মাটিল্ড এবং লয়জেলের বিবাহ হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন মানুষের সাথে মানুষের সুদৃঢ় বন্ধনের মাপকাঠি ছিল ‘অর্থ-বিত্ত', প্রেম বা ভালোবাসার তেমন কোনও মূল্যই ছিল না। মাটিল্ডের জন্ম একটি দরিদ্র ঘরে হলেও তার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। অন্যভাবে বললে বলা যায় যে সে ছিল বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সুখী এবং সমৃদ্ধ জীবন ছিল তার হাতের নাগালেই।
গি দ্য মোপাসঁ সুনিপুণভাবে “দ্যা নেকলেইস” গল্পটিতে দুটি মানুষের সম্পর্কের উপর আলোকপাত করেছেন যাদের স্বপ্ন ভিন্ন এবং জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন। পাশাপাশি তিনি এটাও খুব সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন যে কিভাবে লাগামহীন আকাঙ্ক্ষা মানুষের জীবনকে মুহূর্তেই পাল্টে দেয়। এককথায় বললে বলা যায় এই অসাধারণ গল্পটির মাধ্যমে মোপাসঁ পাঠকদেরকে এই শিক্ষাই দিচ্ছেন যে মানুষ যদি বাস্তবতা এবং আকাশকুসুম চিন্তাধারার মধ্যে পার্থক্যটা মন থেকে উপলব্ধি করতে পারে, তবে জীবনটা আরও সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল হবে।
অতি অল্প বয়স থেকেই মাটিল্ড স্বপ্ন দেখতো স্বীকৃতির, আভিজাত্যের, সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের, যেখানে থাকবে না দারিদ্র্য নামক অভিশাপের ছায়া। কিন্তু যখনই লয়জেলের সাথে তার বিয়ে হলো, মাটিল্ডের স্বপ্ন আয়নার মতো ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। সে পূর্বে যে দামী কাপড়চোপড়, গহনাগাঁটি, বিলাসবহুল বাড়ি ইত্যাদির স্বপ্ন দেখেছিল, সেসব যেন মুহূর্তেই কর্পূরের মত উবে গেলো! দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই মাটিল্ডের এই যে পাওয়া না পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে ফেরা, এই চিন্তাটিই লয়জেলের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক স্থাপনের মাঝখানে একটি অদৃশ্য দেয়াল হয়ে দেখা দিলো। অন্যদিকে লয়জেলের চিন্তাধারা মাটিল্ডের একেবারেই বিপরীত। সে শুধু প্রাণভরে তার স্ত্রীকে ভালোবাসতো; অবশ্য সে কখনই মাটিল্ডের দিবাস্বপ্নের ব্যাপারে জানতো না, কখনও জানতে চাইতোও না।
তবে লয়জেল মাটিল্ডের সুখ এবং স্বস্তি সম্পর্কে একেবারে উদাসীন তা কিন্তু বলা যাবে না। সে তার সাধ্যমতোই চেষ্টা করতো যাতে তার স্ত্রী শান্তিতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে লয়জেল বড় একটা খাম হাতে নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় আনন্দে বাড়ি ফিরলো এবং স্ত্রীকে বললোঃ
“দেখো, কী নিয়ে এসেছি তোমার জন্য”, সে বললো...
“শিক্ষামন্ত্রী ও মাদাম রপনু ১৮ জানুয়ারি, সোমবার সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয়ে মসিয়েঁ ও মাদাম লয়জেল এর সদয় উপস্থিতি কামনা করছেন”।
এতেই প্রমাণ হয় যে লয়জেলের চেষ্টা ছিল মাটিল্ডকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, গণ্যমান্য মানুষের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া ইত্যাদি। সে এটা করতো মূলত মাটিল্ডের প্রতি তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থেকেই এবং তাকে কিছু আনন্দময় ক্ষণ উপহার দেবার নিমিত্তে। কিন্তু মাটিল্ডের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে লয়জেলের ভালোবাসা খুবই ম্লান হয়ে গেলো যখন মাটিল্ড বিরক্তির সাথে বললোঃ
“এটা দিয়ে কি করতে বলো আমাকে?”
“কেন, প্রিয়া, আমি ভেবেছিলাম তুমি অনেক খুশি হবে। এতো বড় আয়োজনে তুমি কখনো যাওনি। এটা পাওয়ার জন্য আমি প্রচণ্ড কষ্ট করেছি। প্রত্যেকেই এটা পেতে চেয়েছিল, কিন্তু এটা ছিল নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য, অফিস সহকারীদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই এটা পেয়েছে। বিখ্যাত সব মানুষদের দেখা পাবে সেখানে তুমি”।
“আর কী ভেবেছো তুমি, এই অনুষ্ঠানে আমাকে কী পরে যেতে হবে?”
ঠিক এই মুহূর্তেই লয়জেল উপলব্ধি করতে পারে মাটিল্ডের উচ্চাভিলাষী দৃষ্টিভঙ্গি। তারপরও সে কিন্তু তার স্ত্রীর উপর বিন্দুমাত্র বিরক্ত বা রাগ হয়নি। সে যে চারশ ফ্রাঁ জমিয়ে রেখেছিল একটা বন্দুক কেনার জন্য সেই সাধের উপর পানি ছিটিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র মাটিল্ডের সুখের কথা চিন্তা করে সে বললোঃ
“ঠিক আছে, তোমাকে আমি চারশ ফ্রাঁ দেবো। কিন্তু তোমাকে এই টাকাতেই খুব সুন্দর একটা পোশাক কিনতে হবে”।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয় আর তা হচ্ছে এই যে লয়জেল তার স্ত্রী মাটিল্ডের সাধ আহ্লাদকে গুরুত্ব দিতো বলেই নিজের বন্দুক কেনার আকাঙ্ক্ষাকে মুহূর্তে জলাঞ্জলি দিতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু স্বামীর প্রতি ঠিক একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি আমরা মাটিল্ডের ভেতর দেখতে পাই না। মাটিল্ডের ভেতর লোকদেখানো দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইঃ
“আমার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখবে না। আমার বরং পার্টিতে না যাওয়াই ভালো”।
এখানে ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশী’ প্রবাদটিই যেন মাটিল্ডের চরিত্রের সাথে সমার্থক হয়ে উঠলো। স্ত্রী হিসেবে তারও উচিত ছিল স্বামীর অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করে, উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পেছনে ফেলে, স্বামীর বিপদে আপদে ছায়ার মত পাশে থেকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া। যদিও লয়জেল মাটিল্ডকে চারশ ফ্রাঁ দেবে, মাটিল্ডের অবশ্যই বোঝা উচিত ছিল যে এতো অর্থ দেবার পর স্বামী নিশ্চয়ই অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়বে। এখানে আমরা মাটিল্ডের ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত স্বার্থপরতাই দেখতে পাই।
যদিও লয়জেল মাটিল্ডের পোশাক সম্পর্কিত জটিলতার সমাধান করলো, মাটিল্ড আরেকটি নতুন সমস্যা এনে হাজির করলো তার সামনে। সেটি হচ্ছে দামী গহনা; মাটিল্ডের ইচ্ছা এই যে দামী পোশাকের সাথে দামী অলংকার না পরলে সেই পোশাকটিও তার মর্যাদা হারাবে। লয়জেল তার বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে স্ত্রীকে বললো যে সেতো সুন্দর প্রাকৃতিক ফুল দিয়েই নিজেকে সাজাতে পারে। কিন্তু এ কথা মাটিল্ডের কাছে মোটেও যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নিঃ
“ফুল পরতে পারো”, লয়জেল বললো, “বছরের এই সময়টাতে ফুল দেখতে বেশ লাগে। দশ ফ্রাঁ দিয়ে তুমি দুই তিনটি সুন্দর গোলাপ পেয়ে যাবে”...
“না...এতো ধনী নারীদের মাঝে নিজেকে দরিদ্র হিসেবে দেখানো, এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই”।
মাটিল্ডের স্বার্থপরতার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে আর্থার মিলারের বিখ্যাত নাটক “ডেথ অব এ সেইলসম্যান”-এর প্রধান চরিত্র উইলি লোম্যানের স্ত্রী লিন্ডার কথা মনে পড়ে গেলো। উইলি অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না হলেও স্ত্রী হিসেবে লিন্ডা বিপদে আপদে স্বামীর পাশেই ছিল সবসময়। কারণ সে সাধ এবং সাধ্যের মধ্যবর্তী পার্থক্যটা নিরূপণ করতে পারতো। তাই স্বামীর নিকটে কখনও মাটিল্ডের মতো এমন উচ্চাভিলাষী আবদার কখনও করেনি। তবে স্ত্রী হিসেবে লিন্ডা এবং মাটিল্ডের মধ্যে পার্থক্য যেমন বিদ্যমান তেমনি একটি জায়গায় আবার বেশ জোরালো মিলও রয়েছে; স্বামীর অসচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও তাদের কেউই সম্পর্ক ছেদ করেনি।
লয়জেল দ্বিতীয়বারের মতো তার বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে আরেকটি গহনা সম্পর্কিত সমস্যার সুন্দর সমাধান সামনে নিয়ে এলো। সে মাটিল্ডকে বললো যে তার ধনী বান্ধবী মাদাম ফরেস্টিয়ারের কাছ থেকে কিছু অলংকার ধার নেবার জন্য। এবার অবশ্য মাটিল্ড লক্ষ্মী স্ত্রীর মতই তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো; তার মানে সে সম্মতি জানালো যে সে তার বান্ধবীর কাছ থেকেই অলংকার ধার নিয়ে আসবে এবং পার্টি শেষে তা আবার ফিরিয়ে দেবে। এখানে আমরা মাটিল্ডের প্রশংসা না করে পারি না কারণ মাটিল্ড কিন্তু লয়জেলের কাছে ঐ দামী নতুন ড্রেসের মতো দামী নতুন অলংকারের আবদার করেনি। মানে মাটিল্ডের মনের কোণে কোথাও একটু হলেও বিচক্ষণতার ছিটেফোঁটা তখনও অবশিষ্ট ছিল। সে “দ্যা লাঞ্চন” ছোটগল্পের ঐ খাদক মহিলার মতন স্বার্থপরভাবে সবকিছু নিংড়ে নেয়নিঃ
“তুমি কতো বোকা!” বিষ্ময় নিয়ে তার স্বামী বললো, “যাও, মাদাম ফরেস্টিয়ারের সাথে দেখা করে কিছু অলংকার ধার চাও। তোমার সাথে তার যে সম্পর্ক, তুমি ধার চাইলে সে না দিয়ে পারবে না”...
“ঠিক বলেছো। আমি তো আগে কখনো ভেবে দেখিনি”।
যথারীতি মাটিল্ড মাদাম ফরেস্টিয়ারের কাছ থেকে একটি হীরার হার ধার নিয়ে এলো। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। পার্টিতে অন্য সবার দৃষ্টি পড়লো মাটিল্ডের উপর। তাকে অনিন্দ্য সুন্দর দেখাচ্ছিল। পার্টিতে আসা অন্যান্য নারীরা যদি আকাশের তারা হয়, তবে মাটিল্ড অবশ্যই একমাত্র চাঁদ; তার সৌন্দর্যের ছটার কাছে অন্য সবার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেলো। এমন স্বীকৃতিই তো মাটিল্ডের প্রত্যাশা ছিল। সে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে; মানুষ তাকে চিনবে, প্রশংসা করবে, সম্মান করবে। হোক না এ স্বীকৃতি শুধুমাত্র একটি রাতের জন্য, তবুও মাটিল্ডের কাছে এর মূল্য হাজার রাত্রির সমতুল্য।
যখন মাটিল্ড পার্টিটাকে আনন্দের সাথে উপভোগ করছিল, তখন লয়জেল অন্য একটি কক্ষে ঘুমাচ্ছিল। তার কিন্তু উচিত ছিল সর্বদা স্ত্রীর পাশে থাকা, তাকে সঙ্গ দেয়া, অন্যান্য অভিজাত এবং সফল মানুষদের সাথে পরিচিত হওয়া ইত্যাদি; তা না করে সে নিজেকে একা এবং বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপের মতো করে রাখলো। স্বামী স্ত্রী হিসেবে লয়জেল এবং মাটিল্ড যে একই ছাদের নিচে থেকেও দুটি ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল তা বুঝতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না।
পার্টি শেষে বাড়ি ফেরার পথে লয়জেল ভালোবাসার দৃষ্টিকোণ থেকে মাটিল্ডের কাঁধে একটি শাল জড়িয়ে দিলেন। মাটিল্ড তার স্বামীর কাছ থেকে এমন উষ্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে বরং কিছুটা উদ্বিগ্ন হলো। কারণ তার কাঁধে জড়ানো শালটি বেশ সস্তা ধরণের; মাটিল্ডের শঙ্কা হচ্ছিল এই ভেবে যে অন্য কেউ যদি সেই শাল পরা অবস্থায় দেখে ফেলে তবে তার মান সম্মান নষ্ট হবে। প্রকৃত অর্থে এই শালটি মাটিল্ডকে তার বাস্তবতার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল বারবার। গাড়িতে করে ফেরার পথে স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল; পার্টিতে ঘটে যাওয়া সুন্দর মুহূর্তগুলো নিয়ে আলোচনা না করে তারা দুজনই চুপ হয়ে রইলো।
বাসায় ফিরে মাটিল্ড যখন বুঝতে পারলো যে সে দামী হীরার হারটি হারিয়ে ফেলেছে, তখন লয়জেল কিন্তু মোটেও স্ত্রীর উপর রাগান্বিত হয়নি বা কোনও প্রকার অশোভন আচরণ করেনি। বরং সে বাইরে ছুটে গিয়ে হারটি খুঁজতে থাকলো। দুর্ভাগ্যবশত কোথাও হারটি পাওয়া গেলো না। দুজনে মিলে একটি সুন্দর সমাধান বের করলো এই ভেবে যে হুবহু দেখতে আরেকটি হীরার হার কিনে মাদাম ফরেস্টিয়ারকে ফেরত দিতে হবে। লয়জেলের কাছে তার বাবার রেখে যাওয়া আঠারো হাজার ফ্রাঁ ছিল। বাকিটা সে ধার করবে বলে মনস্থির করলো।
স্ত্রীর বিপদে লয়জেল তাকে দোষারোপ না করে বরং তাকে বিপদ এবং অসম্মান থেকে রক্ষা করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতে রাজী। কারণ লয়জেল সত্যিকার অর্থেই মাটিল্ডকে ভালোবাসতো; তাকে সর্বদা খুশী দেখতে চাইতো সে। মাটিল্ডের ব্যক্তিত্বে যদি লয়জেলের এমন উদার মানসিকতা থাকতো তবে তাদের দাম্পত্য জীবনটা অসাধারণ হতো! যাইহোক, ছত্রিশ হাজার ফ্রাঁ খরচ করে ঐরকম দেখতে হীরার হার কিনে মাদাম ফরেস্টিয়ারকে ফিরিয়ে দেয়া হলো।
লয়জেলের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা এবং মাটিল্ডের প্রতি তার ভালোবাসা মাটিল্ডকে মন থেকে অনুভব করতে বাধ্য করলো যে তার স্বামী তার জন্য সব করতে পারে। হীরার হারটি হারানোর পর থেকে মাটিল্ডের ভেতরে জীবনের কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করার বোধটুকু জন্ম নিলো। সে এখন দিবাস্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে বিশাল ব্যবধানটি খুঁজে পেলো। যেহেতু তার স্বামী তার সম্মান বাঁচাতে নিজের যা কিছু অর্থ আছে তা দিয়ে এবং আরও কিছু অর্থ ধার নিয়ে একটি নতুন হীরার হার কিনে মাদাম ফরেস্টিয়ারকে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করলো, মাটিল্ডও তার মন থেকে স্বার্থপরতার পোশাক ফেলে দিয়ে কিভাবে সংসারের ব্যয় কমানো যায় সে চিন্তা করতে থাকলো। বাস্তবতা সম্পর্কে মাটিল্ডের এই বোধ এবং বিবেচনা যদি আরও আগে আসতো, তবে দাম্পত্য জীবন অন্যরকম হতো! সে ঘরে আর কোনও কাজের লোক রাখলো না, সমস্ত কাজ সে নিজেই করতে থাকলো; কিছুটা অর্থ জমানোর জন্য বাজারে দরকষাকষি করা থেকে সব কিছু। কারণ স্বামী তার বিপদে যেমন পাশে দাঁড়িয়েছে, মাটিল্ডেরও উচিত তার পক্ষে যতটুকু পারা যায় স্বামীকে সহযোগিতা করাঃ
“সে পরিচিত হতে লাগলো গৃহের ভারী ভারী কাজকর্মের সাথে, রান্নাঘরের ঘৃণ্য কাজগুলোর সাথে। সে বাসনকোসন ধুয়ে দিতো, তার সুকোমল সুশ্রী আঙ্গুল আর গোলাপী নখগুলো দিয়ে পাতিলের চর্বি এবং কড়াইয়ের নিচে লেগে থাকা ময়লা পরিস্কার করতো। সে ময়লা বিছানার চাদর, অন্তর্বাস, শার্ট আর থালাবাসনের ক্লথ ধুয়ে তারের উপর ঝুলিয়ে দিতো রোদে শুকানোর জন্য; প্রত্যেক দিন সকালে সে ডাস্টবিনের ঝুড়ি নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসতো, পানি টানতে গিয়ে একটু পর পর থামতো শ্বাস নিতে। গরিব মহিলার মতো পোশাক পরে, কাঁখে ঝুড়ি নিয়ে সে ফলবিক্রেতা, মুদি দোকানী, মাংস বিক্রেতার কাছে যেতো, দর কষাকষি করতো, অপমানিত হতো, তার কষ্টার্জিত টাকার প্রতিটি আধা-পেনি বাঁচানোর জন্য যেন যুদ্ধ করতো।
প্রত্যেক মাসের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হতো, নতুবা সময় বাড়ানোর জন্য নতুন ঋণ নিতে হতো।
তার স্বামী সন্ধ্যায় বণিকের হিসাব রক্ষক হিসেবে কাজ করতো, আর প্রায় রাতেই প্রতি পৃষ্ঠা দুই পেনি, আধা-পেনি হিসেবে পাণ্ডুলিপি নকলের কাজ করতো।
এইভাবে জীবন চললো দশ বছর।
দশ বছর শেষে সকল ঋণ পরিশোধ হলো, সবকিছু, সুদের কারবারির সব টাকা, পুঞ্জিভূত সব চক্রবৃদ্ধি সুদ।”
এই যে ঋণ শোধ করার জন্য স্বামী স্ত্রীর অক্লান্ত প্রচেষ্টা, এটি তাদের দুজনকে খুব কাছে টেনে আনলো। তাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মান বেড়ে গেলো। যাইহোক, একদিন মনটাকে সতেজ করার জন্য মাটিল্ড শাঁ-জেলিজির পাশ দিয়ে হাঁটতে বের হলো। তখন সে মাদাম ফরেস্টিয়ারকে দেখতে পেলো; তার তারুণ্য এবং রূপ ছিল সেই আগের মতই। প্রথমে মাদাম ফরেস্টিয়ার মাটিল্ডকে চিনতে পারেনি, পরে পরিচয় দেয়াতে চিনলো। কথাপ্রসঙ্গে মাটিল্ড তাকে সেই হীরার হার হারিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে অতি কষ্টে সেই হার কিনে ফেরত দেয়ার কথাটা বললো। মাদাম ফরেস্টিয়ার তা শুনে অবাক হলো কারণ সেই হারটি আসল হীরার হার ছিল না; সেটি ছিল নকলঃ
“ওহ! আমার বেচারি মাটিল্ড! কিন্তু আমারটি ছিল মেকি। এর মূল্য বড় জোড় পাঁচ শত ফ্রাঁ!…”
গল্পটির এই শেষ লাইনটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সংসারে সফল এবং সুখী হতে গেলে ভালোবাসা, বিশ্বাস, সহানুভূতি, মহানুভবতা ইত্যাদি গুণাবলীর পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। আমার মনে হয় যে মাটিল্ড এবং লয়জেল হারটি হারানোর পরপরই যদি মাদাম ফরেস্টিয়ারকে বিষয়টি জানাতো, তাহলে হয়তো তাদেরকে এভাবে দারিদ্র্যের কষাঘাত সহ্য করতে হতো না। মাটিল্ড এবং লয়জেল কারো মনেই এই কথাটি একবারও এলো না যে হার যদি কিনতেই হয় তবে তা তো মাদাম ফরেস্টিয়ারের সাথে কথা বলার পরও কেনা যাবে। যদি হারটি সত্যিই হীরার হতো, তবে এমনও তো হতে পারতো যে মাদাম ফরেস্টিয়ার তখনই পুরো অর্থ না চেয়ে মাসে মাসে কিস্তির মতো করে দিতে বলতো! আসলে বিপদে স্বামী স্ত্রী কেউই তাদের সুবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারেনি। তবে লয়জেলের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, মাটিল্ডের প্রতি তার সত্যিকারের ভালোবাসা, তার জন্য সবকিছু করতে পারার মানসিকতা- এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমার লেখা একটি ‘পোয়েটেনরি’ বা দশপদী কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয় যেটির নাম “তোমার জন্য আমি সব করতে পারি”-
তোমার জন্য আমি করতে পারি সব,
বলেই দেখোনা একবার,
করতে পারি ছিনতাই ঐ আকাশের তারা,
বললে করবো ধার পাখির কলরব।
যদি বলো জীবন দিতে,
দিতে পারি তাও,
ভালোবাসার জন্যই মোর বাঁচা কিংবা মরা,
তোমায় যদি না পাই প্রিয়া, মরা কি সম্ভব শান্তিতে?
চাই না কিছুই আর তোমার ভালোবাসার পরশ ছাড়া,
দাওনা করতে পান স্বর্গীয় সুধা, দাওনা জোছনার মতো ধরা!