বেদে মালেক ও তার স্ত্রী সখিনার একমাত্র মেয়ে জোছনা। বয়স তার ১৪ বছর। সারাদিন টিকটিকির কাটা লেজের মত টইটই করে লাফিয়ে বেড়ানোই যেন তার একমাত্র কাজ। সময়মত খাওয়া দাওয়াটাও ঠিকমত করে না। যার ফলে দুধে আলতা গায়ের রং দিন দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে।
একদিন কৌতূহলবশত জোছনা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
- আচ্ছা বাবা, এই ‘বেদে’ মানে কি?
- মারে, তোর এই প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে দেয়া সম্ভব না। শোন, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকানরাজ বল্লাল রাজার সাথে বেদেরা ঢাকায় আসে। পরবর্তীকালে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। বেদেরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ছড়িয়ে পড়ে। পূর্বে বেদেদের মনতং নামে অভিহিত করা হত। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের দেশত্যাগী অংশ বিধায় এমন নাম। তবে বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা বা হাতুড়ে ডাক্তার এবং পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ বা চিকিৎসক থেকে উদ্ভূত। বেশীরভাগ বেদেই চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট বলে সময়ের ধারাবাহিকতায় মনতংদের নাম হয় বেদে। বাংলাদেশের বেদেরা মোট নয়টি শাখায় বিভক্ত। এগুলি হলো লাউয়ো বা বাবাজিয়া, চাপাইল্যা, বাজিকর, বেজ বা মিচ্ছিগিরি, গাইন, মেল্লছ, বান্দাইরা, মাল এবং সাপুড়িয়া। সকল বেদেরাই জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে মর্যাদাপূর্ণ কাজ বলে মনে করে না। এদের সার্বজনীন পেশা হলো চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রয়। নানারকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়বাকড় এরা ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করে। এদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র বা ঝাড়ফুঁকের একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা আছে। এরা জড়িবুটি দিয়ে শিশু চিকিৎসা, বাত ও দাঁতের ব্যথা, মালিশ ইত্যাদি করে থাকে। এরা নানাধরনের খেলা দেখায়, উল্কি পরায় ও দৈহিক কসরত প্রদর্শন করে। বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ‘ঠেট’ বা ‘ঠের’।
- তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা! তোমার কাছ থেকে আজ অনেক কিছুই জানতে পেরেছি!
- তোর কি আর কোনও প্রশ্ন আছে?
- না বাবা।
বাবার কাছ থেকে এত চমৎকার ব্যাখ্যা শোনার পর জোছনার পাখীর কালো ডানার মত চোখে বিস্ময় জেগে উঠে। যেহেতু তার কল্পনার জগত খুবই সীমিত, মানে সে কখনও সুনামগঞ্জের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কোনও জেলায় আজ পর্যন্ত পা ফেলেনি; তাই তার বাবা যখন ‘আরাকান’, ‘মনতং’ এসব শব্দ উচ্চারণ করেছেন তখন কেউ যেন তার মস্তিস্কের ঘরে এসে কল্পনার জানালাগুলোকে একে একে খুলে দিয়ে গেছে! এখন সে আরাকান নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে!
বাংলাদেশের বেদেরা মোট যে নয়টি শাখায় বিভক্ত তার মধ্যে সাপুড়িয়া বেদে বা সাপুড়ে অন্যতম। সুনামগঞ্জে এদের বসবাস। এরা মনসা দেবীকে এখনও খুব শ্রদ্ধা করে। মালেক বাইদ্যা এই গোত্রের অন্তর্গত। সে সাপের তাবিজ কবজ ও ওষুধ বিক্রয় করে ও সাপ ধরে। চিকিৎসার কাজে মন্ত্র, গাছের শিকড়বাকড়, পশুপাখির হাড়, ধনেশ পাখির তেল, গরু বা মহিষের শিং, কাঁচ ভাঙ্গা, কাকিলা মাছের ধারালো দাঁত ইত্যাদি প্রকারের লোকজ ওষুধ ও জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে। সে মূলত টোটকা চিকিৎসার কাজ করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় খেলা দেখিয়ে লোকজন জড়ো করে ঔষধের ওপর মানুষের বিশ্বাস বৃদ্ধি করে ওষুধ বিক্রয় করে। মাঝে মাঝে সাপের খেলা দেখায় কিন্তু কখনও সাপ বিক্রয় করে না।
প্রতিটি বেদে পরিবারে নিজস্ব নৌকা থাকে। কয়েকটি পরিবার ও নৌকা নিয়ে হয় দল আর কয়েকটি দল নিয়ে হয় বহর। কয়েকটি বহর নিয়ে গঠিত হয় উপগোত্র। বহরের দলপতি সর্দার নামে পরিচিত। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসায়ের উদ্দেশে বেদেরা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণ করে যাকে ‘গাওয়াল’ বলে। সাধারণত মহিলারাই গাওয়ালে যায় বেশি। যে নির্দিষ্ট সময়টা গাওয়ালের জন্য বেছে নেয় তা হচ্ছে শীতের শুরুতে, অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে ও আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার্ধে। এবার গাওয়ালে যাবার জন্য সখিনা সাপের ঝাঁপি বা ঔষধের ঝুলি গোছানোর সময় জোছনা হঠাৎ কোনও আগন্তুকের মত এসে হাজির! সে মাকে বলে যে এবার সেও গাওয়ালে যাবে। এর আগে কখনও সে যাবার সুযোগ পায়নি। আসলে তার অসুস্থতার কারণেই পূর্বে সে যেতে পারেনি। যাইহোক, এবার সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে যে সে যাবেই। মা বাবার অবশ্য তাতে কোনও আপত্তি নেই।
গাওয়ালে যাবার দিন সকালবেলা সখিনা তার লক্ষ্মী মেয়ে জোছনাকে পরার জন্য একটি রঙ্গিন ফতুয়া অর্থাৎ আঙ্গি দেয়। বেদে পুরুষরা লুঙ্গি পরে। সখিনা নিজে দশহাত কাপড় দুই টুকরা করে এক টুকরা কোমরের নিচে দুপ্যাঁচ দিয়ে পরে, অন্য টুকরা গলায় ঝুলিয়ে রাখে; সেই ঝুলানো অংশটিকে দেখলে ওড়নার মত লাগে।
জোছনা যখন ফতোয়াটি পরে মায়ের কাছে আসে, মা তখন অবাক হয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন স্বর্গ হতে কোনও পরী ভুল করে এখানে চলে এসেছে! জোছনাকে দেখে এত সুন্দর লাগছে যে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না।
জোছনার গায়ের রং দুধের সরের মত ফর্সা হওয়াতে রংচঙা কাপড় খুব চমৎকারভাবে মানিয়ে যায়। যখন আশেপাশের মানুষ তার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকায়, তখন তার খুব ভালো লাগে; তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
যাইহোক, মালেক তার নৌকায় স্ত্রী সখিনা এবং প্রাণপ্রিয় কন্যা জোছনাকে নিয়ে রওয়ানা দেয়। তাদের প্রথম গন্তব্য হচ্ছে সুরমা নদী হয়ে সিলেটের কিন ব্রিজের কাছে এসে অবস্থান নেয়া।
মালেক যখন নৌকার বৈঠা হাতে নিয়ে প্রথমবার পানিতে ছোঁয়ায়, তখন জোছনার চেহারা হয়েছে দেখার মত! তার আবেগ যেন একেবারে কচি শিশুর মত! তার মন যেন এক টুকরা সাদা কাগজ যেখানে নেই কোনও কালির আঁচড় কিংবা ধুলো ময়লা।
মালেক একটু পরপর পানিতে বৈঠা ফেলে নৌকাকে সামনে নিয়ে যায়, আর জোছনা তাই দেখে আর অবাক হয়! সে মনে মনে ভাবে যে নৌকায় তিনজন মানুষ ছাড়াও আরও ব্যাগ, খাবার দাবার ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও নৌকাটি ডুবে না কেন? এটা পানিতে ফুটবল যেভাবে ভাসে, সেভাবে ভাসছে কেন?
একবার জোছনা ভাবে যে তার মার কানে কানে এই প্রশ্নটি করবে কিন্তু পরে কি ভেবে যেন আর করেনি। সে ভাবছে যে ঠিক এই মুহূর্তে এসব চিন্তা তার মাথায় কেন ঘুরপাক খাচ্ছে? হঠাৎ জোছনার চোখ গিয়ে পড়ে পানিতে ভেসে যাওয়া বিরাট একটি তালের উপরে। তালটি খুব বেশী দূর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে না। জোছনা চিৎকার দিয়ে তার বাবাকে বলে তালটা তাকে দেয়ার জন্য।
মালেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার বৈঠার মাধ্যমে খুব সহজেই তালটাকে টেনে এনে জোছনার হাতে দেয়। জোছনা সেটি হাতে নিয়ে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন এ জীবনে সে কখনও তাল দেখেনি! গাছ থেকে সরাসরি পানিতে পড়ার কারণে তালটি একদম অক্ষত আছে। তালটি এত সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে যে জোছনা সেটিকে ফুলের মত করে নাকের কাছে ধরে রয়েছে!
জোছনা তার মাকে বলে যে এই তাল দিয়ে যাতে মজার পিঠা বানায়। সখিনাও হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। অভাব অনটনের মাঝে বড় হওয়া জোছনা আজ পর্যন্ত তালের পিঠা খায়নি। তাইতো পাকা তালটিকে হাতে পেয়ে যেন সে হীরার টুকরো পেয়েছে! সে কোনোভাবেই এটাকে হাতছাড়া করতে চায় না।
গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি এসে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। তখন রাত প্রায় তিনটা। জোছনা তার মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। মালেক নৌকা বেয়েই চলেছে। যদিও সখিনা বলেছে যে পারে কোথাও নৌকাটি রেখে সকালে আবার রওয়ানা দিতে কিন্তু মালেক বলেছে যে আশেপাশে নেশাখোর থাকতে পারে; তারা এসে নৌকায় হামলে পড়লে বিপদ আরও বাড়বে। তার চেয়ে বরং আসতে আসতে গন্তব্যের দিকেই যাওয়া যাক।
চোখের পলকে আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। প্রবল বাতাসে বৈঠা ধরে থাকাই কঠিন। এত তীব্র বাতাস ঠেলে সামনে যাওয়া অসম্ভব। সখিনার চোখ লেগে গিয়েছিল। প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। জোছনা গভীর ঘুমে মগ্ন। সখিনা মালেকের কাছে এসে বসে। মালেক প্রাণপণে চেষ্টা করছে নৌকাটিকে পারে নেয়ার জন্য। কিন্তু সে বাতাসের তীব্রতার সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠছে না।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মালেকের মনে হয় প্রকৃতি যেন আজ তার পরিবারের উপর কোনও প্রতিশোধ নিচ্ছে। আকাশ থেকে পড়ছে বৃষ্টির অগুনতি ফোঁটা আর নদীতে উঠছে পাহাড়ের সমান ঢেউ। মালেক এবং সখিনা আল্লাহকে ডাকতে থাকে।
যখন সূর্যের ঘুম ভাঙে, তখন মালেক এবং সখিনা নিজেদের পার্শ্ববর্তী চরে আবিস্কার করে। তারা পাগলের মত ‘জোছনা’ ‘জোছনা’ বলে চেঁচাতে থাকে কিন্তু জোছনার দেখা মেলে না। সে যেন জাদুর মত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! হঠাৎ মালেকের নজর পড়ে চরে পড়ে থাকা একটি কালো বস্তুর উপর। কাছে গিয়ে সেটি হাতে নেয়। এটি সেই তাল যে তালের পিঠা খাবার বড্ড শখ ছিল জোছনার!