রাতে আমি একটি মস্ত বড় ইলিশ মাছ কিনে বাড়ি ফিরছিলাম। ইলিশ মাছ আমার খুব একটা পছন্দের মাছ না হলেও আমার মায়ের অসম্ভব প্রিয় একটি মাছ এটি। এক কদম দুই কদম করে অগ্রসর হবার সাথে সাথে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গুনগুন করে গাইছিলাম।
জাগ্রুতি খালের উপরে ছোট্ট সেতুর উপর উঠতেই অগ্নিগিরির বুক চিড়ে আচমকা ছুটে আসা ফুলকির মতন অন্ধকারের ভেতর থেকে তিনজন যুবক আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পাশ কাটিয়ে যেতে চাইতেই একজন বলল,
- দাঁড়ান!
- কেন?
- কাজ আছে।
- কি কাজ?
- আমাদেরকে দেখে কি মনে হয় আপনার?
- কি মনে হবে আবার?
- আপনি কি বাচ্চা নাকি? কচি খোকা? নাক টিপলে দুধ বের হয় নাকি?
- দেখুন! বাড়াবাড়ি করছেন কিন্তু! মুখ সামলে কথা বলুন! না হলে কিন্তু...
- না হলে কি?
- আমি বুঝতে পারছি আপনারা ছিনতাইকারী। কিন্তু আমার কাছে এমন মূল্যবান কিছুই নেই যেটা আপনাদের কোনও কাজে আসতে পারে।
- তা আপনাকে দেখেই বোঝা যায়!
- তাহলে কি চান আপনারা? আপনাদের কারো সাথে আমার কোনও শত্রুতা আছে বলেও মনে হয় না!
- আপনার কাছে একটি অতি মূল্যবান জিনিস আছে যেটা আমরা নিতে চাই।
- দেখুন, আমার কাছে এই সস্তা মোবাইল ফোন, একটি মান্ধাতা আমলের ঘড়ি আর দুইশত টাকা ছাড়া কিছুই নেই! ওহ হো! ভুলেই গিয়েছিলাম, চাইলে এগুলোর সাথে এই তাজা পদ্মার ইলিশটিও নিয়ে যেতে পারেন।
ইতোমধ্যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের মধ্যে একজন একটি ধারালো ছোরা বের করে আমার পেছনে এসে যমদূতের মত দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হল ওরা বুঝি আমার প্রাণটাই নিতে এসেছে। তাহলে কি সেই নামহীন যুবকের মতে আমার ‘প্রাণ’ই তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস যেটা সে নিয়ে নিতে চায়।
অজানা এক আশংকা এবং ভয়ে ইলিশ মাছটি আমার হাত থেকে পড়ে গেল। আমি যে কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি ক্ষণিকের জন্য অনুভব করলাম যে আমার সমস্ত শরীর যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মতন অবশ হয়ে গেল। যেন সমস্ত শরীর মর্গে রাখা মৃতদেহের মত হিম শীতল হয়ে গেল!
আমি তাদের উদ্দেশে কিছু একটা বলতে চেয়েও কেন জানি কথা জড়িয়ে এলো; কিছুই বলতে পারলাম না। যে যুবকটির সাথে কিছুক্ষণ পূর্বে কথা হচ্ছিল সে তার কোমরে হাত দিয়ে একটি পিষ্টল বের করে ঠিক আমার দুই ভ্রূর মাঝখানে রাখল।
আমার মনের সাহস কেরোসিনের বাতির মত দপ করে নিভে যায় না, আকাশের তারার মতই তা মনের মাঝে সর্বদা থাকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি যে কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম না তা মোটেও বলা যাবে না। আমি অনুভব করলাম যে আমার কপাল বেয়ে দুই ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে আমার চোখের পাপড়ি পর্যন্ত এসে থেমে আছে! বুকে সাহস নিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম,
- আপনারা কারা? কি চান আপনারা আমার কাছে?
- আমরা আপনার কাছ থেকে আপনার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চাই!
- কিন্তু এ ভাষা তো আমরা ১৯৫২ সালে অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি! এটাতো আমাদের ভাষা!
- তখন আপনাদের কাছ থেকে আমরা এই ‘বাংলা’ ভাষা কেড়ে নিতে পারিনি ঠিকই, তবে এখন নেব; এক এক করে ১৬ কোটি মানুষের মুখ থেকে খুব নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা তা ছিনিয়ে নেব বলে ঠিক করেছি।
- কিন্তু এতদিন পরে এসব করে কি লাভ?
- প্রতিশোধ! প্রতিশোধের আগুনে আমরা পুড়ে মরছি প্রতিটি সেকেন্ড। শ্মশানে যেমন লাশ পুড়ে ঠিক তেমন। এই ভাষা কেড়ে নেবার গুপ্ত পরিকল্পনার প্রথম শিকার আপনি।
- আপনারা আমার ভাষা কেড়ে নিতে চান কিন্তু নিজেরা কেন তাহলে আমার ভাষাতেই কথা বলছেন?
- আপনার কি মনে হয় যে আমরা খুব আনন্দের সাথে আপনার ভাষায় কথা বলছি? আমরা বাধ্য হয়েই বলছি কারণ তা না হলে আপনি আমাদের কথা বুঝবেন না তাই। তাছাড়া উপর থেকে নির্দেশ আছে এমনটা করার। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত আরকি!
- তো আমি কিভাবে আপনাদেরকে আমার ভাষা দিতে পারি? এটাতো গাছের ফল নয় যে পেড়ে দিয়ে দিলাম!
- আপনি চোখ বন্ধ করুন, আমরা আপনার ভাষা নিয়ে নিচ্ছি।
সেই যুবকটি আমার কপালে পরপর দুটি গুলি করল। আমি গাছ হতে ভাঙা ডাল পড়ার মত মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। মৃত ইলিশ মাছটার পাশেই ছিল আমার পাথরের মত নিস্প্রান দেহ পড়ে। কৈ মাছের মতন বেশিক্ষণ নড়াচড়ার সুযোগ পাইনি। পানি থেকে ইলিশ মাছ তুলে আনার সাথে সাথে যেমন মরে যায়, ঠিক তেমনি আমার প্রাণ পাখী খাঁচা ছেড়ে কোথায় যে উড়ে গেল আমি বুঝতেই পারলাম না। আমি যে মারা গেলাম সেটাই তো বুঝলাম না! কেউ আমাকে এসে বলল না যে আমার মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং আমি মারা গেছি!
ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেল। সকাল ছয়টা; অদূরে মাইকে একটি গান বাজছিল ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। খোলা জানালাটিকে টিভির মত দেখাচ্ছিল! যেখানে শুধুই নীল আকাশটাকে দেখা যাচ্ছিল। মেঘের একটুও ছিটেফোঁটা ছিল না সেথায়। হঠাৎ একটি পাখীর সানন্দে উড়ে যাওয়া দেখে নিজের অজান্তেই আমার চোখে জল এলো; এ জল হতাশা বা দুঃখের নয়, নয় এখনও বেঁচে থাকার আনন্দের। লাখো শহীদের কষ্টার্জিত ভাষা এবং স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করার আনন্দে শিশুর মত কাঁদলাম কিছুক্ষণ!