একটি স্বপ্নের অকালমৃত্যু [Story]

মালেকা বেগমের ছোট ভাইয়ের বয়স মাত্র এক বছর। তার মা আছিয়া বেগমের শরীরের অবস্থা খুব ভালো নয়। অভাব অনটনের সংসারে দুবেলা খাবার জুটানোই যেখানে দুস্কর সেখানে দামী ঔষধ কেনার কথাতো অকল্পনীয়।

 

আছিয়ার স্বামী জব্বার আলী প্রতিদিন রিক্সা চালায়। তারও বয়স কম হয়নি। তারপরও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন রিক্সা নিয়ে বের হতে হয়। মালেকার খুব শখ ছিল স্কুলে যাবে, নতুন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেবে, পড়ালেখা করবে, নিজের নাম কাগজে লিখবে, তার বাবা মাকে ইংরেজি বর্ণমালা শেখাবে ইত্যাদি।

 

মালেকার সব শখের উপরে পানি পড়েছে তার ছোট ভাই সালামের জন্ম হবার সাথে সাথেই। আগে তার বাবা তাকে কথা দিয়েছিল যে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে কিন্তু সালামের জন্ম হবার পর থেকে সংসারে খরচ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।

 

এমনিতেই আছিয়া প্রায় প্রতিদিন অসুস্থ থাকে তার উপর বাচ্চা ছেলেটিরও বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। এসবের মধ্যে জব্বারের কোনও ইচ্ছাই নেই মালেকাকে স্কুলে পাঠানোর। সে চায় মালেকা কোথাও ছোট কোনও কাজ করলে সংসারের কিছুটা উপকার হবে। এ ব্যাপারে আছিয়ার সাথেও কথা হয়েছে; তারও একই মত।

 

আছিয়ার প্রস্তাব হচ্ছে যে মালেকা আশেপাশের রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে পারে। এ প্রস্তাবটি জব্বারের খারাপ মনে হয়নি। মানুষের ঘরে কাজ করার চেয়ে ফুল বিক্রি করা অনেক ভালো। ফুল কিনতেও খুব বেশী খরচ পড়বে না।

 

যেই ভাবনা সেই কাজ। জব্বার মালেকাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। শুরুতে মালেকা একদম একগুঁয়ে বাচ্চার মত অসম্মতি জানিয়ে গেছে কিন্তু তার বাবা তাকে কথা দিয়েছে যে কয়েকদিন এ কাজ করার পর তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে; তাই সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছে।

 

অতঃপর মালেকার ফুল বিক্রি করার সংগ্রামের শুরু হয়। প্রতিদিন সকাল দশটার দিকে দু হাত ভর্তি করে বিভিন্ন ধরণের ফুল নিয়ে ব্যস্ততম রাস্তার ট্র্যাফিক সিগন্যালের মোড়ের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। যখনই গাড়িগুলো এসে থামে, তখন মালেকাসহ অন্যান্য ছোট ছোট দরিদ্র ছেলে মেয়েদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

 

দৌড় প্রতিযোগিতায় যেমন কে কার আগে দড়ি ছোঁবে তার চেষ্টা চলতে থাকে, ঠিক একইভাবে এই বাচ্চা ছেলে মেয়েদের প্রাণান্ত চেষ্টা থাকে কে কার আগে গাড়ির জানালায় গিয়ে পৌঁছবে। প্রাইভেট কারগুলো তাদের প্রধান টার্গেট থাকে কারণ এগুলোতে ধনী মানুষগণ চড়েন এবং ফুল বিক্রিতে লাভও বেশী আসে সেখান থেকে।

 

তাছাড়া রিক্সা ও ট্যাক্সি আরোহী এবং পথচারীদের কাছেও তারা ফুল বিক্রির চেষ্টা করে যায় পাগলের মত। মালেকা যেন পাথরের তৈরি। প্রচণ্ড রোদে যেখানে পিচঢালা পথ ফেটে যাবে এমন অবস্থা, সেখানে সে খালি পায়ে, ছেঁড়া জামায় এই গাড়ি থেকে সেই গাড়ি, এই মানুষ থেকে সেই মানুষ করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় তার কোনও হিসেব থাকে না। এমনকি ঝড় বৃষ্টিও তাকে ফুল বিক্রির চেষ্টা থেকে দমাতে পারে না।

 

মালেকার বিশ্বাস আছে মনে যে সে যেহেতু তার বাবার কথামত ফুল বিক্রি করে টাকা তুলে দেয় তার হাতে, তার বাবাও নিশ্চয়ই তার কথা রাখবে- মালেকাকে একদিন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে।

 

মালেকার গায়ের রং আগে বাদামের মত ছিল কিন্তু প্রতিদিন রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। যারা গাড়িতে থাকে তারা হয়তো কখনও এই রাস্তায় ফুল বিক্রি করা শিশুদের নিয়ে আবেগতাড়িত হয় না। কিংবা হয়তো হয়, কে জানে?

 

একদিন ফুল নিয়ে গাড়ির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মালেকা যেন নিজের হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। একটি মাইক্রোবাস এসে তাকে ধাক্কা মেরে চলে যায়। মালেকা মরা মানুষের মত পড়ে থাকে। তার সারা শরীর রক্তে ভিজে গেছে।

 

মালেকার হাতে থাকা ফুলগুলো অন্য গাড়ির চাপায় রাস্তার উপর থেতলে গেছে। আজ সকালেই জব্বার মালেকাকে বলেছিল যে কাল থেকে তাকে আর কষ্ট করে ফুল বিক্রি করতে হবে না। কাল সকালেই তার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবে; তাকে ভর্তি করিয়ে দিবে। তার মেয়েকে দেয়া কথা রাখবে।

 

স্কুলে যাবার খুশিতেই হয়তো আত্মহারা হয়ে মালেকা একটু অসাবধানতাবশত ছুটে গিয়েছিল রাস্তার মাঝখানে। হাসপাতালে নেয়ার সাথে সাথেই মালেকা এ জগত ছেড়ে চলে যায়। তার মৃত্যুর সাথে সাথে একটি সুন্দর স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়, মৃত্যু হয় একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? উত্তর হয়তো সবারই জানা অথবা কারোই জানা নেই!  

 

 

View kingofwords's Full Portfolio