আজব চোর! [Bangla Story]

ছেলেটির নাম অন্তু। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এমনিতে তার স্বভাব চরিত্র বেশ ভালো কিন্তু তার একটি অদ্ভুত অভ্যাস আছে। সেই অভ্যাসটি বদ অভ্যাস নাকি ভালো অভ্যাস তা  বিচারের দায়িত্ব পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি!         

 

অন্তু যখন যেখানে সুযোগ পায় বই চুরি করে বাসায় নিয়ে আসে। যদিও মা জোহরা খানম এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। অন্তু ভালো করেই জানে যে কোনোভাবে মা যদি জানতে পারে তবে তার হাড্ডিগুড্ডি আর এক জায়গায় থাকবে না!

 

মজার বিষয় হচ্ছে এই যে অন্তু বই চোর ঠিকই তবে সেই বই সে বিক্রি করে টাকা নিয়ে বন্ধুদের সাথে খাওয়া দাওয়া করে নষ্ট করে না; বরং সে সেই বইগুলো একে একে পড়ে। বই চুরির পর প্রথমে সে বাসায় নিয়ে আসে ঠিকই কিন্তু ঘরে রাখলে মা বুঝে যাবেন এই ভেবে সে সেগুলো বাসায় না রেখে বাসার পেছনে পাহাড়ে ঘেরা একটি পরিত্যক্ত কক্ষে লুকিয়ে রাখে।

 

অন্তু তার এই গোপন সংগ্রহশালা সম্পর্কে কাউকে কখনও বলে না। কাউকে বিশ্বাস করে বললেই একদিন না একদিন জানাজানি হবে, তখন তার কপালে দুঃখের পাহাড় ভেঙে পড়বে। সে জানে যে চুরি করা পাপ কিন্তু কেন জানি তার মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে বই চুরি করে পড়লে কারো তেমন কোনও ক্ষতি হয় না; তাছাড়া অন্তুতো সেই বইগুলো বিক্রির জন্য চুরি করে না।

 

যখনই অন্তু সুযোগ পায়, তখনই সে তার সেই স্বপ্নের কক্ষে চলে যায়। যদিও কক্ষটি সবুজ এবং নোংরা শ্যাওলায় ভরে গেছে, তবুও সে বেশ খানিকটা স্থান ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করে একটি মাদুর পেতে দিয়েছে।

 

বিশেষ করে বিকেল বেলায় মাঠে খেলতে যাবার কথা বলে অন্তু প্রায় প্রতিদিন সেই কক্ষে গিয়ে বই পড়ে। কখনও ভূতের গল্পের বই, কখনও ছড়া, কখনও নাটক, কবিতা কিংবা উপন্যাস। এভাবে চুরি করে বই পড়তে পড়তে সে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শেইক্সপিয়ারসহ বিখ্যাত সকল লেখককেই এই অল্প বয়সে চিনে ফেলেছে!

 

অন্তু জানে যে বই চুরি করে এতো সহজ নয়। সে কখনও তার বন্ধুদের কাছ থেকে বই চুরি করে না। বিশেষ করে লাইব্রেরীতে কলম কিংবা খাতা কেনার বাহানায় খুব চতুরতার সাথে চুরির কাজটি সারে!

 

একদিন অন্তু বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়তে পড়তে কিভাবে যে বেঁচেছে তা একমাত্র সে এবং আল্লাহ্‌ই জানে। একদিন কিভাবে যেন তার মা অন্তুর বই চুরির ব্যাপারে জেনে যায়। স্কুল শেষে বাসায় ফিরতে না ফিরতেই মা তার কান টেনে ধরে বলে,

 

- চোর কোথাকার! বই চুরি করিস! দাঁড়া! তোর বই চুরি আজ বের করছি!, এসব বলতে বলতে শলার ঝাড়ু দিয়ে বেদম প্রহার করতে থাকে।

 

- আর কখনও করব না মা! আর কখনও না! আমাকে আর মেরো না মা! আমি তোমার পায়ে পড়ি!, বলেও মায়ের প্রহারের হাত থেকে সে রেহাই পায় না।  

 

একপর্যায়ে অন্তুকে মারতে মারতে মা হাঁপিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে অন্তু এক দৌড়ে বাইরে চলে যায়। অন্তুকে যখন মারা হয়, তখন কাজের মেয়ে জৈবন পাকঘর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে। অন্তু তার সেই গোপন কক্ষে গিয়ে অভুক্ত বাচ্চার মত অনবরত কাঁদতে থাকে। তার মা তাকে এর আগেও দুষ্টামি করার কারণে কয়েকবার মেরেছে, তখন এতোটা খারাপ লাগেনি; আজ তার খারাপ লাগাটা একটু বেশী কারণ কাজের মেয়ের সামনে তাকে গরুর মত এভাবে মার খেতে হয়েছে। তার শুধুই এই কথা মনে হচ্ছে যে এখন জৈবন তাকে দেখলেই মজার ছলে মুচকি হাসবে।  

 

অন্তু এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা যে কখন গিয়ে রাত্রির কোলে ঢলে পড়েছে সে টেরই পায়নি। কাঁদতে কাঁদতে তার গলা খড়ের মত শুকিয়ে গেছে; ক্ষুধাও লেগেছে অনেক। কিন্তু মায়ের উপর রাগে, দুঃখে আর অভিমানে অন্তু বাড়ির দিকে যেতেই চায় না।

 

কিন্তু কি আর করা, অন্ধকার কক্ষে এতো রাতে একা বসে থাকাটাও নিরাপদ নয়। কখন যে কোথা থেকে সাপ এবং বিষাক্ত বিচ্ছু এসে কামড় দেয়! তাছাড়া ভূতের বই পড়ে পড়ে ভূত প্রেতের উপরও তার বিশ্বাস জন্মেছে।

 

অন্তু যখন বাসায় আসে তখন রাত সাড়ে দশটা। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ মুখ ফুলে আপেলের মত হয়ে গেছে! চুপিসারে নিজের কক্ষে গিয়ে কাঁথাটি নিজের গায়ে চড়িয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত বারোটার দিকে মা এসে ছেলেকে ভাত খাবার জন্য ডাকতে থাকেন। কিন্তু অন্তু সেই ডাক শুনেও না শোনার ভান করে মরা লাশের মতই পড়ে থাকে। মা বারবার ডাকতে থাকেন,

 

 

- লক্ষ্মী ছেলে আমার! ওঠ! ভাতটা খেয়ে নে!


- আমি কখনও ভাত খাব না!, অন্তুর অভিমানের বাধ ভেঙে যায় এবং সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে।      

 

অন্তুর কান্না যেন মায়ের বুকে শেলের মত বিঁধে যায়। মাও নিজের মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে থাকেন। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে অনেকটা জোর করেই অন্তুর গায়ের শার্টটি খুলে নিয়ে অন্তুর রক্তাক্ত পীঠের দিকে চেয়ে মায়ের কষ্টের আর সীমা থাকে না। ক্ষতস্থান দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও ভালুক তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে তার পীঠ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। জোহরা কাঁদেন আর মনে মনে ভাবেন এতো নির্দয়ভাবে বেচারা অন্তুকে মারাটা ঠিক হয়নি।

 

মা উঠে গিয়ে মলম এনে অন্তুর পীঠে লাগিয়ে দেন। এতে অন্তুর অভিমান কিছুটা কমে আসে। যদিও সে ভাত খাবে না বলেই জেদ করতে থাকে, তবুও মা তাকে রীতিমত জোর করেই টেনে তুলে খাবারের টেবিলে নিয়ে যান। তারপর নিজের হাতে ছেলেকে ভাত খাইয়ে দেন। মায়ের মনতো এমনই হয়, সন্তানের সাফল্যে যেমন কাঁদেন তেমনি সন্তানের কষ্টেও কাঁদেন!

 

পরদিন শুক্রবার হওয়াতে অন্তুর স্কুল বন্ধ। সে তার সেই গোপন কক্ষে গিয়ে তার জমানো সকল বই ম্যাচের কাঠি দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তার চোখের সামনে ভালোবাসার সব বই একে একে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অন্তুর চোখে একফোঁটা পানিও জমে না! অন্তু জানে যে এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তার কাঁদা উচিত, কিন্তু কেন জানি তার কান্না আসে না!

 

       তারপর অন্তু কোথায় যে প্রেতাত্মার মত অদৃশ্য হয়ে যায় আজ পর্যন্ত তার হদিস মেলে না!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: