জালাল উদ্দিন রুমি এবং মীরাবাঈয়ের কবিতার তুলনামূলক আলোচনার প্রাক্কালে এই মহান কবিদের জীবনের উপর কিছুটা আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয়-
মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (১২০৭-১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ) খোরাসানের (বর্তমান আফগানিস্তান) বলখ শহরে জন্মগ্রহন করেন। তাঁকে বিশ্ব সংক্ষেপে রুমি নামে চেনে। ত্রয়োদশ শতকের একজন ফার্সি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক ও সুফি দর্শনের শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রচুর। রুমির পরিবারের সদস্যগণ ছিলেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও ধর্মতাত্ত্বিক।
রুমি অনেক কালজয়ী গ্রন্থের স্রষ্টা। ফার্সি ভাষায় রচিত তাঁর বই “মসনবী” মুসলমানদের কাছে খুবই সন্মানিত এবং মূল্যবান। পাশাপাশি পাশ্চাত্যেও এটি তুমুল জনপ্রিয় একটি গ্রন্থ। ২৫ হাজার শ্লোক রয়েছে এই পুস্তকে যার পুরোটা জুড়েই রয়েছে শিক্ষামূলক নীতিবাক্য। “মসনবী” বিশ্বের নানান ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তাঁর “দিওয়ান-ই-শামস-তাবরিজ” গ্রন্থটি বাংলায় অনুদিত হয়েছে। এছাড়া রুমীকে নিয়ে রচিত কোলম্যান বার্কসের বই “দ্য সোল অব রুমী” বইটিরও বাংলা সংস্করণ পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ম্যাডোনাসহ আরো জনপ্রিয় অনেক শিল্পীরা রুমির কবিতাকে গানে রূপ দিয়েছেন এবং এতে করে রুমির প্রতি তাদের নিঃস্বার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন।
অন্যদিকে মীরাবাঈ বা মীরা (১৪৯৮-১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন অভিজাতবংশীয় হিন্দু অতিন্দ্রীয়বাদী সংগীতশিল্পী এবং সহজিয়া বা অসাম্প্রদায়িক কৃষ্ণ-ভক্ত। তিনি রাজস্থান, ভারত অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। মীরাবাঈ বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের সন্ত ধারার অন্যতম অগ্রপথিক ছিলেন বলা চলে। মীরাবাঈকে একজন মরমী কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়; কেউ কেউ আবার তাঁকে একজন কৃষ্ণভক্ত উন্মাদিনী বলে ডাকতে পছন্দ করেন। শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে তাঁর লেখা ভক্তিগীতি বা ভজন প্রায় ৫ হাজার। এখনও ভারতবর্ষের নানান প্রান্তরে কৃষ্ণভক্তরা সেইসব মনমাতানো গান গেয়ে চলেছেন। তবে কেউ কেউ মনে করেন যে মীরাবাঈ ৫ হাজার গান নয় বরং ৪০০র মতন জনপ্রিয় গান লিখেছেন। মতান্তরে তিনি বারোশো থেকে তেরোশো ভজন রচনা করেছিলেন। ভক্তিবাদী ধারায় রচিত বিপুল জনপ্রিয় এই গানগুলির মাধ্যমে তিনি কৃষ্ণের প্রতি তাঁর ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেনঃ
ওরে নীল যমুনার জল
বলরে মোরে বল
কোথায় ঘনশ্যাম।
মীরার গানগুলো সাধারণ ধারায় রচিত পদ, শ্লোক বা চরণ; এসব গানে মূলত আধ্যাত্মিকতাই প্রকাশ পায়। পদগুলো একত্রিত হয়ে “মীরার পদাবলী” বা “মীরার ভজন” নাম ধারণ করে। ভারতে এলস্টোন এবং সুব্রামনিয়াম মীরাবাঈয়ের নির্বাচিত আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো “দ্য হিন্দি ক্লাসিক্যাল ট্র্যাডিশন” শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। অন্যদিকে রবার্ট ব্লাই মীরার কিছু ভজন “মীরাবাঈ ভার্সনস্” নামে প্রকাশ করেছেন। আবার ব্লাই জেন হির্শফিল্ডের সাথে “মিরাবাঈ: একস্ট্যাটিক পোয়েমস্” নামে যৌথভাবেও একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। মীরাবাঈয়ের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ উইলিস ব্রানসটন এবং টনি ব্রানসটন সম্পাদিত “লিটারেচারর্স অব এশিয়া, আফ্রিকা অ্যান্ড লাতিন আমেরিকা”-তে বিদ্যমান।
এবার আলোচনার মূল অংশে ফেরা যাক। রুমি এবং মীরাবাঈয়ের কবিতায় আমরা সেই সময়কার পবিত্র কিছুর প্রতি মানব আকাঙ্ক্ষা বা বাসনার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই তাঁদের স্বকীয় লেখনীর বৈশিষ্টের দ্বারা। মীরাবাঈ তাঁর লেখায় নিজের সত্ত্বাকে আড়াল করার জন্য নিজেকে ‘তৃতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এই ভয়ে যে পাছে ‘ডার্ক ওয়ান’ বা ‘কৃষ্ণ’ তাঁর কথা শুনে ফেলেন! সার্বিক কাব্যিক কাঠামোর দিক থেকে মীরাবাঈয়ের কবিতা এক পৃষ্ঠার বেশী নয় বললেই চলে; অপরক্ষে রুমির কবিতাগুলো অনেক দীর্ঘ এবং আলাদা অংশগুলো আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতায় বিভক্ত। মীরাবাঈয়ের গানগুলো শুনলে কৃষ্ণের ভালোবাসা প্রাপ্তির যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা সেটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। সত্যি কথা বলতে কি মীরাবাঈয়ের কবিতাগুলোকে যখন গানের মত গাওয়া হয়, তখন সেই কণ্ঠস্বর এতো বেশী গভীর আবেগের ঝরনাধারা বইয়ে দেয় যে তা কবিতা পাঠে তুলনামূলকভাবে কম মেলে। এইখানেই আমরা মীরাবাঈয়ের শব্দের সরব উপস্থিতির দেখা পাই। মীরাবাঈ নির্ঘুম চঞ্চল রাতের মাধ্যমে তাঁর ভালোবাসার অপূর্ণতার প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। যেহেতু তিনি কৃষ্ণ প্রেমে একতরফাভাবে মজেছেন, তাই তাঁর কাছে মনে হয় যে তিনি এখনও ‘অপূর্ণ’-
সারারাত ঘুমোতে পারিনি
আমি ঘুমাতে পারি না। সারারাত।
প্রাণপ্রিয়র প্রতীক্ষায় থাকি।
বন্ধুদের প্রস্তাব
বিজ্ঞ বচন।
সব ফিরিয়ে দিই আমি।
মীরাবাঈয়ের কবিতায় জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের ব্যপ্তি খুব চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। কিন্তু রুমির কবিতায় একটি অন্তর্নিহিত দর্শনের দেখা মেলে যা মিরার গানে অনুপস্থিত। রুমির লেখা পড়লে পাঠকদের মনে হয় যেন গল্প পড়ছেন। অন্যদিকে মীরার গানগুলো সাধারণ ধারারই পদ, শ্লোক বা চরণ যা আধ্যাত্মিক গানেরই অংশবিশেষ। পদগুলো একত্রিত হয়ে "মীরার পদাবলী" বা ‘মীরার ভজন’ নাম ধারণ করে। বর্তমানে প্রচলিত অনুবাদগুলো রাজস্থানী ভাষায় এবং কৃষ্ণের জন্মভূমি বৃন্দাবনে হিন্দীতে ব্রজ ভাষায় ব্যাপক হারে উচ্চারিত হচ্ছে। পদগুলোর কিছু কিছু আবার রাজস্থানী এবং গুজরাটি- উভয় ভাষায়ই লিখিত।
মীরার অস্তিত্ব জুড়ে ছিল একটি নাম- শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ প্রেমে তিনি এতোটাই পাগল ছিলেন যে কবিতায় কৃষ্ণের প্রিয় রঙ গোধূলীতে রঙ্গীন হবার আকাঙ্ক্ষার কথাও আমরা দেখতে পাই। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং অন্যদেরকে বলতেন যে প্রেমিক ও প্রভু হিসেবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ। তিনি তাঁর কবিতায় কৃষ্ণের চরণে নিজেকে ফুলের মত বিলিয়ে দিয়েছেন যেনঃ
ওকে ছাড়া যে মনে শান্তি পাই না।
অথচ হৃদয় আমার মোটেও ক্রোধান্বিত নয়
আমার নিম্নাঙ্গ অবশ
ঠোঁট আমার জপে তার নাম
বিচ্ছেদের এই যাতনা বোঝা কি যায়?
মেঘের প্রতীক্ষায় থাকা আমি এক চাতক পাখি;
আমি এক জলাকাঙ্খী মাছ
মীরা শেষ!
ওর চেতনা অবশ!
রুমি এবং মীরাবাঈয়ের কবিতায় এমন কিছু উপাদান বিদ্যমান যেগুলো সেই সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ বিতর্কিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে মীরাবাঈ তাঁর গানের মাধ্যমে আবারও পুরুষ হয়ে জন্মানোর সাধ ব্যক্ত করেছেন; মীরার দ্বিতীয় বিয়ে যখন হয় তখন তাঁর বয়স আঠারো। স্বামী ছিলেন চিতরের রাজা যার নাম ভোজরাজ। ভোজরাজ ছিলেন রীতিমত কালীভক্ত। অন্যদিকে মীরার আরাধ্য দেবতা ছিলেন কৃষ্ণ। ফলে মত এবং আদর্শের পার্থক্য পরিণামে বিরোধের জন্ম দিলোঃ
রাজা ভোজরাজ, ঘরে গানের আসর না বসালেওতো পারো মীরা।
মীরা, আমি যে পারি না!
রাজা ভোজরাজ, মা ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ করছেন না।
মীরা, আমি যে পারি না!
রাজা ভোজরাজ, কেন তোমার কালীকে ভালো লাগে না বলতো?
মীরা, আমি যে পারি না!
রাজা ভোজরাজ, এসব টানাপোড়েন আমার আর ভাল্ লাগে না মীরা।
মীরা, আমি যে পারি না!
মীরাবাঈ জীবনে যৌনতার ভূমিকাকে অস্বীকার করেছেন এ কথা বলা যাবে না। তিনি কখনই যৌনতাকে এড়িয়ে পবিত্র থাকার মত কপটতার আশ্রয় নেননি। শ্রীকৃষ্ণের কাল্পনিক বিচরণ ছিল মীরার দেহ মন সর্বত্র। এই যৌন দিকটি মীরার ভজনে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়ঃ
রাতদিন আমি
তোমার ভাবনায়
আচ্ছন্ন।
অন্যদিকে রুমির “দ্যা ফরবিডেন রুমি” গ্রন্থটি বিতর্কের সমুদ্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। এই পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোতে রুমি শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শামস তাবরিজ সম্পর্কে এতো আবেগতাড়িত ভাষায় লিখেছেন যা সমকামিতার ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়াও গ্রন্থটিতে আরও অনেক বিতর্কিত বিষয় আছে।
পরিশেষে, এটি স্বীকার করতেই হবে যে রুমি এবং মীরার সৃষ্টিকর্মের সাহিত্যিক ব্যাপ্তি অপরিসীম। তবে মেধা, মনন এবং স্বকীয় ব্যাপকতার দৃষ্টিকোণ থেকে রুমিকে খানিকটা এগিয়ে রাখা যায়। রুমি নানান বিষয় নিয়ে লিখেছেন- হোক তা ধর্ম, শিশুতোষ লেখা, প্রকৃতির গুণগান বিষয়ক কবিতা ইত্যাদি। রুমি প্রায় কবিতার শেষে পাঠকদের প্রতি একটি চিন্তামূলক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন যা কিনা তাঁর কবিতাকে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট প্রদান করে। সন্দেহাতীতভাবে মীরার গানগুলো আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল স্পর্শ করে; কিন্তু রুমির লেখায় যে রকম মাদকতা এবং জাদুময় ব্যাপার আছে, তা মীরাকে খানিকটা হলেও পিছিয়ে দেয়। রুমি যেভাবে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে অতি সাধারণ কোনও বস্তকে মানবীয় দ্যোতনা প্রদান করেন তা এককথায় অসাধারণ। যেমন তাঁর কবিতায় বাদ্যযন্ত্রগুলো মানুষের মত কান্না করে এবং সেগুলোর কান্নার ধ্বনি আমাদের মনে বিরক্তির জন্ম দেয় না বরং আনন্দের উপলক্ষ সৃষ্টি করে- যাকে আমরা সুর বলি! অবশেষে রুমির লেখা দুটি অবিস্মরণীয় পঙক্তি দিয়েই প্রবন্ধটির ইতি টানছিঃ
যখন আমি আমাকে ভালোবাসি তখন মনে হয় তোমাকেই ভালোবাসি,
আর যখন তোমাকে ভালোবাসি তখন মনে হয় আমি আমাকেই ভালোবাসি।