জামাল মিয়ার শরীরটা খুব খারাপ থাকা সত্ত্বেও নতুন বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে রং করার যে কাজ সে পেয়েছে, তা শেষ করতে সকালের আধখাওয়া পেটে ঘরের বাইরে পা ফেলতেই স্ত্রী জরিনা বানু বলে,
- তোমাকে কতবার মানা করেছি আজ যেয়ো না! কিন্তু তোমার কানে কোনও কথাই ঢুকে না!
- ঘর থেকে বের হবার পথে পেছন থেকে ডেকে বসলে জরিনা!
- তুমি আজ যেয়ো না। প্রয়োজনে ফোন করে তোমার অসুখের কথা বলো। ছুটি নাও।
- কি যে বলো না তুমি? আমার কি এমন হয়েছে যে কাজ করতে যেতে পারবো না? সামান্য একটু জ্বরইতো! তা এমনিতেই সেরে যাবে।
- “এমনিতেই সেরে যাবে!” বললেই হলো?
- কেন যে অকারণে এতো দুশ্চিন্তা করো আমি তা ভেবে পাই না?
- তোমার যা ইচ্ছা করো! আমার কথার কোনও মূল্য কি কখনও দিয়েছ যে আজ দেবে?
- জরিনা, এভাবে বলো না।
- এভাবে বলবো না তো কিভাবে বলবো? এতো করে বলার পর যদি তোমাকে বোঝাতে না পারি তাহলে আমার আর কি করার আছে? তুমিতো আর বাচ্চা নও যে তোমাকে মেরে বোঝাতে হবে!
- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি সরাসরি গিয়ে কথা বলেই চলে আসবো। তোমার কথাই রইল। আমি কোনও কাজ করবো না।
- তুমি আজ যেতে পারবে না এ কথা কি ফোনে বলা যায় না?
- আরে বাবা, একটু বুঝতে চেষ্টা করো। সব কাজ ফোনে হয় নাকি? তাছাড়া গন্তব্যতো খুব একটা দূরে নয়। আমি এই যাবো আর আসবো।
- তোমার যা ইচ্ছে করো!
জামাল তার কর্মক্ষেত্রে পৌঁছেই যিনি কাজের দেখাশোনা করছেন সেই মানুষটিকে বিনীত অনুরোধ করে,
- স্যার, আজ আমার শরীরটা খুব খারাপ। আজকের দিনটা যদি ছুটি পেতাম তাহলে খুব উপকার হতো।
- দেখো জামাল, এসব স্কুলের বাচ্চাদের মতন ছুটি ছুটি করবে না। এসব আমি একদম পছন্দ করি না। কাজ করলে ঠিকমত করো, না হলে ছাড়ো। তোমার মত অনেক জামাল পাওয়া যাবে।
- স্যার, আপনি কি মাইন্ড করলেন? আসলে ঘরের ভেতরের প্রত্যেকটা কক্ষের রং করার কাজ আমি আগেই শেষ করে ফেলেছি, এখন শুধু বাইরের দেয়ালের রং করাটাই বাকী। তা আমি কাল পরশু করে ফেলতে পারবো।
- আমার যা বলার আমিতো বলেছি! আজকের কাজ আজকে করলে করো, নাহলে তোমার বদলে অন্য কেউ করবে।
মানবতা নামক শব্দটি শুধুমাত্র অভিধানের শোভাবর্ধন করেই যাচ্ছে, মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে মানবতার ছিটেফোঁটাও যদি থাকতো, তবে আজ পৃথিবীটা অন্যরকম হতো! অগত্যা জামালকে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজে নামতে হয়। একবার সে ভাবে ফোনে জরিনাকে কথাটা জানাবে, কিন্তু আবার ভাবে যে জরিনা শুনলে খুব কষ্ট পাবে এবং মন খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং যতটুকু সম্ভব কাজটি করাটাই ভালো। তাছাড়া জামালের হাতে এখন এই কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজ নেই। যদি এটিও চলে যায় তবে সংসার চলবে কি করে?
এসব চিন্তা করতে করতে মোটা দড়ি বেয়ে জামাল রং করতে করতে তৃতীয় তলা পর্যন্ত উঠে যায়। তার অনেক কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সে কাজটি করতে থাকে। হঠাৎ জামালের হাত পা গাছের ডালের মত কেঁপে উঠতেই সে কোনওমতে মোটা দড়ি শক্ত করে ধরে থাকে। প্রখর সূর্যের আলো সরাসরি তার মাথায় এসে পড়াতে মাথার তালু উত্তপ্ত কড়াইয়ের মত হয়ে গেছে। সে চোখে ঝাপসা দেখতে থাকে; তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহে ফেটে যাওয়া মাঠের মতন বোধ হয়।
জামাল শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে এতক্ষণ যে দড়িটি ধরে রেখেছিল, সেটি ধরে রাখার মতন শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়, জামালের জীবন এবং মরণের মাঝে যেন মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দড়ি।
একসময় জামালের হাত আলগা হয়ে যায়। সে ভারসাম্য হারিয়ে তিনতলা থেকে সোজা নিচে পড়ে যায়। মুহূর্তেই তার মৃত্যু হয়। জরিনা খবর পেয়ে পাগলের মতন ছুটে আসে। স্বামীর রক্তাক্ত লাশের পাশে বসে জরিনা গুমরে কাঁদতে কাঁদতে ভাবে, “জামালের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী?”