 

একসময় সুস্মিতার কাছে যেটা মনে হত স্বামীর ভালোবাসা কিংবা যত্ন, এখন সেটাকে বাড়াবাড়ি মনে হয়। সে চায় না ঝলক ব্যবসায় লাল বাতি জ্বালিয়ে সারাদিন মেয়ে মানুষের মত ঘরে বসে থাকুক। ইতোমধ্যে লোকজন তাকে এবং তার স্বামীকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা শুরু করেছে। সুস্মিতা বাড়ির কাজের মেয়ে আকলিমার কাছ থেকে সেটার কিছুটা আভাস পেয়েছে।  

 

অতঃপর অনেক বুঝানোর পরে ঝলক নিয়মিত দোকানে যায়, সেখানে সময় দেয়। ব্যবসাও দিনদিন উপরে উঠে চলা সিঁড়ির মত চাঙ্গা হতে থাকে। মানুষের সুদিনে যেমন বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে যায়, তেমনই শত্রুর সংখ্যাও কিন্তু বাড়ে।

 

অনেকেই ঝলকের ঘরে সুন্দর স্ত্রী এসেছে এটা নিয়ে বেশ হিংসা করত এবং এখনও করে। এখন তার ব্যবসায় উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছে দেখে নিন্দুকদের গায়ে যেন ঝাল মরিচ মেশানো পানির ঝাপটা পড়েছে।

 

উত্তপ্ত তেলের মধ্যে পিয়াজ কুচি ফেলে দিলে যেমন ছ্যাঁত করে উঠে, ঠিক একই অবস্থা ঝলকের নিন্দুকদের মনের। সবার মন যেন হিংসায় পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে।

 

ঝলকের দোকানের ঠিক বিপরীত দিকে রিয়াদ আহমেদের মুদি দোকান অবস্থিত। এই রিয়াদ অগণিত হিংসুটে মানুষের মধ্যে অন্যতম। হিংসার বশবর্তী হয়ে ইয়াগো যেমন ওথেলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, তেমনই রিয়াদ ঝলকের সুখ শান্তি বিনষ্ট করতে বদ্ধ পরিকর। একদিন সে ঝলককে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে,

 

- ঝলক, তুমি আমার বন্ধুর মত। কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি।

- কি যে বল না রিয়াদ ভাই! তুমি আমার ভাইয়ের মত। যা বলার নির্দ্বিধায় বলে ফেল।

- কাল বিকেল চারটার দিকে তোমার স্ত্রীকে পুকুর পারে এক পরপুরুষের সাথে কথা বলতে দেখলাম।

- সত্যি বলছ?

- আমি কেন মিথ্যা কথা বলতে যাব?

- না মানে তোমার দেখারও তো ভুল হতে পারে, তাই না?

- প্রথমে আমার নিজেরও বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু পরে একটু নিকটে গিয়ে দেখি যে সুস্মিতা ভাবীই।

- কিন্তু এটা তো অসম্ভব! তার কোনও আত্মীয় আসলে তো আমাকে নিশ্চয়ই বলত। হয়তো আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ এসেছিল এবং সুস্মিতা আমাকে বলতে ভুলে গেছে।

- তা তুমি আর তোমার স্ত্রী জানো। আমার কাছে একটু খটকা লেগেছে তাই তোমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেছি। আমি তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই বিষয়টা জানালাম। আশা করি তুমি অন্যভাবে নেবে না।

- আরে না, না। এ কথা বলে আমাকে লজ্জা দিও না।

 

        সন্দেহ হচ্ছে এক মারাত্মক বিষাক্ত এবং কার্যকর বীজ। এ বীজ সহজে নষ্ট হয় না। মানবমনের গভীরে একবার রোপণ করা হলে সেটা ডালপালা ছড়িয়ে মুহূর্তেই বটবৃক্ষে পরিণত হয়।   

 

        ঝলকের সাজানো গোছানো পৃথিবীতে এক প্রলয়ঙ্করী সুনামি আঘাত হেনেছে। যার আঘাত এতই ভয়াবহ যে ঝলকের সংসার ফুলে থাকা বেলুনে কেউ সুঁইয়ের খোঁচা দিলে যা হয়, ঠিক সেরকম হল। ঝলকের বিশ্বাস ছিল যে সুস্মিতা নিজ থেকে স্বীকার করবে সেই অপরিচিত মানুষটির সঙ্গে তার আলাপের ব্যপারটা। সে অনেকদিন মনে মনে আশায় থেকেছে কিন্তু তার স্ত্রীর কাছ থেকে এমন কোনও কথা সে শুনেনি।

 

        আসলে ঝলক সরাসরি সুস্মিতাকে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করছে। সে ভাবছে যে তার স্ত্রী হয়তো অন্য কিছু মনে করবে; হয়তো খুব রাগ করবে ইত্যাদি। গাছ থেকে যেমন শুকনো পাতা ঝরে পড়ে, তেমন করে সন্দেহের বীজ তার মনে প্রতিদিন নেতিবাচক চিন্তা ঝরাতে থাকে।

 

        এখন আর সে দোকানে যায় না। কখনও একান্ত যদি যেতেই হয় তবে খুব দ্রুত কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে আসে। যেহেতু বাড়িতে শুধুমাত্র সে এবং সুস্মিতা থাকে, তাই তার সন্দেহ হয় যদি স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী সেই পরপুরুষের সাথে দেখা করে।

 

        পুলিশ যেমন আসামীকে চোখের আড়াল হতে দেয় না, তেমনই ঝলক সুস্মিতাকে চোখে চোখে রাখে। এদিকে সুস্মিতা তার স্বামীর এমন পরিবর্তনের কোনও হদিস পায় না। সে ঝলককে দোকানে যেতে বললে এখন না, পরে যাব, আজ শরীর খারাপ ইত্যাদি ছুতো দিতে থাকে।

 

        একদিন দোকানে হিসেব নিয়ে কি একটা সমস্যা হবার কারণে ঝলককে সেখানে যেতেই হয়। তার মন পড়ে থাকে ঘরে; কিছুই ভালো লাগে না তার। কোনওমতে সমাধান করে দিয়ে সে ঝড়ের বেগে বাসার দিকে রওনা দেয়।

 

        বাসার প্রায় কাছাকাছি আসার পর ঝলক একজন লোককে বাইরের দিকে চলে যেতে দেখে। লোকটির চেহারা স্পষ্ট দেখতে পায়নি কিন্তু সে যে ঝলকের বাসায় এসেছিল এটা নিশ্চিত। ঝলক তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে,

 

- কেউ এসেছিল নাকি?

- না, না, তেমন কেউ না। তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি টেবিলে তোমার জন্য ভাত দিচ্ছি।

- তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ?

- আমি তোমার কাছে কি লুকাব?

- আমিতো দেখেছি একটা মানুষ আমার পাশ ঘেঁষে বাইরের দিকে যাচ্ছে।

- ও, সে তো আমাদের কাজের মেয়ে আকলিমার বড় ভাই।

- এমন সময় সে কেন এসেছে?

- আকলিমা অসুস্থ, আগামী দুই তিনদিন আসতে পারবে না; এটা জানানোর জন্যই এসেছে।

- আগে তো কখনও তাকে দেখিনি।

- তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ? আসার পর থেকে একের পর এক প্রশ্নের বৃষ্টি ঝরছে তোমার মুখ থেকে। কি বলবে পরিস্কার করে বল।

- আমি আর কি বলব? যা বলার তা তো পাড়ার মানুষেরাই বলছে।

- পাড়ার মানুষ কি বলছে শুনি!

- বলছে যে আমাই বাসায় না থাকলে তুমি তোমার কোনও এক প্রেমিকের সাথে দেখা কর।

- মুখ সামলে কথা বল! ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!

- তুমি মুখ সামলে কথা বল! চোরের মার বড় গলা।

- কে না কে কি ছাই বলেছে আর তুমি বিশ্বাস করে বসেছ। আমার কথার কোনও দাম নেই।

- না নেই।

- তাহলে তো এই সংসারের কোনও মানে হয় না। আমরা আলাদা হয়ে যাই।

- হ্যাঁ, তাই ভালো; তোমার সাথে থাকলে আমি কয়েকদিনের মধ্যেই পাগল হয়ে যাব। আমাদের ডিভোর্স নিয়ে নেওয়াই ভালো। লোকে ঠিকই বলে দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল অনেক ভালো।

 

        সেই রাতে স্বামী এবং স্ত্রী আলাদা রুমে ঘুমাতে যায়। বলাই বাহুল্য যে এত ঝড় ঝাপটার পরে দু চোখের পাতায় ঘুম এসে ভর করার কথা নয়। খুব সকালে ঝলক এক গ্লাস পানি খেয়ে দোকানের উদ্দেশে রওনা হয়। সারাদিন সে বাইরেই কাটায়।

 

যখন বাসায় ফিরে আসে তখন রাত এগারোটা বাজে। এসে দরজায় টোকা দিতে থাকে কিন্তু ভেতর থেকে কারো কোনও সাড়াশব্দ আসে না। একসময় সুস্মিতার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে হাত দিয়ে খুব জোরে দরজায় আঘাত করতে থাকে কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হয় না।

 

একসময় আর কোনও উপায় না দেখে প্রতিবেশীদের সহায়তায় দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে। ঝলক তার শয়নকক্ষে গিয়ে দেখে যে সুস্মিতার শরীর সিলিং ফ্যানে ঝুলছে। সে আত্মহত্যা করেছে।

 

পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে। টেবিলের উপর গ্লাসের নিচে ভাজ করে রাখা একটি কাগজে সুস্মিতা স্বহস্তে লিখে গেছে- আমার মৃত্যুর জন্য আমার সন্দেহপ্রবণ স্বামী ঝলক দায়ী      

View kingofwords's Full Portfolio