বিড়ম্বনা [Bangla Story]

       আলালের সাথে সহুরার বিয়ে ঠিক হয়েছে। দুটো পরিবারেই তাই সাজ সাজ রব। বসন্তে যেমন চারদিক ফুলেল সুবাসে মম করে, তেমনি আনন্দ আর ফুর্তিতে চারিদিক আচ্ছন্ন।

 

        কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে বরের পক্ষ হতে কনে পক্ষের বাড়িতে যেসব উপহার সামগ্রী পাঠানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কনের জন্য বরাদ্দকৃত কাপড়গুলো কনের মা বাবার কাছে খুবই নিম্নমানের মনে হয়েছে। এ নিয়ে তাদের মনে চাপা ক্ষোভ ছিলো ঠিক ছাইয়ের নিচে চাপা থাকা আগুনের মতন।

 

যাইহোক, সেই চাপা ক্ষোভের আগুন বোমার মত বিস্ফোরিত হয় বিয়ের দিন। যদিও সহুরা তার মা মমতাকে মানা করেছিল এ ব্যাপারে আর কোনও কথা না তুলতে, কিন্তু তার একান্ত ইচ্ছা এই যে কথাটি তুলে আলালের মা বাবাকে একটা শিক্ষা দেয়া! সফুরার বাবা অলি মিয়া মুখে না বললেও মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করে।

 

ছোট মনের মানুষের চিন্তা ছোট ছোট জিনিসেই আটকে থাকে; ঠিক সেই কুনো ব্যাঙের মতন সে তার ছোট্ট গণ্ডির বাইরে যেতে পারে না, হয়তো যেতে চায়ও না! বিয়ের দিনে বরের বাবা এখলাস এবং মা সাহারাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কনের মা সরাসরি ঐসব নিম্নমানের কাপড়ের কথা তুলে রীতিমত অপমান করে। মমতা সাহারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,  

 

- আমার মেয়ের জন্য এসব কি কাপড় পাঠিয়েছেন?

- কেন? কোনও সমস্যা হয়েছে?

- সমস্যা মানে? সমস্যার পাহাড়?

- মানে? ঠিক বুঝলাম না!

- না বোঝার কি আছে? আপনিতো কচি খুকী নন যে আমার কথার মানে বুঝতে পারছেন না?

- একটু ভেঙে বললেইতো হয়!

- যেসব কাপড় পাঠিয়েছেন সেগুলো এতোই নিম্নমানের যে কাজের মেয়েকে দিলেও পড়বে না!

- আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে! কাপড়গুলো এমি নিজে পছন্দ করে কিনেছিলাম!

- তাহলে আপনার কি মনে হয় যে আমি মিথ্যা কথা বলছি?

- ছি ছি! এ কথা বলছেন কেন? আমি কি তাই বলেছি?

- দেখুন! আমরা কিন্তু আপনাদের কাছ থেকে মোটেও এমনটা আশা করিনি।

 

চক্ষুলজ্জায় যদিও সাহারা এবং এখলাস তেমন কিছুই বলেনি, তবুও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে সময়মত তারা ঠিকই এর দাঁতভাঙা জবাব দেবে। ঠিকমত বিবাহ সম্পন্ন হয়। আলাল তার বউ সহুরাকে নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে আসে। সহুরা তার কক্ষে শুয়ে আছে। আলাল এক গ্লাস পানি খাবার জন্য ডাইনিং রুমে এলে তার মা বাবাকে বেশ বিষণ্ণ দেখে প্রশ্ন করে,

 

- কি হয়েছে মা, এমন দেখাচ্ছে কেন?

- কেমন দেখাচ্ছে?

- মনে হচ্ছে যেন কারো সাথে ঝগড়া করে এসেছো? এমন মনমরা হয়ে বসে আছো কেন?

- ঝগড়া নয়, তবে মনটা ঠিকই খুব খারাপ!

- কেন মন খারাপ আমাকে খুলে বলোতো মা?

- আজ তোর শাশুড়ি আমাকে আর তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেতাই বলেছে!

- কেন?

- আমরা নাকি তোর বউয়ের জন্য খুব নিম্নমানের কাপড় পাঠিয়েছি! এই কাপড়গুলো নাকি তাদের কাজের মেয়েরাও পড়ে না!

- তিনি সত্যিই এ কথা বলেছেন?

- হ্যাঁ, আমি মিথ্যা বলবো কেন?

- তারা এতো নিচু মনের মানুষ হবে জানলে আমি কখনই তাদের সাথে কোনোপ্রকার সম্পর্কে জড়াতাম না মা!

- এখন কি আর করা? যা হবার তাতো হয়েই গেছে!

- আমি এতো সহজে ছাড়বো না মা! আমার বাবা মাকে এভাবে অপমান করবে আর আমি সব বোবার মতন সহ্য করেই যাবো এ হতে পারে না!

 

        গ্রাম্য রীতি অনুসারে বিয়ের প্রথম রাতে স্বামী তার স্ত্রীর সাথে একই বিছানায় থাকতে পারে না; মুরব্বীরা এটাকে কাল রাত বলে। বংশ পরম্পরায় এই সংস্কৃতি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই বয়ে চলেছে। তবে আলাল তার মা বাবার অপমান সহ্য করতে পারেনি বলেই এ ব্যাপারে সহুরার সাথে কথা বলতে তার কক্ষে যায়। কক্ষে গিয়ে দেখে যে বাতি নেভানো। বাতি জ্বালাতেই দেখে যে সহুরা একপাশে ফিরে শুয়ে আছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি জেগে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ক্রোধান্বিত আলাল চিৎকার দিয়ে সহুরাকে দুইবার ডাকতেই সে পাশ ফিরে বলে,

 

- কি ব্যাপার? এতো জোরে ডাকছো কেন?

- জোরে ডাকবো নাতো কি করবো? তোমাকে চুমু খাবো?

- তোমার কি হয়েছে? আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেন?

- তোমার বাবা মা আজকে আমার বাবা মাকে ইচ্ছেমত অপমান করেছে!

- কি বলছো এসব? আমার মা বাবা তোমার মা বাবাকে কেন অহেতুক অপমান করতে যাবেন?

- করেছে বলেই বলছি!

- আমিতো এ ব্যাপারে কিছুই জানি না! এখন না জেনে কি মন্তব্য করবো বলো?  

- আমরা নাকি তোমাকে খুব নিম্ন মানের কাপড় উপহার দিয়েছি! এই কাপড় নাকি তোমাদের বাড়ির কাজের মেয়ের পড়ারও যোগ্য নয়!

- মা এসব কথা বলেছেন?

- হ্যাঁ!

- আচ্ছা ঠিক আছে, সকালে আমি মাকে ফোন দিয়ে এ বিষয়ে কথা বলবো!

- তোমার মার সাথে তুমি আর কি কথা বলবে তা আমার ভালো করেই জানা আছে!

- মানে?

- তুমি নিশ্চয়ই তোমার মায়ের পক্ষই নিবে তাই না? তোমার মা বাবা যদি ভুল করে সেটাকেতো তুমি ভুল বলার সাহস দেখাবে না!

- তুমি আমাকে কি মনে করো বলো তো? আমাকে অন্য মেয়েদের সাথে তুলনা করার ভুল করবে না!

- যে মেয়ের মা বাবা এমন বাজে স্বভাবের, তার মেয়ে আর কেমন হবে তা সহজেই ধারণা করা যায়!

- এ কথা শোনার পর তোমার সাথে কথা বলার কোনও রুচিই আমার নেই!

- সত্য কথা বললেতো আমি খারাপ হয়ে যাই, তাই না? - আসলে তোমাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছে!

- তোমার অনেক বকবক শুনেছি! এখন যাও তো! আমি ঘুমাবো!

 

        ক্রোধের আগুনে পুড়তে পুড়তে আলাল সহুরার কক্ষ হতে বের হয়ে এসে অন্য কক্ষে শুয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে সহুরা তার কক্ষের দরজা এঁটে দিয়ে তার মাকে ফোন করে আলাল যে তার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছে সেটি জানায়। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

 

- মা!

- কিরে! বাচ্চার মতন কাঁদছিস কেন?

- আলাল আমার সাথে খুব খারাপ আচরণ করেছে!

- কি করেছে?

- তুমি আর বাবা নাকি তার মা বাবাকে অপমান করেছো, তাই সে আমাকে অনেক কটু কথা শুনিয়েছে।  

- সে কি তোর গায়ে হাত তুলেছে?

- না।

- সে কি বলেছে আমায় বলতো?

- আমাকে বিয়ে করাই নাকি তার ভুল হয়েছে!

- আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। কাঁদিস না মা! অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়!

- আচ্ছা!

- আর শোন! কাল যদি আবার তোকে মানসিক যন্ত্রণা দেয় তবে অবশ্যই আমাকে জানাবি, ঠিক আছে?

- আচ্ছা মা!

- এখন ঘুমিয়ে যা। ভালো থাকিস।

- তুমিও ভালো থেকো মা।

 

        পরদিন আলাল সারাদিনের কাজ শেষে রাত নয়টায় বাসায় ফিরে আসে। গতরাতের বিষয়টি নিয়ে তার মনে প্রতিশোধের উথাল পাথাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমাতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই চাপা ক্রোধের কারণে সে সহুরাকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে দিতে চায়। যেহেতু সে তার শ্বশুর শাশুড়িকে সামনাসামনি পাচ্ছে না, তাদের উপর নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ করতে পারছে না, তাই সে তার স্ত্রীকেই লক্ষ্য করে শব্দের বাণে জর্জরিত করতে চায়। কিন্তু সহুরাকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখে আলাল যে ঠিক কি বলে শুরু করবে তা ভেবে পায় না! সে একবার এ পাশ ফিরে, আরেকবার ওইপাশ ফেরে। একবার চোখ বন্ধ করে ভাবে সহুরাকে ডাকবে, আরেকবার চোখ খুলে নিজের হাত সহুরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্পর্শ করতে চায় কিন্তু কোনও এক অজানা দ্বিধায় সে থেমে যায়। আলালের অবস্থা সেই ক্ষুধার্ত সিংহের মতন যার সামনে হরিনী বসে আছে কিন্তু সে আক্রমণ করতে পারছে না!

 

 

        রাত একটা বাজে; আলালের খুব আশা ছিলো যে সহুরা তাকে কিছু একটা বলবে এবং তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা চলবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটে না। একবার আলালের মনে হয় যে সে নিজেই সহুরার সাথে টুকটাক কথা বলবে, কিন্তু পরক্ষণেই তার মা বাবার অপমানের কথা মগজের বারান্দায় এসে পায়চারি করতেই সে পিছপা হয়; তার অভিমান তাকে প্রবলভাবে বাধা দিচ্ছে।

 

        রাত দেড়টার কাছাকাছি সময়ে আলাল সহুরাকে আদরে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে সহুরা আঁতকে উঠে বলে!

- কে? কে?

- আরে! এতো ভয় পাবার কি আছে? আমি আলাল, তোমার স্বামী!

- তুমি আমাকে স্পর্শ করছো কেন?

- কি বোকার মত কথা বলছো?

- প্লিজ তুমি আমাকে ছোঁবে না!

- মানে?

- তুমি যদি আবার আমাকে ছোও তাহলে কিন্তু আমি চিৎকার করবো?

- আবারও বাচ্চার মত কথা! আচ্ছা, তোমার সমস্যাটা কি?

- কোনও সমস্যা নেই!

- কোনও সমস্যা না থাকলে তুমি আমাকে স্পর্শ করতে দিচ্ছ না কেন?

- কোনও কারণ নেই!

- কোনও কারণ নেই মানে? একটা কারণ থাকবে না?

- বললামতো কোনও কারণ নেই!

- কারণ না বললে আমি কিন্তু ছাড়বো না!

- আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে তাই! হয়েছে? কারণ জেনেছোতো এখন?

- এটা তুমি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছো যাতে আমি তোমার কাছে না যাই!

- তোমার যা ইচ্ছা তাই মনে করো, তাতে আমার কিছুই করার নেই! এখন আমাকে আর বিরক্ত করো না। প্লিজ একটু শান্তিতে ঘুমাতে দাও!

- আচ্ছা নাক ডেকে ডেকে ইচ্ছামত ঘুমাও!

 

        ইতোমধ্যে সহুরা সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে; সে জোরে জোরে নাকও ডাকছে। অন্যদিকে আলালের একটুও ঘুম পাচ্ছে না। সে আবারও সহুরার হাতটি স্পর্শ করতেই সে আগের মতই ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বলে, কে? কে?

       

        এবারের চিৎকারের মাত্রা এতো বেশী যে সহুরার শ্বশুর ও শাশুড়ি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে তাদের কক্ষ হতে ছুটে আসে। তারা দরজায় ধাক্কা দিতেই আলাল দরজা খুলে দেয়। সহুরা সোজা দৌড়ে গিয়ে তার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলে,

 

- মা! আমি আপনার সাথে শোবো!

- আচ্ছা ঠিক আছে! চলো।

 

        সাহারা তার স্বামী এখলাসকে অন্য কক্ষে পাঠিয়ে দেয়। সেই রাতটি সহুরা তার শাশুড়ির সাথেই কাটায়। পরদিন সকালে সহুরার মা বাবা এসে উপস্থিত। তাদের এমন অকস্মাৎ উপস্থিতি দেখে সকলেই বুঝতে পারে যে সহুরা ফোন করে তাদেরকে আসতে বলেছে।

 

যাইহোক, তারা সহুরাকে নিয়ে যেতে চায়। সাহারা এবং এখলাসের তাতে কোনও আপত্তি নেই। আলাল মেজাজ খারাপ করে কিছু একটা বলতে গেলে এখলাস ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। 

 

পরদিন সহুরার বাবা এখলাসকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে সহুরা আলালের সাথে সংসার করতে চায় না। অতঃপর নিয়ম মেনেই তালাক হয়ে যায়! বিবাহের তৃতীয় দিনেই তালাক হয়ে যাবার ঘটনা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে রটে যায়! আলালের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। তার মা বাবা অতি শীঘ্রই ঘরে নতুন বউ আনতে চায়!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: