‘রহস্য!’ [বাংলা চিত্রনাট্য; Bangla Screenplay/Film Writing]

দৃশ্য ১

 

[একটি অন্ধকার গুহা]

 

 

[হঠাৎ করে স্বামী নিলয় হাসান গায়েব হয়ে যাওয়াতে তার স্ত্রী মৌ এক সাধু বাবার সাথে কথা বলতে এসেছেন। ঘন কালো অন্ধকার হওয়াতে সাধু এবং মৌ কেউই কারো মুখ দেখতে পারছেন না।]

 

মৌঃ [কাঁদতে কাঁদতে বলেন] বাবা! আমার বড় বিপদ বাবা!


সাধুঃ কি বিপদ রে মা? কি হয়েছে তোর?


মৌঃ বাবা! আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে আমার স্বামী কাজের জন্য বের হয়ে আর ফিরে আসেননি বাবা!


সাধুঃ কি নাম তোর স্বামীর?


মৌঃ নিলয় হাসান!


সাধুঃ তোর স্বামী কি কাজ করতেন?  


মৌঃ তিনি ব্যবসা করতেন বাবা! যেদিন তিনি বাসায় ফিরেননি সেদিনই আমি থানায় গিয়ে একটি জিডি করেছিলাম। সেই থেকে পুলিশ আমাকে আশ্বস্ত করেই যাচ্ছেন কিন্তু আমার স্বামীর খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি বাবা! তিনি জীবিত নাকি মৃত এই খবরটুকু পেলেও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। আপনি আমাকে পথ দেখান বাবা! আমি জানি আপনি আপনার অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা সবকিছুই বুঝতে পারেন।


সাধুঃ [কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলেন] চিন্তা  করিস না! তোর স্বামী সুস্থ আছে। তবে সে এক ভয়ংকর বিপদে পড়েছে।  


মৌঃ বিপদ? কিসের বিপদ বাবা?


সাধুঃ বললামতো, তুই এসব নিয়ে একদম ভাবিস না! তুই নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে যা। বিপদ কেটে গেলে তোর স্বামী তোর কাছে ফিরে আসবেই।


মৌঃ সত্যি আসবেতো বাবা! জানেন, দুশ্চিন্তায় আমার একটুও ঘুম হয় না!


সাধুঃ আর কোনও দুশ্চিন্তা করিস না! যা!


মৌঃ ঠিক আছে বাবা! আমি চলে যাচ্ছি। তবে যাবার আগে সম্মানী হিসেবে আপনাকে কি দেবো সেটা ঠিক ভেবে পাচ্ছি না!


সাধুঃ [মৃদু হেসে বলেন] মারে, আমার টাকা পয়সা কিংবা ধন সম্পদের বিন্দুমাত্র লোভ নেই! আমি ঐসব ভণ্ড, লোকদেখানো সাধু নই, যারা ভণ্ডামি করে, মানুষকে ঠকিয়ে টাকা উপার্জন করে!


মৌঃ আমাকে ক্ষমা করবেন বাবা! আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আমার এবং আমার স্বামীর জন্য দোয়া করবেন বাবা! যদি আপনার কথা ঠিক হয় এবং আমার নিখোঁজ স্বামী ফিরে আসে তবে আপনার এই ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারবো না। আসি বাবা!


সাধুঃ [মৌ এর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন] যা!

 

দৃশ্য ২

 

[একটি পুরনো স্যাঁতসেঁতে ভুতুরে বাড়ি]

 

[তিনজন তরুণ ডাক্তার নামক কসাই কিছু মানুষকে অপহরণ করে নিয়ে এসে তাদের উপর নানান ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ডাক্তারদের নাম যথাক্রমে- শিমুল, আইমান এবং ফারিয়া। তাদের এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে কিভাবে চিরতরুণ থাকা যায় তার উপায় খুঁজে বের করা।]

 

শিমুলঃ [আইমান ও ফারিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে] অনেক দিন ধরেইতো আমরা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি কিন্তু এখন পর্যন্ততো কোনও আশানুরূপ ফল চোখে পড়ছে না!


ফারিয়াঃ হুম! শিমুল তুমি একদম আমার মনের কথাটাই বলেছো। কিছুতেইতো কিছু হচ্ছে না!


আইমানঃ [দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলে] আমিও শতভাগ একমত।   


শিমুলঃ ইতোমধ্যে আমরা যে কয়জনকে অপহরণ করে এনে তাদের উপর পরীক্ষা করেছি, ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় তাদের প্রায় সবাই মারা গেছে।


ফারিয়াঃ সেইসব লাশ বাড়ির পেছনে ডোবায় রাখতে রাখতে ডোবাও প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে!


আইমানঃ সমস্যাতো বেড়েই চলেছে দেখছি! সমাধানেরতো কোনও পথই খোলা দেখছি না!


শিমুলঃ এখন তাহলে আর কি করার আছে?  


ফারিয়াঃ আমার মনে হয় আপাতত কয়েক মাসের জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ রাখা উচিত কারণ ইতোমধ্যে আমরা যাদেরকে অপহরণ করেছি, তাদের পরিবার নিশ্চয়ই থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে এবং অপহৃত আত্মীয় স্বজনদের খোঁজে বের হয়েছে।


আইমানঃ হুম, ফারিয়ার কথায় যুক্তি আছে। এখানে আমাদের আর বেশি দিন থাকাটা নিরাপদ নয়। আচ্ছা, আমাদের পরীক্ষার জন্য আর কত জন লোক রাখা আছে যেন?


শিমুলঃ আর মাত্র একজন। তার ওপর ঔষধ প্রয়োগ করে আমরা এই স্থান ত্যাগ করবো নাকি তাকে এখনই ছেড়ে দেবো?


আইমানঃ তাকে এখনই ছেড়ে দেয়া ভালো।


ফারিয়াঃ তাকে এভাবে জীবিত ছেড়ে দেয়াটা কি আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে না?


আইমানঃ না, এতে একটুও ঝুঁকি নেই কারণ তাকে এখানে আনার পর থেকে তার চোখ বাধা অবস্থায় আছে। সে আমাদের মুখ দেখেনি। তাছাড়া সে আমাদের নামও জানে না।


শিমুলঃ [ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে] আইমান একদম ঠিক কথাই বলেছে। লোকটিকে ছেড়ে দেবার পর সে সোজা পুলিশের কাছে গেলেও কোনও লাভ হবে না কারণ আমরা তাকে এতদিন কোথায় আটকে রেখেছি এটা সে পুলিশকে জানাতেই পারবে না। সেতো রাস্তাঘাট কিছুই দেখেনি, তাই না?


ফারিয়াঃ তাহলে আর দেরী না করে তাকে এখনই ছেড়ে দিয়ে আমাদের চলে যাওয়াই ভালো।

 

দৃশ্য ৩

 

[রাত ১২টা। একটি পুরনো অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে কক্ষ। ইঁদুর এবং তেলাপোকা গিজগিজ করছে।]

 

[শিমুল, আইমান এবং ফারিয়া সেই হাত, পা, মুখ ও চোখ বাধা লোকটির সামনে এসে দাঁড়ায়।]

 

আইমানঃ শিমুল, তার পায়ের বাধন খুলে দিয়ে বাইরে নিয়ে চলো।


শিমুলঃ ঠিক আছে।

 

[শিমুল লোকটির পায়ের বাধন খুলে দিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে নিয়ে আসে। দূর থেকে শিয়ালের ডাকের সাথে লোকটির গোঙানির শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। লোকটিকে একটি মাইক্রোবাসের পেছনের সিটে শুইয়ে দেয়া হয়। আইমান গাড়ি চালাচ্ছে। ফারিয়া তার পাশের সিটে বসেছে। শিমুল পেছনে মাঝখানের আসনে বসা।]

 

ফারিয়াঃ লোকটিকে কোথায় ফেলে আসবে বলে ঠিক করেছো?


আইমানঃ এখনও ঠিক করিনি। দেখা যাক কি হয়।


শিমুলঃ আমার মনে হয় কোনও এক নির্জন নিস্তব্ধ এলাকায় ফেলে আসলেই সবচেয়ে ভালো হবে।


আইমানঃ হুম, আমিও মনে মনে সেটাই ভাবছি।


ফারিয়াঃ আচ্ছা, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কোনও নির্জন স্থানে ফেলে আসলে ভালো হবে, তাই না?


আইমানঃ হুম, আইডিয়াটা মন্দ নয়।

 

[বুড়িগঙ্গা নদীর কোনও এক নির্জন তীরে লোকটিকে ফেলে রেখে শিমুল, আইমান এবং ফারিয়া মাইক্রোবাসে করে রাতের গভীরে জাদুর মতন অদৃশ্য হয়ে যায়।] 

 

দৃশ্য ৪

 

[বুড়িগঙ্গা নদীর তীর]

 

[লোকটি নদীর তীরে শুয়ে আছে। তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় তার বেহাল অবস্থা। গোঙানোর শক্তিটুকু নেই তার। রাত ১: ৩০টার দিকে এক পতিতা সেই স্থানের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া অবস্থায় তীরে আবছা কিছু একটা দেখতে পেয়ে সামনে এগিয়ে যায়। সেখানে হাত, পা ও মুখ বাধা লোকটিকে দেখে পতিতার সারা শরীর শিউড়ে উঠে! নাকের কাছে হাত রেখে বুঝতে পারে যে লোকটি নিশ্বাস নিচ্ছে।]

 

পতিতাঃ [তাড়াতাড়ি লোকটির সমস্ত বাধন খুলতে খুলতে বলে] তুমার নাম কি?

 

[লোকটি কোনও মতে পা পা পানি উচ্চারণ করে]

 

পতিতাঃ আইচ্ছা, আমি তুমারে পানি খাওয়াইতাছি। আর একটু সবর করো। তুমি আমার হাতডা ধরো, আমি তুমারে নিরাপদ জাগাত লইয়া যাইতাছি। হেইহানে তুমারে পানি খাওয়াইমু চলো।

 

[পতিতার সাহায্য নিয়ে লোকটি কোনওমতে হেঁটে হেঁটে পার্শ্ববর্তী একটি অগোছালো ঝুপড়ি ঘরে প্রবেশ করে। পতিতা লোকটিকে খাটে শুইয়ে দিয়ে পানি আনতে যায়।]

 

পতিতাঃ এই লও পানি। একটু কষ্ট কইরা পানিডা খাইলে ভালা লাগবো খাও।

 

[লোকটি অনেক কষ্টে সামান্য উঠে বসে কিছুটা পান করার পর ক্লান্ত দেহে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে।]

 

পতিতাঃ তুমার নাম কি? তুমার বাড়ি কোন জাগাত?

 

লোকটিঃ আমার না, নাম...

 

[এরপর লোকটি বেহুঁশ হয়ে যায়। পতিতা ভাবে যে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে তাই তাকে আর বিরক্ত না করে সে মেঝেতে একটি পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।]

 

[সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর পতিতা লোকটিকে ডাকতে থাকে কিন্তু লোকটির কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। সে ভয় পায়। কারণ তার মনে হয় লোকটি মারা গেলেতো আরেক বিপদ। পুলিশ এসে পতিতাকেই ধরে নিয়ে যাবে। সে লোকটির বুকের কাছে কান পেতে থাকে। লোকটির হৃদস্পন্দন আছে। তার মানে বেঁচে আছে। একটি রিক্সা জোগাড় করে পতিতা লোকটিকে পার্শ্ববর্তী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে চলে যায়। দুই তিন দিন পর বেশ খানিকটা সুস্থ হবার পর লোকটি হাসপাতাল ছেড়ে দেয়।]

 

দৃশ্য ৫

 

 

[একটি গুহা]

 

মৌঃ বাবা!


সাধুঃ বল মা।


মৌঃ [কেঁদে কেঁদে বলে] বাবা! আপনি বলেছিলেন আমার স্বামী ঠিকই আমার কাছে ফিরে আসবে? কিন্তু তিনি তো এখনো এলেন না বাবা!


সাধুঃ আসবে রে মা, আসবে! সবকিছুরই একটা সময় আছে। সময়ের আগে কিছুই হয় না রে মা! আম গাছে কি একদিনেই হঠাৎ করে আম ধরে? সবকিছুই সময়মত হয়। ধৈর্য ধর!


মৌঃ [কেঁদে কেঁদে বলে] আমি যে আর ধৈর্য ধরতে পারছি না বাবা!


সাধুঃ এতো ভেঙে হলে কি হয় রে মা? যা, নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যা! সে আসছে! যা!

 

[মৌ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে রওনা হয়।]

 

দৃশ্য ৬

 

[মৌ এর বাড়ি]

 

[দরজার সামনে অনেক মানুষের ভিড়। তারা কোনও একজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মৌ ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখে নিলয় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।]

 

মৌঃ [আতংকিত হয়ে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে] নিলয়! নিলয়! তোমার কি হয়েছে? কথা বলো! নিলয়!

 

[বাড়িওয়ালা সালাম আহমেদ এসে উপস্থিত]

 

সালামঃ কি হয়েছে মৌ? নিলয় এভাবে এখানে পড়ে আছে কেন?


মৌঃ [কাঁদতে কাঁদতে বলে] জানি না সালাম সাহেব। আমি একটু আগে এসে দেখি এখানে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। আপনিতো জানেন যে এতো দিন নিলয় নিখোঁজ ছিল। আল্লাহ তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে যে এভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থায় ফিরবে, সেটা আমি কল্পনাতেও ভাবিনি!


সালামঃ আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

 

[সালাম সাহেব একটি ট্যাক্সি ডেকে আনেন। মৌ ও সালাম সাহেব নিলয়কে নিয়ে ট্যাক্সিতে তুলেন।]

 

দৃশ্য ৭

 

[হাসপাতাল]

 

ডাক্তারঃ [মৌকে বলেন] আমরা দুঃখিত। আপনার স্বামীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।


মৌঃ [দুঃখে ও কষ্টে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে পড়ে গিয়ে] এ আপনি কি শোনালেন ডাক্তার সাহেব? হে আল্লাহ! কেন তুমি আমাকে এতোটা দুঃখ দিলে? কেন আমার স্বামীর এভাবে অকালমৃত্যু হলো?


সালামঃ মারে! সবই আল্লাহর ইচ্ছা! হায়াত মউত সবই আল্লাহর হাতে। যা হবার তাতো হয়েই গেছে!

 

[মৌ পাগলের মতন ছুটে গিয়ে নিলয়ের লাশ বুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতন কাঁদতে থাকে।]

 

মৌঃ [কাঁদতে কাঁদতে বলে] নিলয়! চোখ খোলো! ওঠো! দেখো তোমার মৌ তোমার কাছে! নিলয়! নিলয়! 

 

 

 

সমাপ্ত

View kingofwords's Full Portfolio