টিনাকে আগে যে শিক্ষক বাসায় পড়াতেন তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আর পড়াতে পারবেন না বলে টিনার মা খালেদা আমিনকে জানিয়ে দেন। এ কথা শুনে শুধুই খালেদা নন, তার সাথে সাথে টিনাও বেশ আতংকিত।
মা এবং মেয়ের আতংকের উৎস হচ্ছে টিনার আসন্ন এস এস সি পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হতে আর মাত্র টিন মাস আছে। এমতাবস্থায় জনাব ফরিদ আহমেদ আসতে পারবেন না বলে বিদায় নিয়েছেন। প্রথম যেদিন ফরিদ খালেদাকে কথাটা জানান, সেদিন খালেদার মনে হয়েছিল যে টিনা কোনও বেয়াদবি করলো কিনা, খালেদার আচার আচরণে তিনি কোনও কষ্ট পেয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিনা ইত্যাদি। স্যারকে বারবার অনুরোধ করার পরেও তিনি ঘুরে ফিরে ঐ একই কথা বললেন যে তিনি সিলেট ছেড়ে ঢাকায় চলে যাচ্ছেন। এ কথা শোনার পর খালেদা এবং টিনা কেউই আর কোনও প্রশ্ন করেনি।
কি আর করা? এটাই জগতের কঠিন নিয়ম! কেউ আমাদের জীবনে আসবে, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা নেবে এবং ছড়াবে আবার নতুন কোথাও গিয়ে একই কাজ করবে যতক্ষণ পর্যন্ত দেহ ঘড়ি সচল থাকে! সৌভাগ্যবশত টিনাকে পড়ানোর জন্য খালেদা খুব দ্রুত নতুন একজন শিক্ষক পেয়ে যান। শিক্ষকের নাম আকাশ আফ্রিদি। দেখতে খুবই সুদর্শন। কথাবার্তাও সাজানো গোছানো।
যেদিন আকাশ প্রথম টিনার বাসায় আসেন, সেদিন খালেদা তাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে যান। মুগ্ধতার পাশাপাশি এক অজানা ভয়ও ছিল; পরিস্থিতিটা ছিল অনেকটা বন্যার মতন- বন্যা যেমন সাথে করে পলি মাটি নিয়ে আসে, তেমনি যাবার সময় জান মালের ক্ষতি সাধন করে যায়, এই সুদর্শন ছেলেটিও তেমন কিছু হবে নাতো?
খালেদা ভালো করেই জানেন যে টিনার বয়সী মেয়েরা খুব দ্রুত কারো কথার জাদুতে সহজেই মুগ্ধ হয়ে যায়, সহজেই প্রেমে পড়ে যায় কারণ তাদের বয়স কম এবং তারা বুদ্ধিতেও বেশ কাঁচা থাকে। যাইহোক, খালেদা এও জানেন যে জীবনে চলতে গেলে মানুষের উপর বিশ্বাস স্থাপন করাটাও জরুরী। তাই আশংকাকে কনুই মেরে খালেদা আকাশকেই টিনার গৃহ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করলেন। তাছাড়া হাতে সময় একেবারেই নেই। মেয়ের আসন্ন পরীক্ষার কথা মাথায় রেখে খালেদা আর সময়ক্ষেপণ করতে চাননি।
আকাশকে দেখতে সিনেমার নায়কের মতন বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। গায়ের রং এতোটাই শুভ্র ঠিক যেন তুষারের রং। তার উচ্চতা রনবীর কাপুরের মতন ছয় ফুট হবে। যেদিন টিনা প্রথম বইখাতা নিয়ে স্যারের সামনে আসে, সেদিন তার চোখের দিকে তাকিয়েই সে স্যারের প্রেমে পড়ে যায়। এতোদিন টিনা মনে মনে যে রাজপুত্রের ছবি মনের ক্যানভাসে আঁকছিল সেই যেন জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে এসে ধরা দিয়েছে।
প্রথম কয়েকটি দিন আকাশ কি পড়াচ্ছেন না পড়াচ্ছেন টিনার তাতে মোটেও মনোযোগ থাকে না, সে স্যারের দিকে তাকায় আর কল্পনার রাজ্যে চলে যায়। যেমন করে সিনেমায় একটি দৃশ্যের পড়ে আরেকটি দৃশ্য আসে, ঠিক তেমন! টিনা আকাশের সৌন্দর্য, আচার, ব্যবহারে কতোটা মায়াচ্ছন্ন থাকে তা বোঝার জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। একদিন আকাশ বিজ্ঞান বিষয়ে টিনার সামনে প্রায় আধা ঘণ্টার বক্তব্য দেবার পর জিজ্ঞেস করেন,
- এতক্ষণ যা বলেছি তা কি বুঝতে পেরেছো?
- হ্যাঁ, বুঝেছি। দুঃখিত স্যার, কিছুই বুঝিনি! অনুগ্রহ করে আরেকবার বলেন!
- আমি বুঝি না তোমার মনোযোগ কোথায় থাকে? এই নিয়ে তৃতীয়বার বিষয়টি আলোচনা করেছি কিন্তু তুমি এতো সহজ ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারছো না!
- দুঃখিত স্যার, এবার ঠিক বুঝে নেবো। আর এমনটি হবে না।
- সত্যি করে বলোতো, তুমি কি কোনও দুশ্চিন্তায় আছো?
- না স্যার, আমার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। সত্যি!
- তাহলে তোমার মনোযোগ কোথায়?
- বলেছিতো স্যার, আর এমন হবে না। আপনি প্লিজ আরেকবার বলুন! প্লিজ!
পড়া শেষে টিনা যখন টিভি দেখতে যায়, তখন খুঁজে খুঁজে রোম্যান্টিক কোনও ফিল্ম দেখতে পছন্দ করে। এর কারণ হচ্ছে এই যে সে সিনেমা দেখতে দেখতে সে তার স্যারকে সেই ছবির নায়ক হিসেবে কল্পনা করে আর সে নিজে তার নায়িকা! ফিল্মের নায়ক গান গাইলে টিনার মনে হয় আকাশ গাইছে। নায়ক নায়িকাকে চুমু খেলে মনে হয় যেন আকাশ তাকে অগুনতি চুম্বনে সিক্ত করছে!
খালেদা জানেন না যে তার একমাত্র মেয়ে টিনা প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে স্রোতের তোড়ে তলিয়ে যাবার মতন অবস্থা। আকাশের দিক থেকে অবশ্য তেমন কিছু নেই। অর্থাৎ তিনি টিনাকে কখনও প্রেমিকা হিসেবে দেখেননি এবং কখনও দেখবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং টিনা তার এই একতরফা প্রেম নিয়েই দিন রাত মেতে আছে।
প্রতি রাতে আকাশকে নিয়ে টিনার রোম্যান্টিক চিন্তা করাটা রাতের আহার খাবার মতন রুটিনে পরিণত হয়েছে। প্রায়ই স্বপ্নে আকাশকে দেখে। যে সুদর্শন মানুষটিকে প্রতিদিন নয়নের সম্মুখে পায়, তার শুভ্র হাত স্পর্শ করার তাড়নায় ভোগে, এতো কাছে তার মসৃণ গাল পেয়েও চুমু খাবার বাসনাকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়, সেই মানুষটিকে রাতে স্বপ্নে সম্পূর্ণরূপে পেতে কারো কোনও বাধা নেই। সেখানে সমাজ নেই, সংস্কার নেই, নেই নিয়ম কানুন, নেই অন্যায়, নেই কোনও কিছুই! সেই স্বপ্নের জগতে শুধু টিনা এবং আকাশই বাস্তব। সেই রাজ্যে আকাশ একান্তই টিনার, আর কারো নয়!
একদিন আকাশ না এলে টিনা পাগলের মতন অস্থির হয়ে উঠে। তার কাছে আকাশ যেন চুম্বকের আরেকটি অংশ যেটি বারংবার তাকে আকর্ষিত করেই চলেছে। টিনা এখনও জানে না তার মনের সমুদ্রে প্রেমের উত্তাল ঢেউয়ের ঝাঁপটা একটুও আকাশের হৃদয়কে স্পর্শ করে কি না। সে অতীত আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেই না! তার কাছে বর্তমান, এই মুহূর্ত, এই সময়, এই মিনিট, এই সেকেন্ডই গুরুত্বপূর্ণ যেখানে সে আকাশকে দেখতে পায়, তার সাথে কথা বলার সুযোগ পায়, তাকে তার কল্পনার জগতের সঙ্গী হিসেবে পায়...
সময়ের পায়ে বেড়ী পড়াবার সাধ্য কারো নেই! দেখতে দেখতে এস এস সি পরীক্ষা চলে আসে। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে আকাশ একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়া সত্ত্বেও টিনার পড়ালেখার কথা ভেবে অনেক কষ্ট সহ্য করে তাকে পড়াতে এসেছেন।
সবকিছুর যেমন শুরু থাকে, তেমনি শেষও থাকে। পরীক্ষা শেষ হবার পরে আকাশ আর টিনার বাসায় যান না। আসলে যাবার তেমন কোনও প্রয়োজন নেই তাই যান না। এখনতো টিনার এস এস সি-র ফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। ফল প্রকাশের পর হয়তো তিনি আবারও টিনাকে এইচ এস সি-র জন্য পাঠদান করা শুরু করবেন।
ইতোমধ্যে একটা ঘটনা ঘটে যায়। আকাশ লন্ডন প্রবাসী এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেন। বিয়েটা একেবারেই হুট করে এবং পারিবারিকভাবেই হয় বলেই তিনি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও টিনা এবং তার মাকে দাওয়াত দিতে পারেন না। তার স্ত্রী এলাকার চেয়ারম্যান জমশেদ চৌধুরীর একমাত্র কন্যা লিপি চৌধুরী। ঈদের ছুটিতে দেশে বেড়াতে এসে আকাশকে দেখে ভালো লেগে যায়; পরে লিপি তার মাকে আকাশ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে বলে। আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজানোর মতই ফটাফট বিয়েটা হয়ে যায়!
আগামীকাল আকাশ লন্ডনের উদ্দেশে সস্ত্রীক রওনা হবেন। ইতোমধ্যে টিনা তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে আকাশের বিয়ের ব্যাপারে জেনেছে। সারারাত তার একটুও ঘুম হয়নি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো ফুলে গোল বেগুনের মতন হয়ে গেছে। তার মনের তীব্র আশা ছিল যে বিদায়ের আগে তার প্রাণ প্রিয় স্যার নিশ্চয়ই একটিবার দেখা করতে আসবেন।
কিন্তু টিনার সেই আশা অপূর্ণই থেকে যায়। পৃথিবীর বুক থেকে মানুষ যেমন আকাশের ঐ উড়ন্ত মেঘ ধরতে চায় এবং ব্যর্থ হয়, তেমন করে টিনাও তার মনের মানুষ আকাশকে ধরতে চেয়েও ধরতে পারেনি। হয়তো জীবন দাবা খেলার মতই জটিল এবং মিশরের পিরামিডের মতই রহস্যময় ছিল, আছে এবং থাকবে! টিনার মনে হয় জীবন যেন আশা আর হতাশার এক চিরন্তন খেলা! এই লুকোচুরি খেলা আছে বলেই জীবন এতো কষ্টের আবার মধুরও!