চিরকুমার! [Bangla Story]

        আমি, নোবেল, সানি এবং জন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা কখনও বিয়ে করবো না। যতই সামাজিক কিংবা পারিবারিক চাপ আসুক না কেন, আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে বটবৃক্ষের মতই স্থির এবং কঠোর থাকবো! এমনই ব্রত নিয়ে আমরা এই চার টগবগে তরুণ মিলে চিরকুমার সংঘ নামে একটি সংগঠন খুলে ফেলি।

 

        চিরকুমার সংঘ যদিও এখনও শারীরিক কোনও রূপ লাভ করেনি তবে খুব শীঘ্রই আমরা একটি কক্ষ ভাড়া করে অফিস খুলে বসবো এমনই সবার পরিকল্পনা। তাছাড়া অফিসের বাইরে একটি চিরকুমার সংঘ নামে একটি সাইনবোর্ডও ঝোলানো হবে।

 

        আসলে চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্তটি কিন্তু ঝোঁকের বশে নেয়া নয়। এ ব্যাপারে আমরা চার বন্ধু রীতিমত সিরিয়াস। যাইহোক, পাড়ায় একটি কক্ষ ভাড়ায় নিয়ে সাইনবোর্ড ঝোলানোর কাজটিও হয়ে যায়। শুরুতে এলাকার গণ্য মান্য এবং জঘন্য লোকজন নির্বিশেষে সকলেই চিরকুমার সংঘ নামক সাইনবোর্ড দেখে হাসাহাসি করতে থাকে; আমাদেরকে রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখলে পেছন থেকে কি সব উদ্ভট মন্তব্য করে ইত্যাদি; ঐ পাছে লোকে কিছু বলে আর কি!

 

        তবে একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়া কামড়ালে যেমন পুরু চামড়ার অধিকারী গণ্ডারের কিছুই হয় না, ঠিক তেমনি লোকজনের এরকম খোটা দিয়ে কথা বলাকেও আমরা গণ্ডারের মতই কিছুই ঘটেনি এমন ভাব করে থাকি!

 

        আশ্চর্যের বিষয় এই যে মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এলাকার আরও কিছু উচ্ছসি তরুণ স্বেচ্ছায় চিরকুমার সংঘে যোগদান করে। যেহেতু সংঘের কলেবর বাড়ছে, সেহেতু দায়িত্বও বেড়ে যায়। যেমন, অফিসে সাপ্তাহিক সভার আয়োজন করা, নতুন নতুন সদস্যদের জন্য ফর্মের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

 

        শুরুতে আমরা নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে এসব করলেও সময়ের সাথে সাথে ব্যয় বাড়তে থাকলে বিভিন্ন স্থানে স্পন্সর খুঁজতে থাকি এবং সৌভাগ্যবশত কিছু স্পন্সর যোগাড়ও হয়ে যায়। এতে করে আর্থিক চাপটা অনেকাংশেই কমে আসে।

 

        একদিন বন্ধু নোবেল একটি মহৎ প্রস্তাব দেয়। সে বলে,

 

- আচ্ছা, আমরা চিরকুমার সংঘের পক্ষ থেকে একটি মিছিল বা মানববন্ধন করলে কেমন হয়?


- অতি উত্তম প্রস্তাব, আমি বলি।


- হুম, আইডিয়াটা খারাপ না, সানি বলে।


- তোর কি মত জন? আমি জিজ্ঞেস করি।


- করা যায়, এতে সমস্যার কিছু দেখি না, জন বলে।


- বাহ! তাহলেতো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেছে! নেকি অর পুছ পুছ? শুভ কাজে দেরী করে কি লাভ? দ্রুত কর্মপরিকল্পনা শুরু করা যাক, তাই না, উচ্ছ্বসিত হয়ে নোবেল বলে।


- হ্যাঁ, নোবেল ঠিকই বলেছে, পরশু দিন সবাই আবার সভা করে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করা যাক, নাকি? আমি বলি।


- হ্যাঁ, তবে তাই হোক, জন, সানি এবং নোবেল একসাথে বলে।

 

        আজ আমরা চার বন্ধু মিলে সেই মিছিল বা মানববন্ধন নিয়ে আলাপ করার কথা। আমি, জন এবং সানি যথাসময়ের আগেই অফিসে এসে উপস্থিত কিন্তু নোবেলের কোনও পাত্তাই নেই। কয়েকবার তাকে ফোনে কল করেও পাওয়া যায়নি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমরা নোবেলের বাসার উদ্দেশে রওনা দেই।

 

বাসা খুব একটা দূরে নয়। কলিংবেল চাপতে না চাপতেই নোবেলের মা নিয়তি ইসলাম এসে দরজা খুলে ভেতরে বসতে বলেন। আমরা ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসি। নোবেলের মাও এসে আমাদের সামনে বসেন। আমি প্রশ্ন করি,

 

- আন্টি, নোবেল বাসায় নেই?


- আছে, ও ঘুমাচ্ছে।


- আমাদের আজকে একটা মিটিং ছিল; সে আসার কথা। তার ফোনেও অনেকবার কল করেছিলাম কিন্তু সে ফোনটা ধরেনি। তাই ভাবলাম একটু খবর নিতে তার বাসায় চলে যাই।


- হুম, খুব ভালো করেছো তোমরা এসেছো। আসলে নোবেল সকাল থেকে ভীষণ অসুস্থ! হঠাৎ করেই তীব্র জ্বর, সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, তার পাশাপাশি বমিও হচ্ছে। ডাক্তার সাহেব বলেছেন তাকে বিশ্রাম নিতে। তাকে যেন কেউ অযথা বিরক্ত না করে; এমনকি ফোনেও যেন কারো সাথে কথা বলতে না দেয়া হয়। তাই নোবেলের ফোনটা দূরে সরিয়ে রেখেছি।


- ওহ হো! তার অসুস্থতার কথা শুনে ভীষণ খারাপ লাগছে!


- তোমরা দোয়া করো যাতে সে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে।


- জি অবশ্যই। তাহলে আন্টি আমরা আজ আসি।


- আরে না, না, খালি মুখে যাবে নাকি? বসো, চা খেয়ে যাবে।


- আজ না হয় উঠি, নোবেল সুস্থ হয়ে উঠলে না হয় আরেকদিন এসে চা খেয়ে যাবো।


- বসোতো! আমি চা পাঠাচ্ছি।

 

        কি আর করা? নোবেলের মা এতো নাছোড়বান্দার মতন বসতে বললো যে তা অগ্রাহ্য করাটা তার জন্য অপমানজনক হবে ভেবেই আমরা তিনজন চায়ের অপেক্ষায় বসে থাকি। যেহেতু চা খাবার মতন অবস্থায় আমরা কেউই নেই তবুও অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতন আন্টির মিষ্টি আদেশে ঢেঁকি গিলতে হবে!

 

        চায়ের ট্রে হাতে যে এসেছে সে নোবেলের বোন। তার নাম গহনা। নোবেলের মুখে আগে বেশ কয়েকবার এই নামটি শুনেছিলাম। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বেশীরভাগ ছেলেদের হৃদয় টিকটিকির কাটা লেজের মতন লাফায়! আমার অবস্থাও হয়েছে ঠিক সেই রকম! এতো সুন্দর মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। বলিউড কিংবা হলিউডের নায়িকারাও এতোটা সুন্দরী নয়! আসলে আমি তোষামোদকারীর মতন একটুও বাড়িয়ে বলছি না। গহনার রূপ যেমন স্বর্গীয় তেমনি লাবণ্যও অতুলনীয়! সে একে একে জন এবং সানির হাতে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেবার পর আমার হাতে কাপ এগিয়ে দেয়। তখন আমার ধ্যানজ্ঞান জুড়ে গহনার রূপ খেলা করছে! আমি কে, আমার সাথে কারা বসে আছে, আমরা কোথায় আছি এসব চিন্তা আমার মস্তিষ্ক থেকে গায়েব হয়ে গেছে যেমন করে সমুদ্রের পানির প্রবাহ বেড়ে গিয়ে একটি দ্বীপ মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে যায় অনেকটা সেরকম!

 

        আমি যেভাবে গহনার দিকে তাকিয়ে আছি সেই চাহনি যে মোটেই শালীন নয় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কেন যেন আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। কোনও প্রেতাত্মা কারো দেহে প্রবেশ করে যেমন তার সমস্ত কিছু নিজের দখলে নিয়ে নেয়, ঠিক তেমনি গহনার সৌন্দর্য আমাকে উন্মাদের মত করে দিয়েছে!

 

গহনা চায়ের কাপটি ধরে দাঁড়িয়েই আছে। আমি হাত বাড়িয়েছি ঠিকই কিন্তু কাপটি শক্ত করে ধরছি না বলে গহনাও সেটি ছেড়ে যেতে পারছে না এই ভয়ে যে যদি কাপটি পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়! এদিকে আমার মাতালের মতন চাহনি দেখে গহনা লজ্জায় তার ডালিমের মতন লাল ঠোঁটে আলতো কামড় দিয়ে কোকিলের মতন মিষ্টি সুরে বলে,

 

- চায়ের কাপটা ধরুন!


- জি, দিন!

 

        যাবার সময় গহনা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছে। সে চলে যাবার পরে আমার নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হতে থাকে। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করি- এভাবে কামুকের মতন তাকালাম কেন? গহনা কি আমাকে বোকা ভাবলো? সে কি আমাকে অপছন্দ করলো? ইত্যাদি ইত্যাদি। এককথায়, যাবতীয় নেতিবাচক চিন্তার মালা তৈরি হতে থাকে আমার মস্তিষ্কের উঠোনে!

 

        আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসার সময় এটাও ভাবি যে গহনা আমাকে পছন্দ করলে কি আর না করলেই বা কি? আমি তার মায়াবী সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম যে আমি চিরকুমার সংঘের সদস্য! নারী, প্রেম, বিয়ে- এসব আমাদের কাছে দূর দূরান্তরের গ্যালাক্সির মতন যেগুলো যত দূরে থাকবে ততই মঙ্গল!

 

        তবে মনটা যদিও আমার তবে এই মনের উপর সবসময় নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে না! একটু সুযোগ পেলেই সে পাগলা ঘোড়ার মতন এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়! পরবর্তীতে আমি গোপনে গহনার ফোন নাম্বারটি সংগ্রহ করে তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলি। আমার এই বিশ্বাস ছিল যে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কেউ জানতে পারবে না। ওদিকে চিরকুমার সংঘের কাজও সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকে।

 

        কথায় আছে- চোরের দশ দিন তো গৃহস্থের এক দিন! আমার অবস্থাও হয়েছে সেই চোরের মতন। একসময় গহনার ভাই নোবেল আমাদেরকে পার্কে ডেটিং করার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলে! স্বাভাবিকভাবেই নোবেল হাল্কের মতন রেগে যায় কারণ প্রথমত আমি চিরকুমার সংঘের নীতির লঙ্ঘন করেছি; এটি এক ধরণের প্রতারণাও বলা যায়। দ্বিতীয়ত, আমি নোবেলের ছোট বোনের সাথে প্রেম লীলায় মত্ত হয়েছি!

 

        সেদিন থেকেই চিরকুমার সংঘ চিরতরে ভঙ্গ হয়ে যায়। নোবেলের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে চিড় ধরে সেটি ধীরে ধীরে বিশাল গভীর গর্তে রূপ নেয়। সানি এবং জনও আমার সং ত্যাগ করে। এদিকে নোবেল এবং তার মায়ের কঠোর  নিয়মের বেড়াজালে পড়ে গহনাও জালে আটকা পড়া মাছের মতন ছটফট করতে থাকে। গহনার সাথে দেখা করা দূরে থাক, ফোনে কথা বলারও সুযোগ নেই কারণ তার ফোনটি কেড়ে নেয়া হয়েছে। 

 

        এখন আমি কাকে দোষ দেবো তাই ভাবি- আমার নিয়ন্ত্রনহীন মনটাকে, গহনার ভাই নোবেলকে, নাকি আমার ফাটা কপালটাকে!

View kingofwords's Full Portfolio
tags:
bishu's picture

Besh laglo porte

Jodi dakhen akta read.. sheta amar ... parbon kemon katlo ? Ashakori bhalo achen.. Nomoshkarante ~bishu


©bishu 

 

KingofWords's picture

Thank you

Onek dhonnobad apnake prio Bishu. Valo achhi. Asha kori apnio onek valo achhen. :)